Barak UpdatesHappeningsSportsBreaking NewsFeature Story

দ্বিবিজা : প্রত্যাশার বাতিঘর, লিখেছেন প্রণবানন্দ দাশ

//প্রণবানন্দ দাশ//

খেলাধূলা থেকে কিছুদিন হল কার্যত স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছি। এখন আর ময়দানে আমার যাওয়া হয়ে ওঠে না। কোনও অভিমানে নয়, একেবারেই পরিকল্পনা মতো। তিন দশকেরও বেশি সময় খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। প্রথমে টেবিল টেনিস খেলতাম, তারপর সংগঠনের কাজে। মনে হয়েছিল, জীবনে যে কোনও ক্ষেত্রেই একটা সময় এসে থামতে হয়। অনাদি-অনন্তকাল ধরে আঁকড়ে থাকা যায় না, উচিতও নয়। ফলে আমার আবেগ, ঘাম-রক্তের সঙ্গে থাকা টেবিল টেনিস ক্লাবের দৈনন্দিন কাজ থেকে যেভাবে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি, ঠিক একইভাবে শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থা সহ ময়দানের অন্যান্য বৃত্ত থেকেও আজ আমি অনেকটাই দূরে।

শিলচর থেকে কিলোমিটার দশেক দূরে গত শতকের নয়ের দশকের একেবারে শুরুতে আমরা জনাকয়েক যখন টেবিল টেনিস খেলতে শুরু করেছিলাম, তখন এই উপত্যকায় খেলাটির প্রচলন খুব একটা ছিল না। বছরে দু-একটা টুর্নামেন্ট হতো। টাউন ক্লাবে একটা বোর্ড ছিল। আর পাশের অফিসার্স ক্লাবে একটা। নিয়মিত অনুশীলন সেখানে হত না। ওই শখের খেলা চলতো। আটের দশকে শিলচরে কিছুটা চর্চা থাকলেও পরবর্তীতে তা কিছুটা থিতিয়ে যায়। সম্ভবত এই খেলাটি নিয়ে তখন ক্রীড়া মহলে তেমন আগ্ৰহ না থাকার ফলেই, এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

নয়ের দশকের উধারবন্দের সঙ্গে আজকের উধারবন্দের মিল খুঁজে পাবেন না। যেমনটা হয়, ছোট জনপদের পরিসর-পরিকাঠামো বেড়েছে, নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠেছে, বাইরের প্রচুর মানুষ নিজেদের ঠিকানা করে নিয়েছেন৷ ফলে সব দিক দিয়েই স্বাভাবিক নিয়ম মেনে বদলে গিয়েছে শিলচর-কুম্ভিরগ্ৰাম বিমানবন্দরের ঠিক মাঝখানে থাকা এই জনপদটি। সেসময় উধারবন্দের পরিচিতি ছিল মা কাঁচাকান্তির মন্দিরকে ঘিরেই।

ফলে এমন একটা আধা গ্ৰাম, আধা মফস্বলে টেবিল টেনিসের মতো আপাত শহুরে খেলার চর্চা করা অনেকের কাছেই বিস্ময়ের ছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে টেবিল টেনিস ক্লাবের আত্মপ্রকাশ হল। অনেকে তখন আমাদের উন্মাদ ভাবতেন। এমন একটা খেলা, যার কোনও জনপ্রিয়তা নেই, পরিচিতি নেই৷ তাকে ঘিরে আস্ত একটা ক্লাব বানিয়ে ফেলা! কয়েকদিনের হুজুগ বলে অনেকেই তখন ঝেড়ে ফেলেছিলেন।

কিন্তু আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম। একদিন নিজেদের ক্লাব হবে, ক্লাবে নতুন টি টি বোর্ড বসবে, আমাদের খেলোয়াড়েরা জেলার সেরা হবে। ধীরে ধীরে এসব স্বপ্ন চোখের সামনে সাকার হতে দেখলাম। আর সেইসঙ্গে স্বপ্নের বৃত্তও আরও বড় হতে লাগল। নিজেদের ইন্ডোর স্টেডিয়াম হবে, জাতীয়- আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নামি প্যাডলাররা এখানে এসে খেলবেন, আমাদের নিজস্ব অ্যাকাডেমি হবে, আমাদের প্যাডলাররা রাজ্য ও জাতীয় সার্কিটে দাপিয়ে বেড়াবে…. এইসব অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

এতটা বছর পর, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অকপটে এটা স্বীকার করে নিতে চাইছি, এভাবে যে চোখের সামনে একে একে সব দুঃসাহসী স্বপ্ন বাস্তবে বদলে যাবে, তা আমি নিজে কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি। এই সময়ে যা আমরা চেয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি পেয়ে গিয়েছি। নিজেদের ইন্ডোর স্টেডিয়াম হয়েছে। ছয়টি বোর্ড বসিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। অসমের ক্রীড়া জগতে প্রথমবার স্ট্যাগ ইন্টারন্যাশনাল-এর মতো বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে টি টি অ্যাকাডেমি আমরা চালিয়েছি টানা তিন বছর। এখন এটা আমাদের নিজস্ব অ্যাকাডেমি হয়েছে। আমাদের পার্থপ্রতীম দেব আইটিটিএফ লেভেল টু এবং সঞ্জীব শর্মা আইটিটিএফ লেভেল ওয়ান সার্টিফায়েড কোচ হয়েছেন। অরূপ বসাক, কাঞ্চন ধাওয়ান, সৌম্যজিৎ রায়ের মতো আন্তর্জাতিক তারকা প্যাডলাররা এখানে এসে খেলে গিয়েছেন। অভিজিৎ রায়চৌধুরীর মতো জাতীয় প্রশিক্ষক এখানে এসে বেশ কয়েকবার প্রশিক্ষণ দিয়ে গিয়েছেন। রাজ্যস্তরে আমাদের প্যাডলাররা বেশ কয়েকটি খেতাব ছিনিয়ে এনেছেন। কিন্তু একটা স্বপ্নই এতদিন অধরা ছিল।

৯ ডিসেম্বর, ২০২৩৷ সেই অধরা স্বপ্নও বাস্তব করে দেখালো ছোট্ট দ্বিবিজা পাল। এই দিনটি শুধু টেবিল টেনিসের জন্যই নয়, বরাক উপত্যকার ক্রীড়া ইতিহাসের জন্য সত্যিকার অর্থেই এক সোনার দিন। কারণ কোনও ব্যক্তিগত ইভেন্টে এর আগে উপত্যকার আর কোনও অ্যাথলিট দেশের সেরা হতে পারেনি। হরিয়ানার পাঁচকুলায় জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় অনূর্ধ্ব এগারো ক্যাটেগরিতে দেশের সেরা প্যাডলারদের হারিয়ে সেই অনন্য কীর্তিই স্থাপন করল শিলচরের দ্বিবিজা।

এটা শুধু আমার বা আমাদের জনাকয়েকের স্বপ্ন যে ছিল, তা কিন্তু নয়। শিলচরে যারা গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে টেবিল টেনিসকে ভালোবেসেছিলেন, এটি তাঁদেরও স্বপ্ন সাকার হওয়া। এটি সারা রাজ্যের টেবিল টেনিসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রতিজনের স্বপ্ন সফল হওয়া। দ্বিবিজার সাফল্যের পর রাজ্যের টেবিল টেনিস মহল যেভাবে সমস্বরে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছে, তাতে আরও একবার প্রমাণ হল, খেলাই পারে সব প্রাচীরকে নিমেষে ভেঙে চুরমার করে দিতে।

মাঝের এই ক’বছরে উধারবন্দের সঙ্গে সঙ্গে শিলচর শহরে টেবিল টেনিসের চর্চা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ইউনাইটেড ক্লাব অ্যাকাডেমি করে নিয়মিত অনুশীলন, প্রতিযোগিতার আয়োজন করে চলছে। মাঝে ইন্ডিয়া ক্লাবেও নিয়মিত অনুশীলন শুরু হয়েছিল। টাউন ক্লাব গত কয়েক দশক ধরে একেবারে রুটিন প্রতিযোগিতা আয়োজন করে যাচ্ছে। শিলচরের অভিনব ক্লাবও ইদানিং টি টি প্রতিযোগিতা করছে। আর শিলচর ডিএসএ তো গত কয়েকবছর ধরেই অ্যাকাডেমি চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত রাজ্য স্তরে জেলার প্যাডলারদের মঞ্চ করে দিচ্ছে শিলচর ডিএসএ।

তবে আমি বলব, টেবিল টেনিসে এই দুর্দান্ত সাফল্যের নেপথ্যে প্রধান দুই বিন্দু হচ্ছেন কোচ এবং প্যাডলারদের অভিভাবকেরা। পার্থপ্রতিম ও সঞ্জীব ছাড়াও শিলচরে এখন আরও তিনজন সার্টিফায়েড কোচ রয়েছেন। তাঁরা হচ্ছেন, শিলচর ডিএসএ-র পার্থ দেব ও শুভাশিস চক্রবর্তী। আর ইউনাইটেড ক্লাবের নিতাই পাল। নিজেদের মতো করে প্যাডলার গড়ার কাজে তাঁরা ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছেন। একজন খেলোয়াড় গড়ার ক্ষেত্রে আজকালকার সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে অভিভাবকদের। একদিকে যে কোনও খেলাই ব্যয়সাপেক্ষ। অন্যদিকে এই পর্যায়ে খেলতে হলে পড়াশোনার সঙ্গে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়। শিলচর-উধারবন্দের প্যাডলারদের অভিভাবকেরা সেই কাজটা করে যাচ্ছেন আন্তরিকতার সঙ্গে। তাঁদের ত্যাগ ও নিষ্ঠা এই সাফল্যের অন্যতম বিন্দু।

উপত্যকার খেলাধুলার মানচিত্রে টেবিল টেনিস এখন মূলস্রোতের অংশ। এর জন্য স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের অবদান সবচেয়ে বেশি। একেবারে শুরু থেকেই উপত্যকার ক্রীড়া সাংবাদিকরা টেবিল টেনিসকে যে গুরুত্ব দিয়ে কভার করেছেন, তাতে এই খেলাটির প্রতি মানুষের উৎসাহ বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। পশ্চিমবঙ্গ (শিলিগুড়ি ব্যতিক্রম) বা গুয়াহাটি ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমে কিন্তু টেবিল টেনিস এই জায়গা পায়নি, তা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি।

ফিরে আসছি একেবারে শুরুর কথাগুলোতে। খেলাধূলার জগত থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার এই মুহূর্তে দ্বিবিজার অসাধারণ সাফল্য আমার জন্য পরম তৃপ্তির। কিছুদিন আগে একটি কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই অতৃপ্তি থেকে যাওয়ার আক্ষেপ করেছিলাম। দ্বিবিজা আমার সেই না পাওয়ার আক্ষেপকে মিটিয়ে দিল। এক জীবনে এত এত স্বপ্ন পূরণ ক’জনের ভাগ্যে জোটে! সেক্ষেত্রে আমি পরম ভাগ্যবান। তবে শেষে একটা কথাই বলব, দ্বিবিজা প্রতিভার একটা স্ফুলিঙ্গ। তাঁকে জ্বলতে দিতে হবে। হরিয়ানার পাঁচকুলায় খেতাব তো মাত্র শুরু। অনূর্ধ্ব এগারোর পর আসল চ্যালেঞ্জ তো সামনে। বয়সভিত্তিক ইভেন্ট সেরে দ্বিবিজা একদিন দেশের হয়ে অলিম্পিকে অংশ নেবে, এই আশা তো আমাদের জিইয়ে রাখতে হবে। আর তা করতে হলে সরকার, সংগঠন, খেলার সঙ্গে জড়িত সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পত্রিকায় অভিনন্দন বার্তা, স্টেশন বা বিমানবন্দর থেকে একদিন হই হই করে মাথায় তুলে ঘরে নিয়ে আসা অথবা ঘটা করে সংবর্ধনা দিয়ে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এতে নিজেদের ছবি পরেরদিনের কাগজে দেখা যায়। দ্বিবিজাদের কোনও উপকারে আসে না। দ্বিবিজার মতো অ্যাথলিটদের চাই সিরিয়াস প্রোফেশন্যাল প্রশিক্ষণের। সেটা করতে পারে রাজ্য সরকার। দ্বিবিজাকে ‘ শিলচরের প্যাডলার’ না ভেবে ‘অসমের প্যাডলার’ ভাবতে হবে সরকারকে। রাজ্যের অন্য খেলোয়াড়েদের মতোই তাঁকেও সেই সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তবেই, একদিন দেশের গর্বের মুকুট হতে পারবে আমাদের দ্বিবিজারা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker