Barak UpdatesIndia & World UpdatesHappeningsCultureBreaking NewsFeature Story

আকুল চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল আমার কিশোর- কিশোরী বাবা আর মাকে, লিখেছেন বিধায়ক ভট্টাচার্য

হঠাৎ মিছিল, একটু পরেই শুনি গুলির শব্দ

//বিধায়ক ভট্টাচার্য//

দীর্ঘ তিন দশকের প্রতীক্ষার অবসানে আমার সিলেট যাত্রা৷ বলতে পারি বাংলাদেশ যাত্রা। স্বাধীনতা সাংস্কৃতিক পরিষদ, সিলেটের আমন্ত্রণে “মৈত্রীর বন্ধনে আমরা” অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৮ জুলাই শিলচর থেকে আমরা ১১ জন রওনা হই৷ আমার সঙ্গে ছিলেন সংগীতশিল্পী সর্বানী ভট্টাচার্য ও সস্ত্রীক সুজিত দাস (ফুলোদা), নৃত্যশিল্পী সত্যজিৎ বসু ও মধুমিতা ভট্টাচার্য, সাংবাদিক অভিজিৎ ভট্টাচার্য, সংগঠক যশোবন্ত দাস, তুহিনা বিশ্বাস, সুপর্ণা চৌধুরী ও জয়তী দেব। সকালেই আমরা সুতারকান্দি সীমান্তে যথাসময়ে পৌঁছে যাই৷ দু’পারের ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, সীমান্তরক্ষীদের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সেরে স্পর্শ করলাম আমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর জন্মভূমিকে। মনে হলো যেন কোলের গন্ধ পেলাম অনেকদিন আগে আমাকে ছেড়ে যাওয়া মা-বাবার, আকাশ-বাতাস যেন আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরল। আয়োজক সংগঠনের সভাপতি প্রখ্যাত লোকশিল্পী গৌতম চক্রবর্তী সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন৷ তাদের প্রতিনিধি শাজাহান ভাই সহ অন্যরা পরম যত্নে আমাদেরকে নিয়ে যাত্রা করলেন সিলেট শহরের উদ্দেশে। যেতে যেতে চারপাশের পুকুর, মাঠে আমার আকুল চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল আমার কিশোর- কিশোরী বাবা আর মা’কে। ওঁদের মুখে শোনা সুন্দরী শ্রীহট্টকে আমার চোখে দেখবার চেষ্টা করলাম।

প্রায় আড়াই ঘন্টার যাত্রা পথে গোলাপগঞ্জে ‘নাস্তা’র বিরতিতে সবাই প্রাণভরে বাংলাদেশের বিখ্যাত ‘ফুলকলি’ র মিষ্টি ও কেকের স্বাদ নিলাম। একে একে কুশিয়ারা, সুরমা পার হয়ে অবশেষে সিলেট শহর। ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন অপূর্ব ! বাংলাদেশের দেড়শতক অতিক্রান্ত ঐতিহ্যসম্পন্ন সিলেট স্টেশন ক্লাব সংলগ্ন ‘রিভার ভিউ’ হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। বিভাস শ্যাম পুরকায়স্থ, গৌতমবাবু, সুমনবাবু, তন্ময়, শামি সহ ওদের সংগঠনের একঝাঁক কর্মকর্তা আমাদের স্বাগত জানালেন হোটেলে। খুব তৎপরতায় হোটেলকর্মী জিল্লুভাই আমাদের ‘দুপুরের’ খাবারের আয়োজন করলেন৷ পরম তৃপ্তিতে সুস্বাদু খাবার খেয়ে সবাই তরতাজা হয়ে উঠলাম। ওহ, এখানে একটি বিষয় বলা খুব জরুরি, ১৬ জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় বাংলাদেশে যে অস্থিরতা চলছিল তা নিয়ে আমরা সজাগ ছিলাম৷ কোথায় কী হচ্ছে, আয়োজকরাও বারবার খবর নিচ্ছিলেন৷ কিন্তু ১৮ তারিখ রাত অব্দি সিলেটে কোনও অস্বাভাবিকতা আমাদের চোখে পড়েনি ৷ এমনকি ১৯-২০ জুলাইয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাও নিয়মমাফিক চলছিল। যাই হোক, রাতে সিলেট সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তথা বিশিষ্ট গীতিকার সেলিমভাই, প্রবীণ সংগঠক শ্রদ্ধেয় জাধনদা, গৌতম ওরা সবাই আবার আসেন, জমাটি আড্ডা হলো এবং পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার (ওদেশের সাপ্তাহিক ছুটির দিন) সকালে আমরা বেরিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন ও শহিদ মিনারে যাই৷ তখনই অশান্তির কিছুটা আঁচ টের পাই৷ আমাদের অটোচালক সহ স্থানীয় লোকরা এ নিয়ে বলাবলি করছিলেন।

রামকৃষ্ণ মিশনের শান্ত সৌম্য পরিবেশ আর বাঙালির আত্মপরিচয়ের বাতিস্তম্ভ শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে পরিতৃপ্ত হয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম। সেই রাতেই আমার নির্ধারিত গানের অনুষ্ঠান৷ তাই হোটেলে দুপুরের আহার সেরেই শুরু করলাম অনুষ্ঠানস্থলে যাবার প্রস্তুতি৷ শামি-নাঈমরা আমাদেরকে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি, খানিকক্ষণের মধ্যে গাড়ি আসবে আমাদের নিতে৷ এমন সময় হঠাৎ মিছিলের আওয়াজ৷ একটু পরেই গুলির শব্দ৷ হোটেলের ব্যালকনি থেকে দেখি, পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর তৎপরতা, টহল। আয়োজকরা উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন আমরাও। অতঃপর, পরিষদের কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনায় পুলিশ নিরাপত্তার মাঝে আমরা গেলাম অনুষ্ঠানস্থল শিল্পকলা একাডেমীতে।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শ্রদ্ধেয় রানা সিনহার পরিচালনায় সেদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ সমবেত পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের সহকারী হাইকমিশনার, দ্বিতীয় সচিব সহ সিলেটের সম্মানিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণ। একে একে উৎসব সংগীত, সম্মিলিত নৃত্য, সম্মিলিত আবৃত্তি হয়ে আসাম ও ত্রিপুরার শিল্পীদের পরিবেশনা সহ অনুষ্ঠান যখন স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে তখনই সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অপ্রীতিকর ঘটনার খবরে উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠান সংক্ষেপিত করে রাত ৯টা নাগাদ সমাপ্ত করেন৷ তার আগে আমি আমার সংক্ষিপ্ত পরিবেশনায় দুখানি গান গাই – ‘আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এবং ‘গঙ্গা আমার মা’। এত উৎকণ্ঠার মাঝেও উপস্থিত গুণীজনেরা গান শুনে আমায় আশীর্বাদ করলেন। অনুষ্ঠান শেষ করেই কড়া নিরাপত্তায় আয়োজকরা নিরাপত্তারক্ষী সহ গাড়িতে আমাদেরকে হোটেলে পৌঁছে দেন। আমাদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে এক ঝাঁক দায়িত্বশীল তরুণ কর্মী আমাদের বাসের সামনে বাইক চালিয়ে একেবারে হোটেল পর্যন্ত আসেন, একটু পরেই খবর আসে যে, রাত বারোটা থেকে সারা দেশে কারফিউ৷ অগত্যা অত্যন্ত বিষন্নমনে ২০ তারিখের অনুষ্ঠান বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন আয়োজকরা। দুই ছোট ভাই শামি ও নাঈম আমাদের সাথে হোটেলেই থেকে যায়। নিজেদের সমস্ত সমস্যা, অসুবিধাকে হেলায় দূরে রেখে সেই রাতেই কর্মকর্তারা আমাদের দেশে পাঠানোর জন্য প্রশাসন ও ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেন। পরের দিন সকালে মুকুল ভাই, বিভাসদা, গৌতম, জুয়েল, সুমন সহ সবাই চলে আসেন এবং ২১ তারিখে প্রশাসনের অনুমতিতে ও সহযোগিতায় আমাদের ফেরত পাঠানোর সব ব্যবস্থা পাকা হয়।
কিন্তু পরিস্থিতি যাই হোক, সংস্কৃতির মেলবন্ধনে যখন দুটি দেশের মানুষ উন্মুখ তখন শত উদ্বেগ অনিশ্চয়তার মাঝে ও গান, আড্ডা যে হবেই তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না এবং হলোও তাই। আমাদের ফেরার আগের দিন দুপুর থেকে হোটেলে আড্ডা, নাচ আর গানের যে ঢেউ উঠলো তা থামলো রাত ১১টায়, হ্যাঁ কারফিউর মধ্যেই। ফুলুদা, সর্বানী, ইন্দ্রানী গগৈ পানিফুকন (গুয়াহাটি), রাজেশ বোস, জয়, মধুমিতা, বাপন, তুহিনা কেউ বাদ নেই। অনেকদিন পর একই পরিবারের সদস্যরা একসাথে হলে যেমন সম্মেলনের আনন্দে ভেসে যাওয়া যায়, ঠিক তেমনটা। তার ঠিক পরমুহূর্ত থেকেই মনটা খারাপ হতে শুরু করলো স্বজন বিচ্ছেদের ভাবনায়, ঘরে ফেরার আকুলতার মাঝেও। ২১ জুলাই নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী আমরা সকালের খাবার খেয়ে রওনা হলাম, বন্ধুদের আলিঙ্গনের উষ্ণতায় বুক ভরে, প্রিয় শিল্পী-বন্ধু গৌতম চক্রবর্তীর মায়াভরা কণ্ঠে রাধারমণ দত্ত’র বিরহের গান শুনে শুনে চোখের জলে প্রাণকে ভিজিয়ে ফিরে এলাম এপারে, আমার দেশে। হাতের নাগালের মধ্যেও বন্ধুরা আস্তে আস্তে সীমান্তের ওপারে হারিয়ে গেল। ভালো থেকো বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ভাইয়েরা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker