Barak UpdatesBreaking News

মৃত্যুতেই কি জীবনের পরিসমাপ্তি? লিখেছেন রমাকান্ত দাস
Reminiscence of Prof. Subir Kar by Dr. Ramakanta Das

অধ্যাপক সুবীর করকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

৮ ফেব্রুয়ারি : পার্থিব জগতের প্রেম ভালবাসার সুনির্মল আকাশে একদিন ঘনিয়ে আসে কৃষ্ণঘন মেঘ। প্রেম-প্রীতি শ্রদ্ধার অদৃশ্য ডোরে আমরা প্রিয়জনকে যতই কাছে রাখতে চাই না কেন, অদৃশ্য এই মোহের ডোর ছিন্ন করেজীবন চলে তার নিজের ছন্দে। উৎস থেকে মোহনায় পৌঁছে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ছলছল নয়নে একদিন আকুল কণ্ঠে গেয়ে ওঠে, “মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না।“ জন্মের পর যে বাঁশের ছিলকা দিয়ে নাড়িচ্ছেদ করা হয়, সেই বাঁশের দোলায় চড়েই মানুষ জীবনের শেষ খেয়ায়। প্রতিটি জীবন তখন হয়তো ব্যাকুলভাবে তাঁকে খুঁজে যে “হাতের কাছে নড়ে চড়ে খুঁজলে জনম ভর মেলে না।“

“জন্মিলে মরিতে হইবে অমর কে কোথা কবে!” জীবন আছে বলেই তো মৃত্যু অনিবার্য। আলো থাকলে আঁধার ঘনিয়ে আসা নিশ্চিত, দুঃখ না থাকলে সুখের স্বরূপ উপলব্ধি করবো কীভাবে? দার্শনিক বা তাত্ত্বিক হয়তো জীবনকে এই দ্বৈত বৈপরীত্যের সমাহারে প্রত্যক্ষ করেন নির্মোহ দৃষ্টিতে। কিন্তু আবেগ যে বলে অন্য কথা। মোহের বাঁধনে প্রিয়জনকে কাছে টেনে বলে, “যেতে নাহি দিব, তবু যেতে দিতে হয়।“ মরণশীল জীবনের বিচরণ ক্ষেত্র একদিন শেষ হয়, পরিচিত জনকে বিষাদের দরিয়ায় ভাসিয়ে চিরদিনের মতো দিতে হয়।

এই সংসার আঙিনায় প্রতি মুহূর্তে কত অসংখ্য মানুষ জন্ম নিচ্ছে, অগণিত জীবন মুকুলিত হবার আগেই ঝরে পড়ছে, কতজনকে জীবনের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়েও আশাহত ভগ্ন হৃদয়ে চিরতরে চলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু কিছু মৃত্যু আমাদের বড্ড বেশি ব্যথিত করে। বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়ে বিদায় নিলেও আমরা শোকাহত হই, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। কারণ আমরা জানি, এই মৃত্যুতে সমাজে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা কোনওদিন পূরণ হবে না। এরূপ জীবনের পরিসমাপ্তিতে শুধু আত্মীয় পরিজনের নয়, বৃহত্তর পরিসরে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এমন মৃত্যু তাই আমাদের মরমে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে চিরদিন। কথাগুলো মনের কোণে আজ এসে ভিড় করছিল আমাদের প্রিয় অধ্যাপক সুবীর করের মৃত্যুতে।

স্যারের সঙ্গে সান্নিধ্য আমার বহু বছরের। মহাবিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন পর্যন্ত তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক, পথ প্রদর্শক ও অভিভাবক। সর্বোপরি অসমবয়সী বন্ধু। যে বন্ধুত্বে ছিল স্নেহ আর শ্রদ্ধার গভীর সম্পর্ক। স্যারের নিবিড় সান্নিধ্যে এসে এই সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে পুঁথিগত বিদ্যাশিক্ষা করে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করলেই শুধু ভাল বা বড়মাপের মানুষ হওয়া যায় না। এর জন্য চাই একটা বিশাল উদার মন।

সুবীর কর স্যার ছিলেন সেই মনের অধিকারী। তাঁর চরিত্রে ঘটেছিল মেধা আর আবেগের সমন্বয়। জীবনকে তিনি দেখেছেন সহজ-সরল ও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে। জটিল কোনও বিষয়কে তাই প্রাঞ্জল ভাষায় ও ভাবে ব্যাখ্যা করতে তিনি ছিলেন দক্ষ কুশলী। তিনি বলতেন, জীবন ও জগতকে দেখতে হয় প্রথমত্রসিকের দৃষ্টি দিয়ে, তারপর তাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে। তাহলেই জীবনের মর্মসত্য উপলব্ধি করা সম্ভব। তাঁর এই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে ‘যদিও স্বদেশ নয়’ গ্রন্থে।

স্যার ছিলেন একাধারে লোক সংস্কৃতি বিজ্ঞান, সিলেটের গণভোট ও বিভাজন এবং বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ গবেষক। তাঁর নিরলস অধ্যবসায় ও গবেষণার ফলস্বরূপ আমরা উপহার পেলাম “বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস”, “মহাবিদ্রোহের দ্রোহগাথা : জঙ্গিয়ার গীত”, “1857 in North East : A Re-construction from Folk and Oral Sources”, “সিলেট ও আসামঃ ১৮৭৪-১৯৪৭ গণভোট ও সিলেটের বাংলায় প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস” ইত্যাদি অমূল্য গ্রন্থ। স্যার শরীরীরূপে আমাদের মধ্যে আজ না থাকলেও তাঁর আদর্শ ও সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন উত্তর প্রজন্মের স্মরণে ও মননে। কবির ভাষা ধার করে স্যারের উদ্দেশে আমরা বলব —
“ত্যাজিয়াছ মর্ত্যভূমি
তবু আছ, আছ তুমি।
তুমি নাই কোথা নাই
হয় না বিশ্বাস।।“

(লেখক আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker