India & World UpdatesHappeningsBreaking News

স্মৃতিচারণায় সুস্মিতা দেবঃ দুঃখ প্রকাশের জায়গাটাও চলে গেল!

//সুস্মিতা দেব//

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্কটা অন্যরকম ছিল। রাজনীতির সূত্রে বটে, কিন্তু তা বহু আগেই রাজনীতির ঊর্ধ্বে চলে যায়। বলা যায়, পারিবারিক বন্ধনে পরিণত হয়েছিল। আজ আমার অনুভূতি তাই ভাষায় প্রকাশের নয়। আমার মনে হচ্ছে, আবারও পিতৃহারা হলাম। বাবাকে হারিয়ে সে দিন যে অনুভূতিটা হয়েছিল, আজ ওই একই অবস্থা। বাবার মৃত্যুর পর তিনি বারবার আমার খবর নিয়েছেন। যখনই হতাশ বোধ করতাম, এতদিন তা প্রকাশের একটা জায়গা ছিল। ব্যক্তিগত হতাশা কি রাজনৈতিক চাপ, মন দিয়ে শুনতেন। পরে বলতেন, ‘কাজে মন দে, হতাশা চলে যাবে।’ কিছুদিন আগেও বলছিলেন, ‘দল তোকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে, ওই দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন কর, ব্যস।’

প্রণব মুখার্জিকে যখন আমি প্রথম দেখেছি, তখন খুব ছোট, স্কুলে পড়ি। ধুতি-কুর্তা আর মুখে পাইপ। বাবাও তখন পাইপ খেতেন৷ আমাদের বাড়িতে যখন আসতেন, সেই আশির দশকের গোড়ার দিকে, অনেকক্ষণ ধরে দুইজনে মিলে গল্প করতেন। একেবারে সাধারণ মানুষটি যেন!

আজ এই সময়ে কত কথা যে মনে পড়ছে। তিনি যখন ভারতরত্ন পেলেন, সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য শুধু পরিবারের সদস্যদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়৷ তিনি আমার নাম দিলেন। আমি ও আমার বোন গিয়েছিলাম৷ তিনি যে প্রকৃতই আমাকে নিজের মেয়ে বলে ভাবতেন!

তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিচারণের দিনটা এখনও আমার চোখে ভাসছে। শর্মিষ্ঠা, দাদা সবাই বসে আছেন। তাঁদের মায়ের ছবির সামনে বসে গান হচ্ছে৷ বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল। প্রণববাবু পুরো দুইঘণ্টা বসে রইলেন, গান শুনলেন, সকলের সঙ্গে কথা বললেন। আমি ও মা গিয়েছিলাম। এমন উঁচুমাপের মানুষটিকে মাটির কাছাকাছি দেখেছিলাম সেদিন। তিনি প্রকৃতই এক কিংবদন্তী। তাঁর এমন গুণ ছিল যা সকলের অনুকরণীয়। যখন দলের শীর্ষনেতাদেরও অন্যতম তিনি, তখনও তরুণদের কথা শুনতেন। বিভিন্ন সময় তাঁর এই বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করেছে।

প্রথম যখন এমপি হয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি, তিনি তখন রাষ্ট্রপতি। বললেন, ‘তোর বক্তৃতা শুনি আমি। ভাল বলিস, ভেরি গুড।’ ভাবা যায়, প্রণব মুখার্জি বলছেন, তুই ভাল বক্তৃতা করিস! আমার যে সেদিন কী প্রাপ্তি ঘটেছিল!

আমি কখনও ভুলতে পারব না, প্রণববাবু আমার বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে এসেছিলেন। বাবা ফোন করেছিলেন। তিনি চলে এলেন। গোপীনাথ হলে সভা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা সন্তোষবাবুকে হারিয়ে ভুল করেছেন। এখন তাঁর মেয়েকে জিতিয়ে তাকে কাজ করার সুযোগ দিন।’

আবার শর্মিষ্ঠা যখন দিল্লিতে ভোটে দাঁড়াল, প্রণববাবু একদিন আমাকে ফোন করলেন। আমি তখন শিলচরের বিধায়ক। একজন প্রথমে বললেন, ‘ম্যাডাম, রাষ্ট্রপতি আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’ আমি ভাবলাম, কী হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘বাবার কী খবর?’ বাবা তখন অসুস্থ। শর্মিষ্ঠার ভোটে দাঁড়ানোর কথা বললেন।  বললেন, ‘আমি তো তোর বাবাকেই বলতাম, তিনি যখন পারবেন না, তুই আয়। শর্মিষ্ঠা তো নতুন। তুই এসে কাজ করে যা।’

আমার মনে আছে, শেখ হাসিনা যখন ভারতে এলেন, তাঁর সম্মানে রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজ হয়েছিল। প্রণববাবু আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। গিয়েছিলাম, হঠাৎ আমাকে ডেকে শেখ হাসিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। একজন সাধারণ সাংসদ ওই ধরনের অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় আমন্ত্রিতের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, একেবারে ভাবা যায় না। সেটা সম্ভব হয়েছিল প্রণববাবুর জন্য।

আরও একটা জিনিস আমার খুব আকর্ষণীয় ঠেকে। তিনি নিজের হাতে ডায়েরি লিখতেন। নিয়মিত। ওটা আবার কাউকে দিয়ে নয়, বা মোবাইল ল্যাপটপেও নয়। ওই বয়সেও নিজের হাতে লিখতেন।

একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। তিনি খাচ্ছিলেন আর আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। বিজেপি, কংগ্রেস ইত্যাদি প্রসঙ্গ চলে এল। তিনি বললেন, ‘যে দল যা রাজনীতিই করুক, তোমরা মনে রাখবে, কংগ্রেস সংবিধান প্রণয়ন করেছে। ওই সংবিধান থেকে তোমরা সরো না। এটা খুব মুশকিল রাস্তা বটে, কিন্তু একে তোমাদের ধরে রাখতে হবে। এ পথ থেকে সরে যাওয়ার কথা কখনও ভাববে না।’ কী মূল্যবান কথা!

এই সব কত কথা আজ খুব করে কানে বাজছে। তাঁর মৃত্যু আমার বিরাট লোকসান তো বটেই, দেশও একজন অভিভাবক হারাল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker