India & World UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
রাহুল গান্ধীর পদযাত্রায় কংগ্রেসের ভাগ্য কি ফেরানো সম্ভব, লিখেছেন রঞ্জন কুমার দে
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। মোদির হিন্দুত্ব কার্ডে ২০১৪-র পর থেকেই ক্রমশঃ বিপর্যস্ত হতে হতে কংগ্রেস এখন মাত্র দুইটি রাজ্যে মিটমিট করে জ্বলছে। দলের প্রতি আস্থা হারিয়ে তাবড় তাবড় কংগ্রেসি সিনিয়র নেতাদের দল ছাড়ার হিড়িক লেগে আছে৷ ধর্মনিরেপক্ষ আঞ্চলিক দলগুলোও এমনভাবে গুঁটি সাজিয়ে রেখেছে যে, কংগ্রেস কোনও ভাবেই বিজেপির বিকল্প দাবি করতে পারছে না। এমনকী পশ্চিমবঙ্গ, আসাম সহ গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল, উত্তরপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতিতে কংগ্রেসের নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা দুষ্কর হয়ে উঠেছে।
ধারাবাহিক লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভায় ধরাশায়ী হয়ে তর্জনী কংগ্রেস নেতৃত্ব তথা গান্ধী পরিবারমুখী৷ এই অবস্থায় যুবরাজ রাহুল গান্ধী ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই দলের অধ্যক্ষ পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে আর দায়িত্ব নিতে রাজি নন৷ একাধিক যোজনা, ফর্মুলা যখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে ঠিক তখনই দলকে পুরো দেশজুড়ে চাঙ্গা করতে রাহুল গান্ধী সবচেয়ে পুরনো অভিনব পন্থা পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নাম দিয়েছেন, “ভারত জুড়ো যাত্রা”।সেখানে বিভিন্ন রকম স্লোগান স্থান পেয়েছে৷ সেগুলির মধ্যে “নফরত ছুড়ো, ভারত জুড়ো”, “কদম মিলে বতন জুড়ে” প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ।কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ১৫০ দিনের এই পদযাত্রা প্রায় দীর্ঘ ৩৫৭০ কি.মি বিস্তীর্ণ থাকবে, তবে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে বিবেচনা করে কৌশলগতভাবে কংগ্রেস তাঁদের এই যাত্রা গুজরাট এবং হিমাচলে প্রবেশ করাবে না। রাহুল গান্ধীর এই পদযাত্রা সাংগঠনিকভাবে সাফল্য কিংবা আসন্ন নির্বাচনে ভোটবাক্স ফুলে ফেঁপে উঠবে কিনা, তা সময়েই বলবে৷ তবে অতীতে এইরূপ রাজনৈতিক গণজাগরণের চেষ্টা টনিক হিসাবে কাজ করেছে। লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা বা চন্দ্রবাবু নাইডু এবং জগনমোহন রেড্ডির পদযাত্রায় যথেষ্ট সাফল্য পাওয়া গিয়েছিল৷ যাই হোক , রাহুল গান্ধীর এই ভারত জুড়ো আন্দোলনের আরেকটি মুখ্য উদ্দেশ্যে হলো, দলের মৃতপ্রায় সংগঠন শক্তিকে চাঙ্গা করে তৃণমূল স্তরের কর্মীদের মধ্যে প্রাণচঞ্চলতা ফিরিয়ে আনা।
রাহুল গান্ধীর এই যাত্রা নিয়ে বিরোধী এবং মিত্র শিবিরও যে যার মতো করে মন্তব্য করছে। প্রাক্তন কংগ্রেসি তথা আসামের হিন্দু ফায়ার ব্র্যান্ড মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলেন, কংগ্রেসের উচিত ভারত জুড়ো যাত্রা পাকিস্তান থেকে শুরু করা৷ কারণ কংগ্রেসের কারণেই দেশভাগ হয়েছে। কেরলে পিনারাই বিজয়ন নেতৃত্বাধীন সিপিএম রাহুল গান্ধীর এই পদযাত্রা মোটেও ভালোচক্ষে নেয়নি৷ তবে দক্ষিণের তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন রাহুল গান্ধীর এই যাত্রাকে সবুজ পতাকা দেখিয়ে তাকে নিজের ভাই বলে সম্বোধন করেন। রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেসের অভিযোগ, গেরুয়া শিবির মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রয়োগ করে রাহুলকে অপরিপক্ক, হাস্যরসাত্মক, কার্টুনরূপে পরিবেশন করছে এবং তারা এই ক্ষেত্রে সাফল্যও পাচ্ছে। রাহুলকে নাকি সংসদে কথা বলারও পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না , তাই রাহুল গান্ধী এই পদযাত্রাকেই জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসাবে মনে করছেন।তাঁর এই পদযাত্রায় রাহুল গান্ধী কখনো বৃষ্টিতে ভিজে ভাষণ দিচ্ছেন,কখনো মা সোনিয়া গান্ধীর পায়ের জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছেন বা হিজাব পরিহিতা কোন মেয়েকে বুকে টেনে আনছেন। এই সময়ে সাংবাদিকদের ছোঁড়া বিভিন্ন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিচ্ছেন, কিংবা সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যাচ্ছেন। একটা জিনিস খুব লক্ষণীয়, রাহুল গান্ধী তাঁর ভারত জুড়ো যাত্রায় আক্রমণের তীর ছুঁড়ছেন বিজেপি-আরএসএসের দিকেই, অন্য কোনও রাজনৈতিক দল নিয়ে টুঁ শব্দ নেই।
রাহুল গান্ধী হয়তো কংগ্রেসকেই বিজেপির প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন, কিন্তু বাস্তব ভিন্ন কথা বলছে।বিশেষত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় সবাই নিজেদের ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্ধী ভেবে নিজেদের করে গুটি সাজাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি বিজেপির বিজয়রথ একাই আটকে দিয়ে বিজেপির অন্যতম বিকল্পের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন৷ কংগ্রেসের তাবড় তাবড় সিনিয়র নেতাদের যোগদান করিয়েছেন তৃণমূলে। প্রথমে বেশ কয়েকবার অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মমতার তৃতীয় ফ্রন্টের জল্পনা অনেকটা তুঙ্গে ছিল৷ কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁর আর তৃতীয় জোটে আস্থা নেই। বরং একাই আগামী লোকসভা নির্বাচন লড়তে চান এবং কাকতলীয় ভাবে হলেও তিনি এখন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং আরএসএসের প্রতি তুলনামূলকভাবে অনেকটা নমনীয়। এদিকে অরবিন্দ কেজরিওয়ালও পাঞ্জাব বিজয়ে জাতীয় রাজনৈতিক সমীকরণের নতুন মাত্রা জুড়ে দিয়েছেন৷
আসন্ন হিমাচল এবং গুজরাট নির্বাচনে আপ পার্টি পাখির চোখ করে আছে। কেজরিওয়াল গুজরাট সফরে মোদি শাহকেই বারবার টার্গেটে রাখছেন এবং সফ্ট হিন্দুত্বের কার্ডে তিনি নিজেকে এখন কৃষ্ণের বংশজ দাবি করছেন৷ তাই আপ যদি এই দুটি রাজ্যে সামান্যতম চমক পাঞ্জাবের মতো নিয়ে আসতে পারে, তাহলে স্বভাবতই ২৪-এর জাতীয় নির্বাচনে কেজরিওয়াল বিরোধীদের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠে আসবেন। তেলেঙ্গানা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কেসিআর প্রধানমন্ত্রিত্বের মোহে নিজের পার্টি তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির নামকরণ করেছেন ভারত রাষ্ট্র সমিতি। এনসিপির শারদ পাওয়ার কিংবা শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরেও নিজেদের পছন্দের প্রধানমন্ত্রীর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ শূন্য আসনের মায়াবতীও মহাদলিত ভোটের দোহাইয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থিত্বের দাবিদার। বিহার, ইউপিকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের পাটিগণিত অসমাপ্ত৷ আর সেখান থেকে সুশাসক নীতিশবাবু বিজেপি ত্যাগ করে দিল্লিতে তৃতীয় মোর্চার চরম কুচকাওয়াজ শুরু করে দিয়েছেন। আরজেডির তেজস্বী প্রসাদ যাদব চাচা নীতিশ কুমারকে দিল্লিতে পাঠিয়ে পাটনাতে চুকিয়ে রাজপাট করার বাসনা অনেক আগেই সর্বজনীন করে রেখেছেন। উত্তরপ্রদেশের সপা কার্যালয়ের সামনে বড় বড় হেডিংয়ে ঝুলছে, “ইউপি + বিহার = গেলো মোদি সরকার”, অর্থাৎ নীতীশ কুমারে অখিলেশদের কোন আপত্তি নেই।
প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক বিপক্ষ জোট ঘোর মোদি বিরোধিতায় রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস শিবিরকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের দবদবা কায়েম করতে চাইছে৷ কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আদৌ কি তা সম্ভব! মমতা ব্যানার্জির পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে মাত্র ৪২টি লোকসভা আসন৷ গত নির্বাচনে বিজেপির অনুকূলে গিয়েছে ১৯টি। নীতীশ কুমারের বিহারে রয়েছে মোট ৪০টি লোকসভা আসন, ইউপিতে রয়েছে সর্বোচ্চ ৮০টি, শারদ পাওয়ারের মহারাষ্ট্রে রয়েছে ৪৮টি, কেসিআরের তেলেঙ্গানায় রয়েছে ১৭টি লোকসভা আসন। এই সবগুলো আসন যদি একসঙ্গে জড়ো করা যায়, তথাপিও আঞ্চলিক দলগুলো ম্যাজিক ফিগার ২৭২-এ পৌঁছতে পারছে না। মমতা ব্যানার্জি, তেজস্বী, অখিলেশদের নিজের রাজ্যের বাইরে একটাও লোকসভা আসন নেই বা তাঁদের সেখানে তেমন কোন গ্রহণযোগ্যতাও নেই। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পটভূমি নিঃসন্দেহে ২০১৯ নির্বাচন থেকে অনেকটা ভিন্ন মেরুতে। ১৯-এ অবশ্যই মোদি আমেজে নীতীশ কুমার, উদ্ধব ঠাকরেরা বিজেপির সঙ্গে মিত্র জোটে অতিরিক্ত আসন জিততে পেরেছিলেন, কিন্তু এইবার তাঁদের ভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল কি মোড় নেয় সেটা সময়ই বলবে! মহারাষ্ট্রে একনাথ সিন্ধে জোটের সঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক সমীকরণ যদি আগামী লোকসভা নির্বাচনে সাফল্য নিয়ে আসতে পারে, তাহলে উদ্ধবের শিবসেনার অস্তিত্ব হয়তো মিটে যেতে পারে।
গত লোকসভায় উত্তরপ্রদেশে সপা, বসপা, আরএলডির যৌথ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিজেপি আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৮০-তে ৬২ করতে পেরেছিল৷ এ অবস্থায় সপার গড় আজমগড়, রামপুরের উপনির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে মুলায়মবিহীন সপা হিন্দুত্ববাদী ফায়ার ব্র্যান্ড যোগীকে কতটুকু চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে !গেরুয়া শিবিরের কপালেও ভাঁজ পড়েছে কারণ এবার এনডিএর অন্যতম পুরাতন জোটসঙ্গী শিবসেনা, জেডিউ, শিরোমণি অকালি দলবিহীন তাঁরা ভোটের ময়দানে লড়তে যাচ্ছে। তাই খোদ অমিত শাহ উত্তরপ্রদেশ,বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, ছত্তিশগড়ের ১৪৪টি লোকসভা আসনে পাখির চোখ রেখে রণনীতি নিজের হাতে সাজাচ্ছেন।আসন্ন হিমাচল, গুজরাট, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনেই দেশের জনগণের মতিগতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রধানমন্ত্রী মোদির কংগ্রেসমুক্ত ভারতের স্লোগান আজকের দিনে যথেষ্ট সামঞ্জস্য, আঞ্চলিক বিরোধীদলগুলিও একই উপসর্গে ভুগছে। কংগ্রেসবিহীন বিরোধী জোট কোনভাবেই খাপ খাচ্ছে না, আর কোনও দলও মিত্রগোষ্ঠীর জন্য একইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নয়। এখন রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জুড়ো যাত্রা’ সঞ্জীবনী হয়ে বিরোধী শিবিরের ভোট ভাগাভাগিতে ছেদ ধরাতে না পারলে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন আবার বিজেপির জন্য কেল্লাফতে।