Barak UpdatesHappeningsAnalyticsBreaking NewsFeature Story

কেমন আছেন শিলচরের পরিযায়ী শ্রমিকরা, লিখেছেন রাহুল রায়
How are the migrant labourers in Silchar, writes Rahul Roy

//রাহুল রায়//
সাম্প্রতিক কালে  বাড়ির পথে ফিরে চলা পরিযায়ী শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা আমাদের দেশের মানুষের মনন জগতে এক বিরাট ঝড় তুলেছে। দ্বিতীয় দফার শাসনকালের বর্ষপূর্তিতে ৩০ মে খোদ নরেন্দ্র মোদি পরিযায়ী শ্রমিকের দুর্দশার কথা স্বীকার করেছেন। করোনা সংক্রমণ রোধে লকডাউনের সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে শ্রমিকদের  রুজি রোজগার আচমকাই একরকম বন্ধ হয়ে যায়।  এক-দুইদিনে হাতের সামান্য সঞ্চয় শেষ হয়ে যাওয়াটাও কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়। ফলে তাঁদের অবস্থা যে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে বাড়ি ফেরার তাগিদে, পরিবার-পরিজনের কাছে যাওয়ার তাগিদে শতাধিক মাইল  তাঁরা পায়ে হেঁটে, সাইকেল চালিয়ে, ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে, মাল টানা ট্রেনের বগির ভেতরে বসে পাড়ি দিয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমে আসা একের পর এক শ্রমিকের মৃত্যু, সামাজিক মাধ্যমে ভেসে আসা তাদের এই চরম দুর্দশার ছবি দেশবাসীকে নাড়িয়ে দেয়। দেশের রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের ঝড় বইতে শুরু করে। সরকার প্রথম দিকে সাড়া না দিলেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে তাদের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে।  পিএম কেয়ারস ফান্ড থেকে ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে।  পরবর্তীতে দেশের ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য দু’মাসের রেশন ব্যবস্থা করে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয়। আগামী আগষ্ট মাস থেকে ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ ব্যবস্থা শুরু হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
যাই হোক, এবার আসা যাক আমাদের ছোট্ট শহর শিলচরে। এখন কেমন আছেন এখানকার পরিযায়ী শ্রমিকরা। তবে এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আরও একটি প্রশ্ন করতে হয়, এরা আদতে এখানে কী রকম আছেন? উত্তরটা ঘরে বসে জানা সম্ভব নয়, সেটা খুঁজতে যেতে হবে সেই শ্রমিকদের মধ্যেই।
শিলচরের ফাটক বাজারের দোকানগুলোতে বিহার থেকে আগত অনেক শ্রমিকই কাজ করেন। এরা মজুরি ভিত্তিক কাজ করেন। একই দোকানে কাজ করলেও সরকারি খাতায় দোকান মালিকেরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিক বলে স্বীকৃতি দেন না। এমনকি দু-তিন পুরুষ থেকে বাজারের একই দোকানে কাজ করছেন, অথচ খাতায়পত্রে তিনি সেই ওই দোকানের কেউ নন, এমন উদাহরণ দুর্লভ নয়। দোকানমালিক তাঁদের দিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করান, পরিবর্তে দয়াভিক্ষের মতোই ইচ্ছেমতো মজুরি দেন, কিন্তু শ্রমিকের স্বীকৃতি তথা মর্যাদা দেন না। তাঁদের জন্য সেখানে একটি সম্বোধন বরাদ্দ অবশ্য আছে, তা হল ‘মজুরি লেবার’। শহরের বিভিন্ন ঘিঞ্জি বস্তিতে কম ভাড়ার ঘরে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মুরগির খামারের মতো গাদাগাদি করে রাতটা কাটিয়েই তাঁরা দু’পয়সা কামানোর জন্য সেই মালিকের দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন।
দোকানের ঠেলা  চালিয়ে, মাল বয়ে যা  রোজগার হয়, তার থেকেই ঘরে পাঠানো ও নিজের জীবন কাটানো হয়।  এখানে আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ করতে হয় যে, সরকার ধার্য করা ন্যূনতম মজুরি থেকে সেটা কয়েক যোজন দূরে আটকে থাকে। ভাবতেও আশ্চর্য লাগে যে আমাদের এই শিলচর শহরে এখনো ৫ টাকা দরে ঠেলাচালক জিনিস নিয়ে যান! এই শ্রমিকরা তা নেন তাদের মালিকদের জন্য, যে মালিকরা তাদের ন্যূনতম সম্মান বা স্বীকৃতি অবধি দেন না ! বাজারে দোকানমালিকদের ধার্য করা মজুরিতেই  তাঁদের  কাজ করতে হয়, কোনও দর কষাকষি চলে না।  চা বাগান শ্রমিকদের জন্য বাগান কর্তৃপক্ষ রেশনের ব্যবস্থা করে রেখেছে, বাগানেই তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া হয়।  অথচ এই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য এরকম কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। দিনান্তে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করার পর শরীর খারাপ হলে মালিকপক্ষ সেই দায় নেন না।
দেশের অন্যান্য অংশের মতো শিলচরেও লকডাউনের ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় অধিকাংশ দোকান বন্ধ থাকে। তাই এই পরিযায়ী শ্রমিকদেরও উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। মাসাধিক কাল এভাবে থাকার ফলে তাদের সঞ্চিত টাকা কবেই শেষ হয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে বাজার ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করলেও স্বাভাবিক অবস্থার অর্ধেক উপার্জনও এখন সম্ভব হচ্ছে না। শুধু ফাটক বাজারেই বিহার থেকে আগত প্রায় ৪০০  জন শ্রমিক কাজ করেন।  এরা এখন বাড়ি ফিরে যেতে চাইছেন। অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ নিজেদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে চান। তবে বাজার যদি স্বাভাবিক হয়ে যায় তারা এক্ষুণি হয়তো যাবেন না। শুধু ফাটক বাজার নয়, বরাক উপত্যকা জুড়ে থাকা প্রায় ২০০০ পরিযায়ী শ্রমিকদেরও বর্তমানে একই অবস্থা, কম-বেশ একই মানসিকতা।
সে যাই হোক, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যে রকম হৃদয়বিদারক ছবি উঠে আসছে বাস্তবে সেগুলো শুধু যে এই সময়বিশেষে তাঁদের অবস্থা তুলে ধরছে তা কিন্তু নয়। তুলে ধরছে তাদের নিত্যদিনের  জীবনকাহিনি। যে কাহিনিতে প্রতিটা দিন তাদের যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় এবং তাঁরা লড়াই করেন বলেই আমাদের বাজারগুলো চলতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হল আমরা সব দেখে, সব জেনেও ভাবলেশহীন নিষ্পৃহ থাকি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker