Barak UpdatesAnalyticsCultureBreaking News

আমার শহর শিলচরের রঙের ক্যানভাসে জেন জি-র এই কী ছবি? লিখেছেন দেবযানী চৌধুরী

দেবাযানী চৌধুরী

শিলচর, ২৭ মার্চ : হোলির সঙ্গে জড়িয়ে বসন্তোৎসব। গৃহবাসীরা দোলের দুয়েকদিন আগে থেকেই দ্বার খুলে মেতে ওঠে বসন্তোৎসবে। হলুদ,লাল শাড়ি-পাঞ্জাবিতে নাচে-গানে রঙের খেলায় মেতে ওঠে। চারপাশের এ ছবি মনকে যেন করে দেয় মাতোয়ারা।

পাশাপাশি এ শহরে হোলির আরেক ছবি ।
শিলচরের স্বনামধন্য কোনও এক কলেজে দোলপূর্ণিমার আগের দিন রোববার দোল উৎসব। না একে দোল বা বসন্তোৎসব বলা যায় না। আজকের ভাষায় প্রি হোলি সেলিব্রেশন। শহরের আরেক প্রান্তের কোনো এক একোয়া পার্কেও তেমনি হোলি উৎসব। দু’খানেই ডিজেতে হিন্দি গানের সঙ্গে দুহাত তুলে উদ্দাম নৃত্য। সঙ্গে পানীয়ের ফোয়ারা। কলেজের মেন গেটের সামনে দিয়ে ছেলেমেয়েগুলো জোড়ায় জোড়ায়, কিংবা দল বেঁধে। একটি মেয়ে, বয়স কতোই হবেবা, উনিশ-কুড়ি। সঙ্গে এক বয়সের আরেকটি মেয়ে। দুজনের পরনে গোলাপী -সবুজ আবিরে রঙীন সাদা কুর্তা আর প্যান্ট। সঙ্গে একটি ছেলে। মেয়েটি টালমাটাল। কোনরকমে জড়িয়ে ধরে টেনে এনে মেয়েটিকে কলেজের উল্টোদিকেত লেনে ঢুকিয়ে একটি বাড়ির বন্ধ গেটের সামনে দাঁড় করালো। কোনোভাবেই দাঁড়াতে পারছিল না মেয়েটি। ভেবেছিলাম মেয়েটি হয়ত কোনো কারনে অসুস্থ। ভুল ভাঙলো। অসুস্থ নয়, হোলি উৎসবে পানীয়টা হয়ত সে অন্যদের মত ধাতস্ত করতে পারে নি।

এমিউজমেন্ট পার্কেরও একই ছবি। লাল পানীয়ের রঙে রঙীন যুবা প্রজন্ম উদ্দাম নাচে মত্ত। মুখবই উত্তাল, ওখানে কোনো এক যুবতীর উদ্দেশ্যে নাকি অশালীন মন্তব্য করেছে কোনো যুবক। লাইভে এসে কান্না জুড়ে মেয়েটি ভিউ বাড়াতে ব্যস্ত। দ্বিধাবিভক্ত মতামত।

তারপর হোলি খেলার সেই দিনটি । লাল-নীল-হলুদের মেলা বসেছে। রঙে রঙে একাকার যুবার দল বুক কাঁপানো শব্দে ভোঁ করে উড়ে চলেছে বাইকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে কিংবা পথ চলছে আজকের যুব প্রজন্ম। হাতে জল কিংবা কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল। হয়ত এতে মেশানো নেশার রঙ। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে যে ছেলেমেয়েগুলো, তাদের কারো কারো হাতে ওয়ান টাইম গ্লাসে হলুদ পানীয়। কেউ কেউ সিগারেটে সুখটানে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে লাজ-সম্ভ্রম-সৌজন্যবোধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ওরা বিভোর । আনন্দের উৎসবে এভাবেই কী আনন্দ খুঁজতে হয়?

করোনাকাল, বন্যার সময়ে যুব প্রজন্মের যে ছবিতে গর্বিত হয়েছিলাম আমরা , তাদের এই রূপ দেখে আঁতকে উঠি। আজকের উনিশ-কুড়ির কিংবা পঁচিশ-তিরিশের ছেলেমেয়েদের কাছে বড্ড জানতে ইচ্ছে হয়, নিজেদের সনাতন সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী বলে যে তোমরা গর্বিত বোধ করো, শ্রীরামচন্দ্রের ঐতিহ্যের উত্তরসূরি বলে আবেগপ্রবণ ‘দেশ কা বচ্চা বচ্চা জয় শ্রীরাম বোলেগা’র সুরের হৃদমে যে তোমরা মাতোয়ারা, সেই তোমরা কী এভাবে সনাতন সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে বহন করতে চাইছ ?

সনাতন ধর্মীয় যোগসূত্র রয়েছে হোলি হোক কিংবা দোল। রঙের উৎসব হোলি। রাধা-কৃষ্ণের ঐশ্বরিক প্রেমের উৎসব হোলি। হোলি কা দহন অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের উৎসব । এখানে আমরা দোলপূর্ণিমার দিনটিকে আমরা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করি। ওইদিন আমরা শ্রীকৃষ্ণকে দোলের রঙে রাঙাই। পরদিন রঙ খেলি আমরা । কিন্তু আজকাল তো দেখছি ঈশ্বরের চরণে রঙ অর্পণের আগেই শুরু হয়ে গেছে মানুষের হোলি খেলা। আর এই হোলি রঙের উৎসব রয়ে যায় নি, হয়ে গেছে রঙের খেলার নামে উদ্দামতা, উচ্ছৃঙ্খলতার উৎসব। চারপাশে যে উদ্দামতার ছবি, সেখানে কোথায় রইল সনাতন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতিফলন।

হোলি মানে কী লাল পানীয়ের ফোয়ারা উড়িয়ে কান ফাটা ট্রেন্ডিং গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচের পার্টি ? কোথায় রইল সনাতন?  আধুনিকতা মানেই কী শর্ট প্যান্ট আর গেঞ্জিতে হট সেজে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তার মোড়ে, গলিতে কিংবা রেস্তোরায় লাল পানীয় পানের সঙ্গে নাচের নামে উদ্দামতা? বাঁধনহারা এই উচ্ছৃঙ্খলতায় অস্বস্তিকর কোনো ঘটনা তো ঘটতেই পারে। যারা পার্টিতে, মদমত্ততায় আনন্দ খুঁজে পায়, সেটা ভাল হোক কিংবা মন্দ, সেটা তাদের পছন্দ। করুক তারা তাদের জীবনকে এমন ভাবে উপভোগ। কিন্তু সেটা কেন ধর্মীয় অনুষ্ঠান দোল খেলা কিংবা বিজয়া দশমীতে মা দুর্গা বিসর্জনের নামে হবে? ওদের দল থেকেই যখন দুটো ছেলে কিংবা মেয়ে বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করে, তারপর আমাদের মুখে রঙ ভরায়, ওই হোলির রঙে খুঁজে পাই আমাদের ভারতীয় ঐতিহ্যকে, সনাতনী সংস্কৃতিকে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker