NE UpdatesHappeningsBreaking News

বাঙালি-অসমিয়াঃ কী বললেন মুখ্যমন্ত্রী

ওয়েটুবরাক, ৩০ মেঃ ধেমাজি জেলার শিলাপথারে সারা আসাম বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশনের পঞ্চদশ দ্বিবার্ষিক কেন্দ্রীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। মঙ্গলবার তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অসমের বাঙালিরা সময়ের গতিতে এগিয়ে বৃহত্তর অসমিয়া সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। প্রব্রজন ও বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে অসমের জাতীয় জীবনে অসমের বাঙালিরা রাজ্যের কৃষ্টি, সংস্কৃতির সঙ্গে অসমিয়া ভাষা সাহিত্যের অগ্রগামী যাত্রায় অমূল্য অবদান রেখেছে। অসমিয়াভাষী এবং বাংলাভাষী অসমিয়ার যৌথ প্রচেষ্টায় জগতসভায় অসমিয়া জাতিকে শক্তিশালী রূপে প্রতিষ্ঠা করেছে। ইতিহাসের পাতায় বহু স্বনামধন্য অসমিয়াভাষী ও বাংলাভাষী  অসমিয়ার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাংলাভাষায় প্রথম প্রকাশিত ইতিহাস গ্রন্থটি লিখেছিলেন একজন অসমিয়ায়। গ্রন্থটি ছিল হোলিরাম ঢেকিয়াল ফুকনের রচিত আসাম বুরুঞ্জি। এই আসাম বুরুঞ্জি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় লিখেছেন অসমিয়া লেখক হোলিরাম ঢেকিয়াল ফুকন। এটিই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ। ১৮২৯ সালে কলকাতার সমাচার চন্দ্রিকা প্রেসে এটি নিজের খরচে মুদ্রণ করে বিনামূল্যে বিতরণ করেছিলেন। তাঁর এই গ্রন্থের আবিষ্কারক ও  সম্পাদক ছিলেন কটন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য। আসাম বুরুঞ্জি ছাড়াও, সোনাভিরাম বরুয়া প্রণীত প্রথম আধুনিক অসমিয়া নাটক রামনবমী কলকাতা থেকে উদ্ধার করে প্রকাশ করেছিলেন। সমাচার দর্পণ সহ কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলাভাষায় লেখালেখি করেছেন বহু অসমিয়া বুদ্ধিজীবী। তাঁরা হলেন হোলিরাম ঢেকিয়াল ফুকন, যজ্ঞরাম খারঘুরিয়া ফুকন, যাদুরাম ডেকা বরুয়া, মণিরাম দেওয়ান প্রমুখ। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মণিরাম দেওয়ানের নেতৃত্বে অসমে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার অন্যতম দিগদর্শক ছিলেন একজন বাঙালি। অসম সাহিত্য সভা গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া মহান অসমিয়াদের সঙ্গে ছিলেন একজন বাঙালি পণ্ডিত, কটন কলেজের নামজাদা অধ্যাপক মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ। সাহিত্যিক অতুলচন্দ্র হাজরিকা ও রত্নকান্ত বরকাকতি পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদের উদ্যোগে ১৯১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে অসমিয়া সাহিত্যিকদের একটি দল অংশ নিয়েছিল। সেখানেই বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের মতো চন্দ্রনাথ শর্মা, অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী ও নবকান্ত বরকাকতির সহযোগিতায় অসম সাহিত্য সভা বা সম্মেলনের ধারণার জন্ম হয়েছিল। ১৯১৭ সালে অসমের তদানীন্তন বিশিষ্ট ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার স্থায়ী রূপ হলো অসম সাহিত্য সভা। অসমিয়া যে স্বতন্ত্র ভাষা, সে কথা ব্রিটিশ সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক সিভিলিয়ান রমেশচন্দ্র দত্ত।

হিমন্ত বলেন, অসমিয়া-বাঙালির বৈবাহিক সম্পর্কও নতুন নয়। অসমে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তক, কটন কলেজের প্রধান শিক্ষক জন্মেজয় দাস প্রথম অশমিয়া মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। ড. সূর্যকুমার ভুইয়া লিখেছেন, জন্মেজয় দাসকে অসমের টমাস আনন্দ বলা যেতে পারে। তার অনুপ্রেরণায় আনন্দরাম বরুয়া, জালনর আলি আহমেদ, শিবরাম বরা, হোলিনারায়ণ বরা প্রমুখ বিলাতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কীর্তিমন্ত অসমিয়া বলে পরিচয় দিতে পেরেছিল। এই ভাবেই একটি জাতির মানুষ অন্য একটা জাতির উন্নয়নে ভূমিকা গ্রহণ করে। ইতিহাসের পাতার অনেক উদাহরণ এই প্রসঙ্গে টানা যায়। অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার জন্য দেড়শতকের বেশি সময় ধরে অসমের বাঙালিসমাজ অবদান জুগিয়ে চলেছে। বৈকুণ্ঠবিহারী রায় ১৮০৯ সালে প্রভাত ও ১৮২৭ সালে ছয় রিপু আরু মদ নামে দুটি অসমিয়া নাট্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। অম্বিকাচরণ ঘোষ প্রণীত গ্রন্থ ১৮২৩ সালে এবং জয়চন্দ্র চক্রবর্তী প্রণীত গ্রন্থ ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুটিই ছিল অসমিয়ায় লেখা প্রথম পাঠ্যপুথি। মহেন্দ্রমোহন মিত্র আসামবন্ধুতে অসমিয়া ভাষায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অসমিয়া ও ইংরেজি দুই ভাষায় আসামবন্ধু প্রকাশ পেত।

অসমবাসী বাঙালিদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের দাবিতে সরব না হয়ে বাংলাভাষী অসমিয়া হিসেবে নিজেদের ভাবতে ও অসমিয়া হিসেবে গৌরব অনুভব করতে এ দিন আহ্বান জানালেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। অসমের সাহিত্য, সমাজ, ইতিহাসে বাঙালিদের অবদানের কথা উল্লেখ করে হিমন্ত বলেন, “ভাষা বাদে দুই সম্প্রদায়ের আর কোনও তফাৎ নেই। আমরা একই সনাতনি সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু যত বাঙালির জন্য পৃথক ব্যবস্থার দাবি তুলব, ততই অসমিয়া ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পাবে।”
হিমন্ত ইতিহাস টেনে জানান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনে মূল ভূমিকা নেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিদ্যালয়ে অসমিয়া মাধ্যম চালু হওয়া ও প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বহু রচনায় অসমের প্রচুর উল্লেখ রয়েছে। গোপীনাথ বরদলৈয়ের নেতৃত্বে অসমে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠনে সুভাষচন্দ্র বসুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “অসমে বাঙালিরা মনে রাখবেন বাংলা এখানে আপনাদের ভাষাগত পরিচয়, জাতিগত নয়। অসমে বাংলাভাষীরা গৌরবের সঙ্গে অসমিয়া জাতির অংশীদার। আপনাদের মাতৃভাষাও শিখতে হবে, অসমিয়া ভাষাও শিখে আপন করে নিতে হবে। বাঙালির সঙ্গে অসমিয়াদের জাতিগত ও ভাষাগত উৎস এক, সামাজিক রীতি ও ধর্মাচরণ এক। আমরা তফসিলভুক্তদের জন্য সুবিধা দিলে তা অসমিয়া ও বাঙালি দুই সম্প্রদায়ের মানুষই সমান ভাবে পাবেন। তা বলে বাঙালির জন্য আলাদা সংরক্ষণ চাইলে, পরিষদ চাইলে তখনই বিভাজন বাড়বে। বাঙালিদের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলার আহ্বান জানাচ্ছি। অসমিয়াদেরও বলছি বাঙালিদের আপন করে নিন।”
হিমন্ত আরও বলেন, এনআরসির বায়েমেট্রিকে শুধু বাঙালির নাম আটকে রয়েছে বলে ভাবা হয়, কিন্তু অসমের কোচ-রাজবংশী ও উজানি অসমের শুদ্ধ অসমিয়া প্রায় তিন লক্ষ মানুষের নামও বাদ পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, যে সব বাঙালিকে প্রতিবেশী দেশ থেকে ধর্মীয় চাপে চলে আসতে হয়েছে তাঁদের সকলকে স্বাগত জানানো উচিত। সিএএ বলবৎ হওয়ার পরে অসম ও ভারতে বাস করা হিন্দু বাঙালির আর সমস্যা থাকবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker