Barak UpdatesTourismFeature Story

ভুবনপাহাড়ের পথে উৎসাহী ট্রেকিং দল, লিখেছেন ড. পরিতোষচন্দ্র দত্ত

ড. পরিতোষচন্দ্র দত্ত

সাধারণভাবে মানুষ যখন সমস্যা জর্জরিত দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের চাপে নিজেকে হারিয়ে ফেলে তখনই কাজের চাপ থেকে মুক্ত পাবার পাশাপাশি নিজেকে মানসিকভাবে সতেজ রাখার জন্য ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে৷ ভ্রমণের মাধ্যমেই মানুষ নিজের প্রশান্তি ফিরে পাবার চেষ্টা করে৷ প্রাচীনকাল থেকেই ভ্রমণকে মানুষের জীবনের সর্বোত্তম চিত্তবিনোদনের উপাদান হিসেবেই গণ্য করা হয়ে আসছে৷ তাই দেখা যায় সাধারণত চিকিৎসকেরা বহু রোগ থেকে সেরে উঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পূর্বে ভ্রমণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন৷ একঘেয়েমি জীবনের অবসরে বিভিন্ন সময়ে পছন্দ মতো নানান জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা। বর্তমানের ব্যস্ততম নিরস যান্ত্রিক জীবনের মাঝে ভ্রমণ এমন একটি অংশ যাকে অস্বীকার করে সুস্থ থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ঘুরতে যাওয়ার আনন্দের পাশাপাশি সেই সময় গুলোতে নতুন নতুন জিনিস দেখার এবং নানারকম পরিবেশের মধ্য দিয়ে অনেক নতুন নতুন শেখার অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় হয়ে থাকে।

All sizes | Bhuvan Pahar Silchar Cachar Assam | Flickr - Photo Sharing!বৈচিত্র্য ভরা পাহাড়ের প্রকৃতি ও জীবন নিয়ে প্রকৃতিপ্রেমী সাধারণ মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই৷ তাইতো পাহাড় সম্পর্কে, পাহাড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে, পাহাড়ের মানুষ সম্পর্কে জানার আগ্রহেরও শেষ নেই৷ সাধারণতঃ চিরাচরিত দৈনন্দিন জীবন থেকে ছুটি নিয়ে প্রকৃতির বুকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ছুটে যেতেই অনেকে পছন্দ করে থাকেন৷ তবে ট্রেকিং-এ যাবার জন্য মোটামুটি ভাবে পছন্দের জায়গা হচ্ছে পাহাড়, নদী, সমুদ্র, জঙ্গল ইত্যাদি৷ পাহাড় পর্বতে আরোহন অনেকেই মন থেকে ভালোবাসে৷ প্রকৃতিকে ভালোভাবে জানার অদম্য স্পৃহা থাকলেই পাহাড়কে খুব কাছে থেকে দেখার ইচ্ছা জন্মায়৷ পাহাড়ের নান্দনিক পরিবেশ দেশের অন্য যে কোনো পরিবেশের চেয়ে আলাদা।

বরাক উপত্যকায় ট্রেকিং-এ যাবার জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে, যাদের মধ্যে একটি হলো ভুবন পাহাড়৷ যারা ট্রেকিং করতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য ভুবন পাহাড় একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র৷ তাই এবারের গন্তব্য স্থান হিসেবে ভুবন পাহাড়কেই বেছে নেওয়া হয়৷ শিলচর এক্সপ্লোরার ক্লাবের উদ্যোগে সারা বছর ধরে পাহাড়বেষ্টিত এই ভুবন পাহাড় সহ উপত্যকার বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে ট্রেকিং-এর আয়োজন করা হয়ে থাকে৷ ভুবন পাহাড়ের এক অপরূপ মোহময়ী সৌন্দর্যের পাশাপাশি মায়াবী আকর্ষণের পুরো স্বাদ পেতে হলে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ দিন থাকা উচিত৷ চারিদিকের পাহাড়ের চূড়া ও বিভিন্ন ঝর্ণা এখানকার সৌন্দর্যকে অন্য মাত্রা প্রদান করেছে৷ প্রাকৃতিক পাথরগুলোই সিঁড়ির ধাপের কাজ করছে৷ কোথাও সিঁড়ির দুই পাশে হাত দিয়ে ধরে নিরাপদে ওঠার জন্য প্রাকৃতিকভাবেই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া আছে৷ আবার কোথাওবা মানুষের ক্রমাগত চলাচলের ফলে চরাই-উতরাইয়ের মাঝেও একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে৷ তবে এই পাহাড়ে উঠতে বা নামতে বেশ কিছু পরিমাণ কষ্ট তো করতেই হয়৷ এই ভুবন পাহাড়ে যাবার সেরা সময় হলো অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত৷ দূর থেকে ভুবন পাহাড়ের ঢালু গায়ে জমে থাকা মেঘরাশি মনে করিয়ে দেয় আমেরিকান উপন্যাসিক বালভা প্লেন (Belva Plain)-এর সুন্দর উক্তি- “Danger hides in Beauty and Beauty hides in danger”৷

ট্রেকিং এর সুবিধা ছাড়াও ভুবন পাহাড় ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে ভুবনতীর্থ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে৷ কারণ ভুবন পাহাড়ে রয়েছে শিবের মন্দির, যেখানে শিবরাত্রি উপলক্ষে প্রায় এক থেকে দু হাজার মানুষের সমাগম ঘটে থাকে৷ এছাড়া গত ২৭ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বিশাল ধূমধামের মধ্য দিয়ে ভুবন মন্দির প্রাঙ্গণে এক বিশাল হনুমান মূর্তির প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ ভুবনতীর্থ উন্নয়ন কমিটির কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে পূজার্চনাসহ উৎসবের মাধ্যমে ভুবন মন্দির প্রাঙ্গণে কমিটির উদ্যোগে উঁচু পাথরের উপর এই মূর্তিকে বসানো হয়৷ এছাড়াও রয়েছে নাগা সম্প্রদায়ের বিষ্ণু মন্দির৷ নাগা ভাষায় তার নাম বুয়াঞ্চানিউ রাকাই (Bhuanchaniu Rakai)৷ রাকাই শব্দের অর্থ মন্দির এবং বুয়াঞ্চানিউ শব্দে বিষ্ণুকে বোঝানো হয়েছে৷ মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে আসাম সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যগুলো থেকে নাগা সম্প্রদায়ের মানুষেরা দুদিনের উৎসবে সামিল হয়ে থাকেন৷ প্রায় দেড় থেকে দুহাজার মানুষ এই উৎসবে যোগদান করে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন৷ ১৫ দিনের ব্যবধানে এই দুই উৎসবে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম ঘটে ভুবন পাহাড়ে৷

No description available.এক্সপ্লোরার ক্লাবের রুটিন প্রোগাম অনুযায়ী সম্পাদক তথা শিলচর শ্রীকোণা কল্যাণী হাসপাতালের শল্য চিকিৎসক ড০ কুমার কান্তি দাস (যিনি লক্ষণ দাস নামেই অধিক পরিচিত) এবং ক্লাব সভাপতি সখারঞ্জন রায়ের যৌথ নেতৃত্বে দুদিনের এক ট্রেকিং প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়৷ ৪২ জনের একটি ট্রেকিং দল ভুবন পাহাড়ে যাবার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে সকাল আটটায় শিলচর সিভিল হাসপাতালের সামনে জড়ো হন৷ জিনিসপত্র সমস্ত গুছিয়ে পুরো দলটি আনুমানিক সাড়ে আটটা নাগাদ চার চাকায় ভর করে সত্তর থেকে পচাত্তর মিনিটের মধ্যে মতিনগর অতিক্রম করে খাসিয়াপুঞ্জিতে পৌঁছে যায়৷ মিনিট পনেরোর মধ্যে সবাই নিজের নিজের বোঝা নিজের পিঠে চাপিয়ে নিয়ে এক লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন৷

ট্রেকিং-এর নিয়ম, সবাই নিজেদের নাম এমনভাবে উচ্চারণ করে বলবে যাতে সবাই সবার নাম জেনে নিতে পারে৷ পাশাপাশি এক, দুই করে গণণাও করে নেওয়া হয়, যাতে সবাই জানতে পারে ট্রেকিং দলে মোট কতজন সদস্য-সদস্যা  রয়েছে৷ এখানে পুরো দলকে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তিন চারজনকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়ে মুখ্য নেতা তথা  ক্লাব সম্পাদকের মুখ থেকে মার্চিং অর্ডার বের হলো৷ এভাবে দায়িত্ব দেবার মূল কারণ হচ্ছে, এই যাত্রাপথে যাতে কারও কোনোরকম অসুবিধে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে সবাইকে একসাথে এগিয়ে নিয়ে চলা৷ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মন্দিরে পৌঁছাতে পাহাড়ি পথে ১৭ কিলোমিটার চড়াই-উতরাই পথ পার করতে হয়৷ ইদানীংকালে সরকারের বদান্যতায় মতিনগর থেকে খাসিয়াপুঞ্জি পর্যন্ত রাস্তা তৈরি হওয়ায় খাসিয়াপুঞ্জি থেকেই শুরু হয়ে গেলো ইংরেজি এগারো নম্বরে ভর করে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলা৷

ট্রেকিং দলে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন শিলচর ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসক ইকবাল হুসেন লস্কর, চিকিৎসক রেহান মজুমদার ও তার দুই কন্যা, চিকিৎসক শিবাশিস নাথ ও তাঁর সহধর্মিনী, সুকান্ত কর ও তার সহধর্মিনীসহ তাদের আদরের পোষ্য সারমেয়, কালীনগর রামকৃষ্ণ সেবা সমিতির প্রদীপ দে, দক্ষিণ হাইলাকান্দির গুটগুটি থেকে প্রদ্যুম্ন রিয়াং, গৌতম চক্রবর্তী, অরুণ দাস, আর্চি রায়, কল্যাণী হাসপাতালের বেশ কয়েকজন কর্মী, ভাগ্য দাস, চন্দ্রধর দাস প্রমুখ৷ এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ভুবন পাহাড়ে পৌছানোর জন্য দ্বিতীয় রাস্তা গঙ্গানগর কৃষ্ণপুর থেকেও যাওয়া সম্ভব৷ সাম্প্রতিককালে রাজ্য সরকারের বদান্যতায় তীর্থযাত্রীদের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য পাহাড়ের গাছ কেটে চওড়া রাস্তা তৈরির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে৷ যাই হোক, আমাদের যাত্রাপথ হিসেবে খাসিয়াপুঞ্জিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে৷ নাম না জানা নানারকম বিশাল বিশাল গাছের ডালপালা সরিয়ে সরু পাহাড়ি পথে নিয়ম মেনে সবাই চুপচাপ এগিয়ে চলে৷ এই পাহাড়ি পথ যেমন সুন্দর, তেমন চারপাশের অবস্থা দেখলে বিভীষিকাও মনে হয়৷ থমথমে অবস্থার মাঝে সবাইকে নিস্তব্ধতা বজায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে হলো৷

এতো সবুজ বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটাপথে সুন্দর দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে এক লাইনে সবাই এগিয়ে চললো৷ ঘন্টা দুয়েক পা চালিয়ে পাহাড়ের মাঝে এক জায়গায় পিঠের বোঝা নামিয়ে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হল সবাই৷ এই বিশ্রামের সুযোগে ভাগ্য দাসের সৌজন্যে গরম চা গলায় ঢালার সুযোগ করে দেওয়া হল৷ চায়ের সাথে সাথে অনেক ধরনের খাবারও হাতে এসে পড়ল৷ কয়েকজন কষ্ট করে বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে নিয়ে এসেছেন সবার জন্য৷ ইতিমধ্যে প্রায় একটি ঘন্টা খরচ হয়ে গেলেও দেহমনে সবাই কিন্তু কিছু শক্তি সঞ্চয় করে নিলো৷ এরপর চরাই-উতরাই অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার পাশাপাশি মাঝে মাঝে কিছু বিশ্রাম নিতেই হয়৷ মোটামুটিভাবে তিনঘন্টা পর ত্রিবেণীতে পৌছে মনে হল, যেন গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি৷ কিন্তু হল না, ভুবন মন্দিরে পৌছানোর জন্য ত্রিবেণী থেকে আরও দেড়-দুঘন্টার পথ চলতে হলো৷ ত্রিবেণী থেকে বামহাতে আধ ঘন্টার পাহাড়ি রাস্তায় এগিয়ে গেলেই পাওয়াা গেল বিষ্ণু মন্দির, যেখানে মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে নাগা সম্প্রদায়ের দ্বারা আয়োজিত হয়ে থাকে দুদিনের বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব৷ এই উৎসব উপলক্ষে পাঠা, মুরগী বলি দেবার রীতি প্রচলিত থাকলেও বিষ্ণু দেবতার নামে উৎসর্গ করে ছেড়েও দেওয়া হয়ে থাকে৷

No description available.যাই হোক, মন্দিরের পথে পা বাড়াতেই এই ত্রিবেণীতেই দেখতে পাওয়া গেল একদল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জনগোষ্ঠীর মানুষ যারা খাসিয়া নামেই সমধিক পরিচিত৷ প্রতিটি জাতিসত্তাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী৷ এদের রয়েছে নিজস্ব রীতি-নীতি, পোশাক, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম যা এই ট্রেকিং-এর পথে চাক্ষুস প্রমাণ পাওয়া গেলো৷ এই খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জুমচাষ তাদের প্রধান পেশা হলেও বংশানুক্রমে তারা পাহাড়ে জন্মানো বিভিন্ন লতাপাতা, সবজি, ফলমূলের ফলনও করে থাকে৷ এখানে উল্লেখ করতেই হয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই কঠোর পরিশ্রমী৷ খুবই সহজ-সরল এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে জুম পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল, বিশেষ করে পান উৎপাদন করে থাকে৷ যুগ যুগ ধরে শিক্ষার আলোক থেকে দূরে থাকলেও প্রকৃতি থেকে পাওয়া জ্ঞান দিয়েই এই জনগোষ্ঠী যে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এসেছে তা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে আজ হুমকির মুখে৷ পাহাড়ি জীবন, ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃতি ও জীবনের মধ্যে মেলবন্ধনই পারে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে৷

No description available.ত্রিবেণী থেকে ডানদিকে চলে গেছে ভুবন মন্দিরের পথ৷ এই ত্রিবেণী থেকে ভুবনতীর্থে যাবার পথে একটু এগিয়ে গেলেই এক চমৎকার প্রাকৃতিক স্টেডিয়াম সদৃশ স্থান রয়েছে যা সত্যিকার অর্থে এক আকর্ষণীয় স্থান৷ এক নতুন অভিজ্ঞতার সাথে সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে তৃপ্ত হলো সবাই৷ এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য থেকে প্রাপ্ত তৃপ্তি লক্ষ কোটি টাকার সাথেও তুলনা চলেনা৷ একটা সময় গেছে যখন এই স্টেডিয়ামের ভেতরেই তাবু খাটিয়ে সবার অলক্ষে সুন্দরভাবে কয়েকবার শিবির করা সম্ভব হয়েছে৷ সেসময় জলের উৎস পাশেই থাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জল সংগ্রহে তেমনভাবে অসুবিধা ভোগ করতে হয়নি৷ কিন্তু সাম্প্রতিককালে জলের উৎস পুরোপুরিভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জলের অভাববোধে এখন আর শিবিরের আয়োজন করা সম্ভব হয় না৷ এই স্টেডিয়ামের উপর দিয়েই চলে গিয়েছে পাহাড়ী রাস্তা, যেখান দিয়ে সকলেই চলাফেরা করে, কিন্তু পাললিক শিলায় গঠিত প্রাকৃতিক স্টেডিয়ামের ভেতরের অবস্থানকারীদের কোনোভাবেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না৷ ফলস্বরূপ কোনরকম বাধাবিঘ্ন ছাড়াই শিবির করা সম্ভব হয়েছে৷ পাহাড়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই প্রাকৃতিক স্টেডিয়াম সদৃশ জায়গায় পৌঁছে মনের অজান্তেই হঠাৎ করে ১৯৫৮ সালে চেলিয়াবিনস্ক অঞ্চলের ছোট্ট শহর কর্কিনোতে জন্মগ্রহণ করা আনাতোলি বুকরিভের ( Anatoliy Bukreev) কথা মনে পড়ে গেলো৷ তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত পর্বতারোহী, লেখক, ফটোগ্রাফার ৷ তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়ে ‘স্নো চিতা’ নামে খ্যাত ছিলেন৷ তিনি উক্তি করেছিলেন, “পর্বতমালা স্টেডিয়াম নয় যেখানে আমি আমার উচ্চাকাঙ্খা পূরণ করি, সেগুলো মন্দির যেখানে আমি আমার ধর্ম পালন করি৷”

No description available.যাই হোক খাসিয়াপুঞ্জি থেকে প্রায় ছয় থেকে সাত ঘন্টা পর গন্তব্যস্থানে পৌছে মনে হলো, বিরাট কিছু একটা জয় করে ফেলেছি৷ ভুবন মন্দিরে পৌঁছনোর পর আস্তে আস্তে সবার জন্য গরম চায়ের ব্যবস্থা হলো৷ এই সুন্দর ব্যবস্থায় পথের সমস্ত ক্লান্তিকে সরিয়ে পুরো চাঙা বানিয়ে দিল৷ হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে রাতের শোবার সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করে নিয়ে টিম মিটিং-এ যোগদান করতে হলো৷ ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী এই আলোচনা সভায় সবাইকেই উপস্থিত থাকতে হয়৷ কারণ ট্রেকিং-এ আসার পথে ঘটে যাওয়া সবার ভুল ভ্রান্তিগুলোকে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর পাশাপাশি শোধরানোর দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে৷ একই সাথে সকলের সুবিধা-অসুবিধা জেনে নিয়ে সমাধানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আগামীদিনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়ে দেওয়া হয়৷ এছাড়াও হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে সবাইকে সহজ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ছাড়াও সবাই সবাইকে জানার সুবিধা হয়ে যায়৷ যাই হোক সাড়ে সাতটা বাজার সাথে সাথে রাতের ডান হাতের কাজটি সেরে নেবার জন্য ডাক পড়লো৷

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই ভুবন পাহাড়ে প্রথমবার পা রেখেছিলাম ২৫ বছর আগে, ১৯৯৬ সালে৷ সে বছর এই ক্লাবেরই উদ্যোগে প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক লক্ষণ দাসের নেতৃত্বে ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জানয়ারি এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষার্থী হিসেবে যোগদান করার সুযোগ পেয়েছিলাম৷  ডাক্তারবাবুর তত্ত্বাবধানে পাহাড় চড়ার বেশ কিছু নিয়ম শেখার সুযোগ হয়েছিলো৷ সেই সময় সখাদার পাশাপাশি সুকান্ত করের উপরও অনেক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিলো৷ বছরের প্রথম দিনটিতে তদানীন্তন জেলাশাসক গান্ধীবাগে গিয়ে পতাকা তুলে আমাদের যাত্রা শুরু করিয়েছিলেন৷ সেই সময় পাহাড়ের গা বেয়ে তাবু খাটিয়ে শীতের সাতটি রাত কাটিয়ে এক আলাদা আনন্দ উপভোগ করেছি৷ মাটি কেটে গর্ত বানিয়ে বড় আকারের পলিথিন পেতে ভোরবেলাতেই পাহাড়ের ঝর্ণার জল সংগ্রহ করে এনে সারা দিনের জন্য মজুত রাখতে হতো৷ সকালবেলা গরম চায়ের সাথে অকৃপণ হাতে দেওয়া হতো বিস্কুট, যা খেয়ে নিয়ে পকেটে চকোলেট মজুত করে ট্রেনিংস্থানে পৌঁছে যেতাম মোটামুটিভাবে সারাদিনের জন্য৷ সারাদিন জলের পরিবর্তে চকোলেটের ব্যবহার আয়ত্ত করে নিয়েছিলাম৷ বিকেল নাগাদ পাওয়া যেত ম্যাগি সেদ্ধ৷ তেলের কম ব্যবহারের ট্রেনিংও দেওয়া হল৷ এর পর সন্ধ্যা নাগাদ এক থেকে দেড় ঘন্টার জন্য শুরু হয়ে যেতো ট্রেকিং সংক্রান্ত তাত্ত্বিক ক্লাস সহ নানারকম শিক্ষণীয় আলোচনা৷ রাত্রিতে চাল-ডালের সাথে পাহাড় থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন গাছের লতাপাতা একসাথে সেদ্ধ করে দেহের মধ্যপ্রদেশে ঢুকিয়ে আটটার মধ্যে তাবুর ভেতর প্রবেশ করে চোখ দুটো বন্ধ করার চেষ্টা চললো৷ সেই সময়কালে মোবাইল নাম আধুনিক সঙ্গীটি না থাকায় আর সারাদিনের ক্লান্তির জেরে তাবুতে প্রবেশের কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্য পৃথিবীতে চলে যেতাম৷

এনসিসি ট্রেনিংএর অভিজ্ঞতাগুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ সুবিধে করে দিয়েছিলো৷ সাতটা দিন কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো, শেষদিনে সবার হাতে শংসাপত্র তুলে দেওয়া হলো৷ এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয় যে সাতদিন ধরে চলা প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া এতগুলো ছেলেমেয়ের মাঝে ন্যূনতম একজন প্রশিক্ষার্থীকেও সামান্যতম দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়নি৷ তবে গত পঁচিশ বছরে ভুবন পাহাড়ের অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়ে গেছে৷  ‘উন্নয়ন’-এর জোয়ারে বিভিন্ন দেশের মত আমাদের এই উপত্যকায়ও পাহাড়ের গাছপালা কেটে অরণ্যের-পর-অরণ্য শেষ করে দেওয়া হচ্ছে৷ সুস্থ জীবন যাপনের জন্য সুস্থ পরিবেশ খুবই জরুরি৷ সুস্থ জীবনের প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান মানুষ প্রকৃতি এবং পরিবেশ থেকেই পেয়ে থাকে৷ প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার উপর প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগতের অস্তিত্ত্বের পাশাপাশি মানবজাতির উন্নয়ন নির্ভরশীল৷ পরিবর্তন তো স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে থাকে তবে পরিবেশকে ধ্বংস করে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট করা কোনোভাবেই উচিত নয়৷ বিশাল বিশাল গাছগুলোকে যেভাবে কেটে ফেলা হয়েছে বা হচ্ছে, তার কোনো হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়৷ এই গাছগুলোকে কেটে ফেলে পাহাড়ের ভেতরের আবহাওয়াকে অনেকটাই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে৷

এই পৃথিবীতে থাকা সমস্ত জীব এবং জড় পদার্থ পরিবেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত৷ তাই পরিবেশের সমান্য অংশের পরিবর্তনের প্রভাব অন্যান্য উপাদানের উপর প্রতিফলিত হয়৷ সাম্প্রতিককালে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্রমাবনতি মানব সভ্যতার জন্য এক মারাত্মক সংকট এবং সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে৷ আবহাওয়ার পরিবর্তন হওয়ায় পাহাড়েও শীতের প্রকোপ অনেকটাই কমে গিয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ তাই নেতা মন্ত্রীদের কাছে অনুরোধ থাকবে যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজেদের পকেটের স্বার্থের কথা বাদ দিয়ে এই ভুবন পাহাড়ের সৌন্দর্য রক্ষায় এগিয়ে আসুন৷ পাশাপাশি পর্যটকদের কাছে বরাকের এই স্থানটির আকর্ষণ কোনোভাবেই যাতে কমে না যায় সেদিকে আন্তরিক হবার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ রাখছি৷ পর্যটকদের কাছে এই ভুবনতীর্থকে আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য উন্নয়ন কমিটির সভাপতি রাজ্য সরকারের প্রাক্তন আমলা শ্রী বীরেন্দ্র চন্দ্র নাথ এবং সম্পাদক বিভাস চক্রবর্তীর নেতৃত্বে অনেকেই পরিশ্রম করে চলেছেন৷ পাশাপাশি সম্পাদক এবং সভাপতি দুজনে মিলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও শোনালেন৷ তবে সর্বাবস্থায় পরিবেশ যাতে অক্ষুন্ন থাকে সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখার কথাও শুনিয়ে দেওয়া হলো৷ কারণ আমরাই আমাদের নিজেদের তৈরি কার্যকলাপে প্রতিনিয়ত পাহাড়ের পরিবেশকে দূষিত করে চলেছি৷

দূষনের ভারে ক্রমাগত ন্যুব্জ হতে চলেছে বরাকের এই ভুবন তীর্থ নামের স্থানটি৷ প্রত্যেক বছর হাজার হাজার মানুষের আগমনে বর্জ্য জমে চলেছে এই মনোরম পাহাড়টিতে৷ বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক জলের বোতল, মদের বোতল, গুঠকাসহ বিভিন্ন নেশাজাত দ্রব্য, বিস্কুট-চকলেটের রেপিং পেপার ইত্যাদি পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ মূলত: পাহাড়ে যাতায়াত করা যাত্রীদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দূষণের পরিমানও বেড়ে চলেছে৷ পরিবেশ দূষণ বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কঠিন সমস্যা৷ পরিবেশের আনুকূল্যে যে উদ্ভিদ জগৎ, প্রাণী জগৎ এবং মানুষের জীবন একে অপরের নির্ভরশীলতায় সুন্দরভাবে বিকাশ ঘটতে পারে, সেই পরিবেশ আজ বিপন্নের পথে৷ তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি কড়া ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷ মানুষের সুবিধার জন্য রাস্তা বানানোর দোহাই দিয়ে নির্বিচারে গাছ নিধন বন্ধ হোক এবং বড় বড় গাছ কাটার ওপর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হোক৷

তবে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রক্ষকই ভক্ষক৷ অপ্রিয় হলেও বাস্তব সত্য যে শতকরা ৯০ ভাগ নেতা মন্ত্রীগণ দেশের কথা না ভেবে নিজের পকেট ভরার কথাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করে থাকতে দেখা যায়৷ তাই সমস্যার সমাধান না হয়ে দিন দিন সমস্যা বেড়েই চলেছে৷ পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটজাত ও অন্যান্য পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করতে হবে। দূষণরোধে পলিথিন, প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত৷ হাজারও উপায় রয়েছে যা আমাদের সবুজ বনাঞ্চলকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে এবং এটার জন্য শুধু প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষনের এক তথ্য থেকে জানা যায় যে পরিবেশ দূষণ জনিত অসুখবিসুখের জন্য সারা বিশ্বে মৃত্যুর গড় যেখানে মাত্র ১৬ শতাংশ সেখানে ভারতবর্ষে মৃত্যুর হার ২৬.৫ শতাংশ৷ তাই এই ভুবন পাহাড়কে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন, আমরা মিলেমিশে একটি সজীব সুন্দর ভ্রমণযোগ্য ভুবনপথ গড়ে তুলি পরবর্তী প্রজন্মকে সুন্দর ভুবন উপহার দেবার লক্ষ্যে৷ কারণ পাহাড় ভ্রমণ নিয়ে বিখ্যাত উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “অনেক দিন ধরেই আমার পাহাড় কিনার শখ কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না যদি তার দেখা পেতাম তাহলে দামের জন্য আটকাতাম না”৷

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker