Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
করোনা সুতপা ম্যাডামকেও নিয়ে গেল ! লিখেছেন আহমদ হাসান বড়ভূইয়া
//আহমদ হাসান বড়ভূইয়া//
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সহকর্মী রফিক আহমদ স্যার শেয়ার করলেন সুতপা চন্দ ম্যাডাম আর নেই৷ বিশ্বাস হচ্ছিল না। শংকর (চৌধুরী)-দাকে জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হলাম।
ম্যাডামের সাথে পরিচয় আজ থেকে সম্ভবত ১৯ বছর আগে ২০০২ সালে বাউয়ারঘাট আদর্শ বিদ্যাপীঠে। আমরা তখন ছোট। সেভেন, এইট, নাইনে টানা তিনবছর তিনি আমাদের ইংরেজি পড়িয়েছেন। Middle School Grammar এর অনেক টপিক যেমন Parts of speech, Article, Number,, Gender, Case ইত্যাদির সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় ম্যাডামের সূত্র ধরেই ।
শিক্ষকদের মধ্যে যেসব গুণাবলি থাকা দরকার ম্যাডামের সবটাই ছিল। শৃঙ্খলা রক্ষা, নীতিনিয়ম মেনে চলা ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। ঘড়ির কাঁটার প্রতি লক্ষ্য রেখে ঘন্টা বাজার সাথে সাথে ক্লাসে ঢুকতেন। ক্লাসে ঢুকে সময় অপচয় করতেন না। পরীক্ষার আগে কোর্স শেষ করার জন্য আমাদের চেয়ে তিনিই বেশি টেনশন করতেন। পড়া আদায় করতে না পারলে কড়া শাসনের পাশাপাশি যারা পড়ায় মনযোগী ছিল তাদের বেশ স্নেহ করতেন।
একবার সুহায়েল স্যার অসুস্থ ছিলেন। আমরা কয়েকজন হাইলাকান্দি সিভিল হাসপাতালে স্যারকে দেখতে গিয়েছিলাম। পাশেই ছিল ম্যাডামের বাড়ি। আমরা উঠলাম। তিনি আমাদের দেখে বেশ খুশি হয়েছিলেন। কে কোন ক্লাসে পড়ি, রোল নম্বর কত, ক্লাসে কে বেশি উৎপাত করি, কার স্বভাব কীরকম ইত্যাদি বর্ণনা করে করে আমাদেরকে তাঁর মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আপ্যায়ণও করেছিলেন।
মনে আছে, ক্লাস সেভেনে ম্যাডাম Discipline রচনা লিখিয়েছিলেন। বলেছিলাম, এতো লম্বা, তিন পৃষ্ঠা, শিখব কী করে! তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন, এটা শুধু সেভেন নয়, মেট্রিকেও আসতে পারে। মন দিয়ে মুখস্থ করো। দেখবে ফাইনালে লেটার পাবে। আমাদের সময় বাংলা, ইংরেজি রচনায় ১০ মার্ক থাকত। এখনকার মতো প্যারাগ্রাফ রাইটিং ছিল না। সৌভাগ্যক্রমে ২০০৮ সালের মাধ্যমিকে Discipline রচনাটাই এসেছিল এবং ম্যাডামের শেখানো সেই ক্লাস সেভেনের রচনা পরীক্ষায় লিখেছিলাম, যা ছাত্রদের সামনে আজও গর্বের সাথে বলি। ইংরেজিতে লেটারও পেয়েছিলাম তাঁর আশীর্বাদে।
ম্যাডাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষার পেপার দেখতেন। প্রতিটা বানানে আধা মার্ক কাটতেন। হয়তো সেজন্যই আজ কিছু লিখলে এলোপাতাড়ি বানান ভুল হয় না।
স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর একদিন বাসে দেখা পেয়েছিলাম ম্যাডামের, সম্ভবত তিন বছর আগে। আমার স্কুল কোথায়, বোনেরা কেমন আছে, কার চাকরি কোথায় হয়েছে ইত্যাদি জিজ্ঞেস করেছিলেন। ফেসবুকের কোনও এক লেখায় একদিন মন্তব্য করেছিলেন, তোমাদের মতো কয়েকজনকে পাঠদান করতে পেরে আমি গর্বিত। তারপর আর দেখা হয়নি। আজ শুনলাম, তিনি পাড়ি দিয়েছেন পরপারে।
মরণভাইরাস আমাদের ছেলেবেলার এই কারিগরকেও ছাড়েনি। স্মৃতিপটে ভেসে উঠল পুরোনো সেইসব দিনের কথা আর বিভিন্ন মুহূর্তগুলো। আমাদের স্কুলে যেসব ম্যাডাম দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করেছেন তন্মধ্যে সুতপা ম্যাডামই ছিলেন সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী।
মনে পড়ে, ম্যাডামের বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন। মারা যাওয়ার চারদিন পর স্কুলে এসেছিলেন। ক্লাসে গিয়ে তিনি মনমরা হয়ে বললেন, “দুদিনের দুনিয়া বড় ক্ষণস্থায়ী। বাবা দুদিন আগে ভালো ছিলেন, কী করে চলে গেলেন বুঝতেই পারছি না।”
আজ গ্রুপের ম্যাসেজে তাঁর মৃত্যুসংবাদ চোখে পড়তেই সেই কথাটা বারবার মনে পড়ছে, “দুদিনের দুনিয়াটা বড় ক্ষণস্থায়ী।” কে যেন একজন লিখেছিল,
‘সংসার মরুমাঝে কেহ কারো নয়
দুদিনের আসা যাওয়া পথে পরিচয়।’
মানুষ চলে যায়। রেখে যায় স্মৃতি। সৃষ্টির মাধ্যমেই ম্যাডাম বেঁচে থাকবেন শত শত ছাত্রের হৃদয়ে। ম্যাডামের আত্মার সদগতি কামনা করছি৷
(লেখক পেশায় শিক্ষক ও সমাজকর্মী)