Barak UpdatesBreaking News
মা-বাবার জীবনযাপন শিশুর হার্টে প্রভাব ফেলে, শেষ সাক্ষাৎকারেও বলে গেলেন ডা. চন্দ্রশেখর দাস—দ্বিতীয় পর্ব
//শতাক্ষী ভট্টাচার্য//
এটা ঠিক, কাগজে কলমে অবসর নিলেও কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার অবকাশ ছিল না ডা: চন্দ্রশেখর দাসের। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেবাধর্মী দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন অবিরাম। চিকিৎসার মাধ্যমে সেবামনস্ক ভাবনা তুলে ধরেছেন। কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। অথচ এই শারীরিক প্রতিকূলতা তাঁকে থামাতে পারেনি। শিশুদের নীরোগ রাখার সঙ্কল্প, সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই চলার পথে তাঁকে যথার্থ প্রেরণা ও সহযোগিতা জুগিয়ে গিয়েছেন তার সহধর্মিণী রীতা দাস, কন্যা লোপামুদ্রা ও পুত্র কুমার।
ডা. চন্দ্রশেখর দাস জন্মসূত্রে বরাকের হলেও ছাত্রজীবন কাটে উপত্যকার বাইরে। ডিগবয় বিবেকানন্দ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। শিলং সেন্ট এডমন্স থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। আসাম মেডিক্যাল কলেজ ডিব্রুগড় থেকে ডাক্তারি পড়া সম্পূর্ণ করেন। পরে নেন পেডিয়াট্রিক-এ এমডি ডিগ্রি।
কর্মজীবন শুরু হয় ওই আসাম মেডিক্যাল কলেজেই। পরবর্তী সময়ে তিনি শিলচর মেডিক্যাল কলেজ ও গৌহাটি মেডিক্যাল কলেজে প্রফেসর পদে ছিলেন। অবসর গ্রহণ করেন শিলচর মেডিক্যাল কলেজ থেকে।
আমার নানা প্রশ্নের সূত্র ধরেই তাঁর জীবনের পথচলার কথাগুলো উঠে আসছিল।
প্রশ্নঃ অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চা খুব মেধাবী। কিন্তু স্কুলে রেসপন্স করছে না। পরীক্ষায় লিখছে না, ভালো করে উত্তর দিতে পারছে না। সবাই খুব হতাশ তাকে নিয়ে। এটা কেন হয়।
ডা. সিএস দাস: হ্যাঁ, এরকম হয়ে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটাকে বলে ‘Writing dyslexia’ ও ‘speech dyslexia। Writing dyslexia থাকলে একটি শিশু ঠিকঠাক বলতে পারবে কিন্তু লিখতে গিয়ে ওর অসুবিধে হবে। আবার speech dyslexia থাকলে লিখতে তার কোনও সমস্যা হবে না। তবে বুঝিয়ে ও গুছিয়ে সে কিছু বলতে পারবে না। এরকম পরিস্থিতিতে সেই শিশুকে সহযোগিতা করতে হবে। শিক্ষক ও অভিভাবকের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার সাথে কঠোর ব্যবহার মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। ধৈর্যহারা হলেও চলবে না। চিকিৎসকের সুপরামর্শ নিয়ে এধরনের ছেলেমেয়ের কাউন্সেলিং খুব দরকার।
প্রশ্নঃ সেরিব্রাল পালসি কী? এই রোগের লক্ষণ কী হতে পারে? এ ব্যাপারে যদি কিছু বলেন…
ডা. সিএস দাস: মস্তিষ্কের যদি সঠিক বিকাশ না হয়, তখন বুঝতে হবে এরকম কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। মূলত এই রোগ পুরো নার্ভ সিস্টেমকে অকেজো করে দেয়। এই রোগের লক্ষণ একেক জনের এক এক রকমের হয়। কারও কথার মধ্যে জড়তা দেখা দেয়, কারও অঙ্গবিকৃতি ঘটে। শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠে না কেউ কেউ। এই রোগ জন্মগত হতে পারে। আবার জন্মের পরও হতে পারে।
প্রশ্নঃ এখন প্রায়ই শিশুর থাইরয়েড সমস্যা অভিভাবকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এর সমাধান কী হতে পারে?
ডা. সিএস দাস: প্রতিটি শিশুর থাইরয়েড স্ক্রিনিং করে নেওয়া দরকার আগে থেকেই। তবে জন্মের দিনই নয়। চার-পাঁচদিন পর করে নেওয়া জরুরি। আমরা ঠিকমতো কনজিনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজম নির্ণয় না করলে ভবিষ্যতে শিশুর শরীর দুর্বল হতে পারে। গলার সুর কর্কশ হতে পারে। তাছাড়া, স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সমস্যা থাকবে। এককথায়,স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। জন্মগত থাইরয়েড গ্রন্থি যদি ঠিকভাবে কাজ না করে শিশুদের মস্তিষ্ক বৃদ্ধি হয় না। ফলে থাইরয়েডের মেডিসিন খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত রক্ত পরীক্ষাও করাতে হবে।
প্রশ্নঃ শিশুদের ভ্যাকসিন্যাশন নিয়ে কিছু বলুন।
ডা. সি এস দাস: ভ্যাকসিন্যাশন খুব দরকার। হুফিং কফ, হাম, পলিও, টিবি ইত্যাদি রোগ থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য গুরুত্ব রয়েছে ভ্যাকসিন্যাশনের। আরেকটা কথা, ঋতু পরিবর্তনের প্রভাবে দাস্ত, বমি এমন কিছু রোগ হয়ে থাকে শিশুর। তখন বাচ্চাকে ফ্লুইড জাতীয় জিনিস খাওয়াতে হবে। আজকের দিনে এক্ষেত্রে ওআরএস খুব কাজে আসছে। প্রস্রাবের কোনও সমস্যা থাকলে ‘আল্ট্রা সাউন্ড এবডোমিন’ করিয়ে নেওয়া দরকার। কোনও মায়ের যদি প্রেগন্যান্সির সময় পেটে জল কম থাকে তাহলেও আল্ট্রা সাউন্ড করে দেখতে হবে শিশুর কোনও সমস্যা আছে কি না। পরামর্শ নিতে হবে চিকিৎসকের।
প্রশ্নঃ শিশুর হার্টের রোগ সারাতে কী ধরনের সতর্কতার দরকার?
ডা. সিএস দাস: শিশুর হার্টের সমস্যার পেছনে মা-বাবার জীবনযাপনের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। যত বেশি আমাদের আর্থিক সমৃদ্ধি হচ্ছে, তত বেশি ফ্যাট জাতীয় খাবারের চাহিদা বাড়ছে। নিজেরাও খাচ্ছি, ছেলেমেয়েরাও দাবিমত পেয়ে যাচ্ছে। চাইলেই ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খাওয়ার জন্য টাকা পাচ্ছে অভিভাবকদের কাছ থেকে। এতে ফ্যাট বেড়ে বয়সের তুলনায় মোটা হয় ছেলেমেয়ে। ওবেসিটিও বাড়ে। ফলে এটি হার্টের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেখা দিতে পারে অন্যান্য রোগের উপসর্গও। অন্যদিকে অতিরিক্ত টিভি দেখা বা পড়াশোনায় বেশি মজে থাকাও ভাল নয়। এতে রক্তচাপ বৃদ্ধি সহ হার্টের রোগ হতে পারে। এসব থেকে রক্ষা পেতে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াও রোজ ৩০ থেকে ৪০ মিনিট যোগাসন, খেলাধূলা ইত্যাদি বাচ্চাদের জন্য খুব ফলদায়ক। আসলে, বাচ্চার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মা-বাবাকে বিয়ের আগে থেকেই ভাবা জরুরি। তাই, বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো প্রিম্যারেজ স্ক্রিনিং করিয়ে নিলে খুব ভাল।
প্রশ্নঃ শিশুদের খাবারের তালিকা সাধারণত কীরকম হওয়া দরকার?
ডা. সি এস দাস: খাবারের বিষয় আসলে প্রথমেই মায়ের দুধ। এই দুধ ২ বছর বয়স অবধি একটি বাচ্চা খেতে পারে। তবে শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় মাকে চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। আরাম করে শুয়ে বা বসে খাওয়াতে হবে দুধ। তাছাড়া, ৬ মাস পর থেকেই একটি বাচ্চাকে স্বাভাবিক খাবার দেওয়া দরকার। অন্নপ্রাশন হয়ে গেলেই আলাদা থালা বেড়ে দেওয়া উচিত বাচ্চার জন্য। মিক্সিতে খাবার পেস্ট করে দেওয়ার দরকার নেই। স্বাভাবিকভাবেই বেশি সেদ্ধ করে পায়েসের মতো বাড়ির তৈরি সব খাবারই একটু একটু বাচ্চাকে দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
শিশুদের মোবাইল ও টিভি থেকে দূরে রাখার ওপরে সেদিন কড়া ফরমান ছিল সি এস দাস স্যারের। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, ডা. চন্দ্রশেখর দাসের কাছ থেকে জানার শেষ ছিল না।জিজ্ঞাসারই-বা শেষ কোথায়। স্যারের সঙ্গে কথা বলার সময় পাওয়াটাও ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। আর সে সৌভাগ্যটা আমার হয়েছিল। ‘ডাক্তারবাবু সেদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমরা শিক্ষা গ্রহণ করছি ঠিকই। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তার প্রতিফলন সমাজে পড়ছে না। শিক্ষার এই মান আরও উন্নত হতে হবে। কিছু প্রথাগত সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মুক্ত করতে হবে সমাজকে। না হলে আমাদের শিশুরা অকালেই ঝরে যাবে। আর এর দায় থাকবে আপনার, আমার, সবার ওপর।’