Barak UpdatesHappeningsBreaking News
মোবাইলে চার্জ দিতে লাগল ৩০ টাকা, তাও ৩৭ নং টোকেন, লিখেছেন মানস ভট্টাচার্য
বন্যার্তের ডায়েরি (আট)
জল কিছুটা কমেছে। সকালে ভেলা এবং নৌকায় সবজি, মাছ, দেশি মুরগি ইত্যাদি নিয়ে আসে। অনেক রকমের সবজি। ভেলায় বিক্রেতা চারজন আর নৌকায় দুজন। পরপর দুটো নৌকা। এক নৌকায় মাছ এবং মুরগি। আমরা সবজি এবং মাছ কিনেছি। জিজ্ঞেস করলাম মুরগি বিক্রি হয়েছে নাকি ? বলল –হয়নি। খুব খারাপ লাগল। অনেকগুলো মুরগি নিয়ে এসেছিল। এতদূর থেকে কত কষ্ট করে নিয়ে এসেছে। ওর মন খুব খারাপ। আমাদের তিনটে মোবাইলেই চার্জ করতে হবে। ব্যাটারি সহ কয়েকটা জিনিস আনতে হবে। তাই, স্থির করলাম, বেরবো।
গলিতে প্রায় বুকজল, মেইন রোডে কিছুটা কম। পঞ্চায়েত রোড ধরেই সব যাওয়-আসা করছে। দাস কলোনির মেন রোডে অনেক জল। যাওয়া কঠিন। টার্নিং ছেড়ে একটু সামনে এগিয়ে গেলে দেখা হয় এক বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোকের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, এই উঁচু জায়গা ১৯৬৬ সালের ফ্লাডেও ডোবেনি, এইবার এখানে অনেক জল। এক অপূর্ব দৃশ্য! জায়গাটাকে থার্মোকল-ভেলার ঘাট বলা যায়।
কলেজ টিলার দিকে উঠে দেখি, হীরক ইলেকট্রনিকসের পাশেই ওর ভাতিজার দোকানে মোবাইল চার্জের বিরাট ব্যবস্থা। মোবাইল প্রতি ৩০ টাকা। অনেক সময় দাঁড়ানোর পর টোকেন পেলাম। ৩৭ নম্বর টোকেন। কিছুটা স্বস্তি মিলল। কিছুক্ষণ হীরকের (আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত) সঙ্গে বসে কথা বললাম। তার বারান্দায় ফ্রি চার্জের ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু লাইন ধরে । বাইরে অগণিত শরণার্থীর ভিড়। কলেজে ওঠার রাস্তার দুপাশেই বাজার। চাল, ডাল, সবজি, ফল, মাছ, মাংস থেকে মোটামুটি সবকিছুই আছে। শুধু জিসি কলেজেই সাড়ে পাঁচ হাজার শরণার্থী। উপরে কাঁঠাল গাছের নীচে মুখ্যমন্ত্রীর সভার প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে। বন্যায় যাদের মৃত্যু হয়েছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের পরিবার চার লক্ষ করে টাকা পাবে। অন্যান্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা পরে হবে। রাস্তা দিয়ে হাঁটার কোনও উপায় নেই। লোকে লোকারণ্য। তাছাড়া ভীষন নোংরা এবং দুর্গন্ধ। খুব খারাপ অবস্থা। যদিও প্রায় সবকটি ত্রাণ শিবিরের অবস্থা একই৷ তবে এখানকার অবস্থা অবর্ণনীয়।
শুধু কলেজ টিলার উপরে কারেন্ট আছে, অন্য কোথাও নেই। চার্জ হতে প্রায় দুই ঘন্টা লাগবে৷ তাই হাতের কাজ সেরে নিতে হাঁটতে লাগলাম। কলেজের নীচে সারি সারি ত্রাণ বিতরণের গাড়ি, আর শরণার্থীর মেলা। ত্রাণ নেওয়ার অদ্ভুত উন্মাদনা। এ এক অসাধারণ দৃশ্য। অনেক দূর দূর থেকে ত্রাণ নিয়ে গাড়িগুলো এসেছে। মানবিকতার দারুণ অভিব্যক্তি। দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার প্রয়াস! কী সংবেদনশীলতা! ভালোবাসার কি গভীর টান! কিন্তু যারা ত্রাণ শিবিরে আসেননি, তাদের অবস্থা ? প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাতেগোনা কয়েকটি সামাজিক সংগঠনই ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে।
কলেজ রোডে রাস্তার বুকটা শুধু ভেসেছে। দুই সাইডে জল বিদখুটে কালো, ভাবা যায় না। দরকারি কয়েকটি জিনিস কিনে নিলাম, পথে আমাদের গলির শেষ বাসার অয়নের সঙ্গে দেখা। তারা কয়েকদিন থেকেই গলি ছেড়ে কলেজ রোডে আত্মীয়ের বাসায়। সে জানাল, তাদের বাসার পেছনে নালায় গতকাল একটি ডেড বডি ভেসে এসে আটকে পড়ে। এনডিআরএফ-কে ফোন করলে তারা এসে বডিটি ওঠায়, পরিচয় জানা যায়নি। জলে ভাসা আরও বেশ কয়েকটি ডেডবডির খবর পেলাম। এরকমই একটি— হাতে চাওচাও-র প্যাকেট ধরা অবস্থায় ক্ষুধিত, হিংস্র জলস্রোত প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এমন করুণ, এহেন মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল শিলচরবাসী। ১৯২৯ থেকে ‘৬৬, ‘৮৫ হয়ে ২০২২, নিদারুণ জীবন যন্ত্রণার করুণ ইতিহাস ! তবুও বাঁচতে হয়- এগিয়ে যেতে হয়– নতুন উদ্যমে– নতুন আশায়।
মোবাইলে চার্জ পুরো হয়ে গেছে। অনেক সময় হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। একটা ফ্রুট জুস খেলাম, কয়েকটি বাসার জন্য কিনে নিলাম। হেঁটেই যাব, জলে হাঁটতে সময় লাগে।
তখন প্রায় বিকেল। আলো কমে এসেছে। চারদিকে ধ্বংসস্তুপ, কী বিধ্বস্ত চেহারা ! অ-পর্ণ বৃক্ষের দিকে তাকালে যেমন নিদারুণ কষ্টে মন ভেঙে পড়ে, শহরের অবস্থাও তেমনি। যত্রতত্র মানুষের প্রিয় জিনিসগুলো স্তুপীকৃত, নিত্য পরিচর্যায় মায়ার বন্ধনে জড়ানো জীবন যাপনের সব দামি, কম দামি আ্যটাচমেন্টস! কী অনায়াসে মানুষ সব ছেড়ে দিয়েছে ! কী অসাধারণ স্বার্থত্যাগ ভাবা যায় না!
শুধুমাত্র হিংস্র জলস্রোতের মৃত্যু-পাশ থেকে বেঁচে থাকার দুর্জয় যুদ্ধ আর জীবন রক্ষার করুণ প্রার্থনা !
মানুষ শিখেছে– কী করে অতি সহজে সব ছেড়ে যাওয়ার পথ ধরেও এগিয়ে যাওয়া যায়।
(সমাপ্ত)
Also Read: জনপ্রতিনিধিদের না পাওয়া পুষিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, লিখেছেন মানস ভট্টাচার্য