Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
ছিন্নমূল মানুষটিই আসামে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন একের পর এক স্কুল-কলেজ, লিখেছেন যশোবন্ত রায়
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ জন্মগ্ৰহণ করেন যারা গতানুগতিক যাপিত জীবনের বাইরে গিয়ে কিছু ব্যতিক্রমী কাজ করতে পছন্দ করেন। আহার, নিদ্রা সহ যাবতীয় জৈবিক কর্ম ছাড়াও এই পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পান। তাঁরা আমাদের প্রণম্য। প্রয়াত ক্ষিতীশ চন্দ্র দাস এমনই এক ব্যক্তিত্ব, যিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করেছিলেন। প্রয়াত দাস ছিলেন বরাক উপত্যকা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাব্রতী। আজ ১৫ সেপ্টেম্বর প্রয়াত ক্ষিতীশ চন্দ্র দাসের ১০৭তম জন্মবার্ষিকী। এই স্বনামধন্য শিক্ষাব্রতীর প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ।
দেশভাগের বলি ছিন্নমূল মানুষেরা নিজেদের অস্তিত্বের সন্ধানে ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমালেন। প্রয়াত ক্ষিতীশ চন্দ্র দাস এরকমই একজন ছিন্নমূল মানুষ। কোনও এক ইন্সুরেন্স কোম্পানির চাকরি নিয়ে কলকাতা থেকে পাড়ি জমালেন আসামের ডিব্রুগড়ে। কিন্তু ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করা তো তাঁর লক্ষ্য হতে পারে না। তাঁর স্বপ্ন যে বৃহত্তর। ছোটবেলায় শিক্ষার্জনের জন্য যে কষ্ট পেতে হয়েছিল সেটাই তাঁর শিশুমনে দাগ কেটেছিল। গ্ৰামের দরিদ্র, অশিক্ষিত মানুষদের শিক্ষার জন্য যাতে কষ্ট করতে না হয় সেটাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। সব সময় ভাবতেন, কীভাবে গ্ৰামের অশিক্ষিত মানুষদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া যায়। তাই তিনি ইন্সুরেন্স কোম্পানির চাকরি ছেড়ে স্থানীয় মানুষের আগ্ৰহে ও সহযোগিতায় শুরু করলেন বাংলা মাধ্যমের স্কুল।
স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর ছোটবেলায় লালিত স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেওয়ার গোড়াপত্তন হলো। নিজেই নিলেন প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব। কালে কালে একে রূপান্তরিত করলেন হাই স্কুলে। সেটাই আজ ডিব্রুগড়ের রেলওয়ে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। কিন্তু সেখানেও তাঁর বাস স্থায়ী হলো না। স্বামী বিবেকানন্দ ও গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত ক্ষিতীশ দাস বিশ্বাস করতেন, ভারতের উন্নতি করতে হলে গ্ৰামে গ্ৰামে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে। এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি সুদূর ডিব্রুগড় থেকে চলে এলেন চারদিকে চা বাগান ঘেরা এক অখ্যাত ছোট্ট জনপদ পয়লাপুলে। সেখানে তিনি এক পাঠশালায় শিক্ষকতার চাকরি শুরু করলেন। কিন্তু সেখানেই থেমে যাননি।
অদম্য উৎসাহ ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পাঠশালাকে উন্নীত করলেন এমই স্কুলে এবং তারপর হাই স্কুলে। সেখানেও নিজেই নেন প্রধান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। ওই স্কুলটিই আজকের পয়লাপুলের নেহেরু হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। নেহেরু হাইস্কুলের ভিত্তি যখন প্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় তখন তাঁর মাথায় এলো কলেজ গড়ার ভাবনা। অনেকে বললেন, চারদিকে অরণ্য আর চা বাগিচা ঘেরা নিস্তরঙ্গ জনপদে কলেজ? এটা পাগলামি ছাড়া আর কি ! কিন্তু তিনি যে ক্ষিতীশ দাস ! ভীষণভাবে আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা, উদ্যমী৷ তাঁর কাছে কোনও বাধাই যে বাধা নয় ! তিনি যেন কবি নজরুলের সেই বিদ্রোহীর মতো—“আমি দুর্বার/আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার !” সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে তিনি তাঁর জয়ধ্বজা উড়িয়ে পয়লাপুলের মতো ছোট্ট জনপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন ‘নেহেরু কলেজ’। তিনি হলেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তাঁর সেদিনের নিরলস পরিশ্রমের সুফল ভোগ করছে পয়লাপুল তথা আশপাশের পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েরা। ক্ষিতীশ চন্দ্র দাসের স্বপ্ন দেখার সুবাদেই তারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদেরকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করছে।
প্রয়াত ক্ষিতীশ চন্দ্র দাস আমাদের সবার প্রেরণার উৎস। শুধু আজকের জন্য নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও। আজীবন তিনি শিক্ষার মশাল হাতে নিয়ে এগিয়েছেন। ‘অন্ধজনে দেহ আলো’ এই ব্রত নিয়ে গ্ৰামের অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিদ্যার আলোকবর্তিকা। স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ক্ষিতীশ দাস শিক্ষা বিস্তারকেই তাঁর জীবনের সব কর্মক্ষেত্রে ধ্যান-ধারণারূপে গ্ৰহণ করেছিলেন। কলেজ থেকে অবসর গ্রহণের পরও তিনি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করে গিয়েছেন। পয়লাপুলের কাছে ফুলেরতলে ‘লিটিল স্টার’ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। শিলচরে নিজের বাড়িতে ছোটদের জন্য তৈরি করলেন ‘টাইনি টটস্ হোম’ এবং মায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘মুক্তশ্রী হাইস্কুল’।
সমাজের সব অগ্ৰগতিতে প্রয়াত ক্ষিতীশ দাসের ভূমিকা ছিল। সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি সহ সব ব্যাপারেই তিনি সমান আগ্ৰহ প্রকাশ করতেন এবং সাধ্যমত কাজ করে যেতেন। কিন্তু এই বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটি কখনও নিজেকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেননি। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘কর্মন্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’ অর্থাৎ কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়। তোমাকে যথাধিকার কর্ম করতে হবে। তাছাড়া স্বামীজির Three H ফর্মূলা Head, Hand and Heart অর্থাৎ জ্ঞান, কর্ম ও প্রেম এই তিন মন্ত্রকে পাথেয় করে জীবনের সব কর্ম সম্পাদন করেছেন। ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’ ছিল ক্ষিতীশ চন্দ্র দাসের জীবনের ব্রত। একবার এক একান্ত সাক্ষাৎকারে ক্ষিতীশ দাসকে জিজ্ঞাসা করা হল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাঁর কী উপদেশ থাকবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, দৃঢ় সংকল্প ও আত্মপ্রত্যয়। দৃঢ় সংকল্প ও আত্মপ্রত্যয় থাকলে যে কোনও ব্যক্তি সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে পারে। স্বামীজির ভাবাদর্শে দীক্ষিত ক্ষিতীশ চন্দ্র দাস আত্মপ্রত্যয় ও অধ্যবসায়কে পাথেয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন সফল মানুষ হিসেবে। আজ তাঁর শুভ জন্মদিনে নতমস্তকে প্রণতি জানিয়ে প্রার্থনা করি, আমরা যেন তাঁর আদর্শ আমাদের ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে অনুশীলন ও অনুসরণ করতে পারি।
(লেখক ড. যশোবন্ত রায় রাধামাধব কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ)