Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story

নীলোৎপল চৌধুরীকে শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ প্রথম দিনেই বলেছিলেন, তুমি আমার মেয়ের মত

//শতাক্ষী ভট্টাচার্য//
আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশনের একজন সদস্য হিসেবে শিলচর যুগশঙ্খ কার্যালয়ে বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা করেছিলাম। আর সেই সুবাদেই তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তখন তিনি দৈনিক যুগশঙ্খের নির্বাহী সঞ্চালক। এই মানুষটার প্রশাসনিক কড়া মনোভাব সম্পর্কে সংবাদজগতে আমার চেনাজানা সাংবাদিকদের কাছে বহুবার শুনেছি। তাই প্রথম একটু দ্বিধায় ছিলাম। গাছ লাগানোর জন্য কি আর তাঁর কাছে সময় থাকবে, বা অনুমতি পাবো কি না, এমন ভাবনা মনে আসছিল বারবার। যাই হোক, সব দ্বিধাকে দূরে সরিয়ে  ফোন করলাম।  দু-তিনবার রিং বাজতেই ওপার থেকে ভাঙা গলায় জবাব এলো ‘হ্যালো’ । আমি আরেকবার কনফার্ম করে নিলাম, ‘নীলোৎপল চৌধুরী স্যার তো?’ জবাব এলো ‘বলছি’।  তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় নিলাম। যথারীতি অফিসে গিয়ে দেখা করলাম। সে-ই প্রথম কথা হল নীলোৎপল চৌধুরীর সঙ্গে। আমি জানতে পারলাম, আমার বাবা প্রয়াত নির্মলকান্তি  ভট্টাচার্য মালুগ্রামের যে বিশিষ্ট চৌধুরী পরিবারের গল্প করতেন, সেই  প্রয়াত চিকিৎসক নলীনাক্ষ চৌধুরীর  ছেলেই নীলোৎপল চৌধুরী। বাবার মুখেই শুনেছি নীলোৎপল স্যারের আন্দোলনমুখী ও শ্রমিকদরদী কাজকর্মের কথা।
সেদিন কথা বলতে গিয়ে বহু গাছের বিষয়ে তাঁকে শুনিয়েছি। এর মধ্যে ওষুধীয় ‘লক্ষীতরু’ গাছ সম্পর্কেও বলেছি। দেখলাম, তিনি সবই জানেন। আমাকে পরখ করার জন্যই আমার মুখ থেকে জানতে চেয়েছিলেন। শেষে  একমাত্র লক্ষীতরু গাছ যাতে যুগশঙ্খে লাগানো হয়, সে ব্যাপারে আমাকে বললেন। পাশাপাশি নির্দেশ দিলেন, ‘আমাকে তুমি স্যার ডাকবে না। কাকু বলবে। তুমি আমার মেয়ের মতো’। সেই প্রথম পরিচয়ে, তাঁর মধ্যে থাকা কয়েকটি সত্বাকে বুঝতে পেরেছিলাম। প্রথমত সাংবাদিক, দ্বিতীয়ত ব্যবসায়িক। প্রকৃত ব্যবসায়ী প্রফিট নিয়ে ভাববেনই। এখানেও অনেক গাছের মধ্যে যে গাছ সবচেয়ে বেশি উপযোগী অথচ কম পরিসরে বেড়ে ওঠে, সেই গাছই রোপণের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। তৃতীয়ত, একজন ভালোমানুষ ও গঠনমূলক ভাবনার কদর। চতুর্থত, অভিবাবক সত্বা। একজন দক্ষ প্রশাসক ও বিজনেসম্যানের পাশাপাশি  অভিভাবক হিসেবে অফুরান স্নেহের ছোঁয়াটাও অনুভব করেছিলাম সেদিন।
সেই থেকেই সাকুল্যে চার বছরের সম্পর্কে একজন পরামর্শদাতা ও অভিভাবক রূপে সবসময় সঙ্গে পেয়েছি।  ‘মিটিং অব মাইন্ডস’ সহ আরও অনেক অনুষ্ঠানে গেছেন। নীলোৎপল কাকুর অভিধানে অসম্ভব বলে কিছু ছিল না। তাঁর জীবনে অনেক কিছু গড়ে তুলেছেন তিনি। অনেক সংগ্রাম করেছেন। বহু সম্মান পেয়েছেন। এই তো প্রায় দুবছর হতে চলল তাঁরই পরামর্শে  যোগ-এর প্রচার-প্রসারের উন্নয়নে ‘নিরাময় ট্রাস্ট’ ও ‘নিরাময় স্কুল অব যোগ’ যাত্রা শুরু করেছে। শহরের কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে তিনি আমাকেও এর সঙ্গে যুক্ত করেন। শুধু তাই নয়, ভরসা দেখিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক পদে আমার নামটা প্রস্তাব করেন। অসুস্থ  ছিলেন। অথচ তাঁর আত্মবিশ্বাস কম ছিল না। তাঁর জন্য যাতে আরেকজনের মনোবল না ভঙ্গ হয়, সেটা খেয়াল রাখতেন খুব। তাই নিজেকে কখনও অসুস্থ বলে মেনে নিতেন না।
নীলোৎপল চৌধুরীর দৃষ্টিভঙ্গি যতটুকু আমি বুঝেছি, মেয়েরা স্বাবলম্বী হোন বা তাঁরা যাতে বিভিন্ন মঞ্চে উন্নতি করেন সেটা খুব চাইতেন। আমাকে লিখে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। লেখা পড়ে কমেন্ট করতেন। দেখা হলে বার বার বলতেন, ‘মনে রাখবে, একজন মেয়ে ইচ্ছে করলে সব দায়িত্ব পালন করতে পারে। কারণ, মা, স্ত্রী, বোন সহ আরও কত সম্পর্কে মেয়েরাই তো কঠিন কঠিন দায়িত্ব সামলাচ্ছে। তাই দায়িত্ব নিতে পিছিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। নিজের ওপর ভরসা রাখবে’। আমি ভাবতাম, হয়তো সাংগঠনিক কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তিনি এই কথাগুলো বলছেন। কিন্তু মনে একটা আলাদা সাহস ও আত্মবিশ্বাসের জোগান দিত এসব কথা। ৭ জুলাই যখন তাঁর মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন থেকে সেই স্বরভাঙা গলার মায়াভরা আওয়াজটাই বারবার কানে ভাসছে, ‘আমাকে তুমি স্যার ডাকবে না। কাকু ডাকবে। তুমি আমার মেয়ের মতো।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker