Barak UpdatesHappeningsFeature Story

ছাপার কাজ নেই বললেই চলে, আক্ষেপ ‘সফল প্রকাশক’ পুণ্যপ্রিয় চৌধুরীর

সাক্ষাৎকারে নানা প্রসঙ্গ তুলে আনলেন ডা. হিমব্রত দাস

Dr. Himabrata Das

পুণ্যপ্রিয় চৌধুরী৷ একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা৷ আজ এই অঞ্চলের মুদ্রণ শিল্পের অগ্রণীদের অন্যতম৷ তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে ওয়েটুবরাক-এর হয়ে কথা বললেন ডা. হিমব্রত দাস

প্রশ্ন: অতিমারি মুদ্রণ বা প্রকাশনা শিল্পে কতটা প্রভাব ফেলেছে? এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার কোনও উপায় ভেবেছেন কি?
পুণ্যপ্রিয়: ২০২০ সালের মহামারি শুধু আমাদের প্রকাশনা ব্যবসা নয়, সমগ্র বিশ্বের সবরকম ব্যবসা আজ এক বিশাল সংকটে। আমাদের প্রকাশনা ও ছাপা ব্যবসা মূলত গ্রাহকের চাহিদার উপর নির্ভরশীল। আজ জীবনধারণের প্রয়ােজন ছাড়া বাকি সবরকম চাহিদা বা প্রয়ােজন পরিত্যক্ত। বিগত কয়েক মাস ও আগামী কত মাস যে এই মহামারির প্রকোপ সহ্য করতে হবে, তা নির্দিষ্ট করে বিশেষজ্ঞরাও বলতে পারছেন না।

বর্তমানে ছাপার কাজ নেই বললেই চলে। বই প্রকাশনাও বন্ধ। যদিও বা কারও প্রয়ােজন হয় তাহলেও ভাল গুণগতমানের কাগজের অভাবে বিলম্ব হচ্ছে। কারণ শুধু এ অঞ্চল নয়, সর্বত্র উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। সাথে সাথে পরিবহন ব্যবস্থাও পর্যুদস্ত। সামগ্রিকভাবে সর্বক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাভাবিক অবস্থা না ফিরলে বই প্রকাশনার ক্ষেত্রও স্বাভাবিক হবে না। আমাদের ক্ষুদ্র প্রকাশনা ব্যবসায়ও কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। এক-পঞ্চমাংশ কর্মীদের নিয়ে কাজ চলছে।

মহামারিতে বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক সচল স্বাচ্ছন্দ্য সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রভাব আমাদের এই প্রকাশনা সংস্থা ও ছাপাখানায় বিশাল প্রভাব ফেলেছে। ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখাই এখন মূল বিষয় হয়ে সামনে এসেছে। এটা শুধু প্রকাশনা ব্যবসা নয়, সব রকমের ব্যবসার নব্বই শতাংশের কাছে এক বিরাট সংকট। এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ পর্যাপ্ত নগদ অর্থের যােগান সুনিশ্চিত করা। সরকারি ও বেসরকারি লগ্নীকারি সংস্থাকে এই সংকট উত্তরণের জন্য কম সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। সামগ্রিকভাবে ছােট ও মাঝারি ব্যবসার উত্তরণের জন্য সরকারি উদ্যোগ ও সদিচ্ছার প্রয়ােজন। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক পর্যায়ক্রমে ছােট ও মাঝারি ব্যবসা বা উৎপাদন ক্ষেত্রে নিয়ােজিত শিল্পের প্রয়ােজন নির্ধারণ করে নগদ অর্থ জোগান অত্যন্ত জরুরি প্রয়ােজন।

মােট কথা, নগদ অর্থের জোগান বর্তমান সংকটময় অবস্থা থেকে স্বাভাবিক আর্থিক অবস্থায় উত্তরণের পথ। পাশাপাশি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হাতেও অর্থের যােগান স্বাভাবিক করার জন্য নির্মাণ শিল্প সহ অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রেও পুনরায় কাজ শুরু করার মাধ্যমে নিযুক্তি নিশ্চিতকরণ দরকার। এই মহামারির প্রভাবে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কর্মহীন লােকেদের পুনরায় কাজে বহাল সুনিশ্চিত করা দরকার। সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ জোগানের মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টি করা দরকার। ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টি না হয়ে শুধুমাত্র ব্যবসা ও শিল্পের উৎপাদন স্বাভাবিক হলে গােটা আর্থিক পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে না৷

প্রশ্ন: আপনি তো একসময়ের বিশাল ছাত্রনেতা৷ ওই দিনগুলির কথা মনে পড়ে? আজকের ছাত্ররাজনীতিকে কীভাবে দেখেন?
পুণ্যপ্রিয়: জরুরি অবস্থার সময় স্কুলছাত্র ছিলাম। জরুরি অবস্থা পরবর্তী সময় রাজনৈতিক বােধের জন্ম হয়। ১৯৭২ সালের ভাষা আন্দোলনেও ছােট ক্লাসের ছাত্র হিসাবে মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করি। জরুরি অবস্থায় নেতিবাচক দিক গণতান্ত্রিক কার্যকলাপ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীতে সারা দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আসাম রাজ্যে বিদেশি খেদা আন্দোলনে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রতিবাদী মন ছাত্র আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। বামপন্থী সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। প্রায় এক দশকের উপর ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থেকে বিভিন্ন দাবি আদায়ের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করি।

আমার ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের সময় জেলায় (বৃহত্তর কাছাড়) চার হাজার সদস্য থেকে দশ হাজার সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওই সময় আশির দশকে বরাক উপত্যকায় শিক্ষার পরিবেশ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে পড়ে। সময়মত পরীক্ষা গ্রহণ বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল, ছাত্রছাত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশে সময়মত পরীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি দাবিতে আন্দোলন করে ছাত্র ফেডারেশন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণ আসামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে ছাত্র ফেডারেশন আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ছাত্র ফেডারেশন মনে করে, শিক্ষা রাজ্য তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােতে যুক্তরাষ্ট্রের বিন্যাস শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। উল্লেখযােগ্য ঘটনার মধ্যে ১৯৮২ সালে রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন।

ওই সময় পুলিশের গুলিচালনায় রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের ছাত্র সাগর দত্ত ও দীপক শর্মা শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। বরাক উপত্যকা ব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। সাগর দত্ত ও দীপক শর্মা বরাক উপত্যকার ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহিদদ্বয়। বহু বছর পর গৌহাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার রায়ে অধ্যক্ষ জুয়েল চৌধুরী ও পুলিশ সাবইন্সপেক্টরকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করে। ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির অগণতান্ত্রিক ধারা, বিশেষ করে ৬ নং ধারা বাতিলের দাবিতে ছাত্র ফেডারেশন উপত্যকাব্যাপী তীব্র ও ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই সময়ের আন্দোলনে উপত্যকার জনজীবন উত্তাল হয়ে ওঠে। বৃহত্তর কাছাড় জেলার প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ তখন ছাত্র ফেডারেশনের দখলে ছিল। কলেজগুলি ছাত্র সংসদ পরিচালনার জন্য নতুন করে সংবিধানের খসড়া তৈরি করে, নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। সংঘবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চালনা করার এক সুষ্ঠু প্রয়াস ছিল তখন।

১৯৮৬ সালের সেবা সার্কুলারের বিরুদ্ধে ছাত্র ফেডারেশন এককভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ওই সময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্তের সফরসূচিকে কেন্দ্র করে বনধে করিমগঞ্জে গুলি চালনায় জগন ও যিশু পুলিশের গুলিতে শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। করিমগঞ্জে পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্র ফেডারেশন আন্দোলন গড়ে তোলে। শিলচর রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র ফেডারেশনের দখলে ছিল। ১৯৮৭ সালে মুম্বাইতে সর্বভারতীয় টেকনিক্যাল স্টুডেন্টদের কনভেনশন হয়েছিল শিক্ষাকে বৃত্তিমুখী করার দাবিতে ৷ নয়া শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে, ‘সকলের জন্য শিক্ষা ও সকলের জন্য কাজে’র দাবিতে দেশব্যাপী কর্মসূচির সঙ্গে এই উপত্যকায়ও ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়।

এখন সেমিস্টার পদ্ধতির জন্য এমনিতেই ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার জন্য চাপের মধ্যে থাকে। অন্যদিকে লিংডাে কমিশন ছাত্র আন্দোলনে অবাঞ্ছিত অ-ছাত্রদের বহিষ্কারের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার একটি ইতিবাচক দিক আছে। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিধিনিষেধে তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও নব্বইর দশকে অধিক মাত্রায় পণ্যানয়, বাজারমনস্কতা, সর্বোপরি প্রতিযােগিতার মনােভাব ছাত্রছাত্রীদের অধিক মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হিসেবে গড়ে তােলার পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সততা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনস্কতা বিদ্যমান৷ তবু সাধারণ প্রেক্ষাপটে এতদঞ্চলে ওই ধরনের ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে না। কিন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে যেমন জেএনউ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে বা হচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এই উপত্যকা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনেও পিছিয়ে আছে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

প্রশ্ন: আপনার এই প্রকাশনা শিল্পে কীভাবে আসা? কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আজকের জায়গায় এসেছেন?
পুণ্যপ্রিয়: মূলতঃ ছাপাখানার মালিক হিসেবে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করি। সেই প্রেক্ষিতেই মুদ্রণের পাশাপাশি প্রকাশনার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছি। ক্ষুদ্র পরিকাঠামাে ও পরিবেশে বই প্রকাশ এক কঠিন কাজ। কারণ প্রকাশিত বইয়ের তুলনা হয় বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে। সেইক্ষেত্রে ভাল কাগজে ছাপা ও ভাল বাঁধাই ইত্যাদির ভিত্তিতে গুণ বিচার করা হয়। সব ধরনের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আছে৷ যেমন গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের বই প্রকাশ করা কঠিন কাজ। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রকাশিত বইয়ের সাথে প্রতিযােগিতায় এই ক্ষুদ্র সংস্থাটিও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: আপনি অনেক পণ্ডিতব্যক্তিদের লেখা প্রকাশ করেছেন৷ তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজের দুই-একটি অভিজ্ঞতা আমাদের শোনাবেন?
পুণ্যপ্রিয়: ড০ প্রভাস ভট্টাচার্য, ড০ বাণীপ্রসন্ন মিশ্র, অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য, সঞ্জীব দেবলস্কর, দেবব্রত চৌধুরী, বিবেকানন্দ মহন্তের মত বিদ্বানদের বই প্রকাশ করেছি৷ প্রায় চারশ বই প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে বই বিপণনের ক্ষেত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু বই প্রকাশ করলেই শেষ নয়, সঠিক বিপণনের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া এক বিশাল কাজ। প্রকাশনা ও বিপণনের সুবাদেই ওইসব লেখকদের অনুপম সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

প্রশ্ন: মুদ্রণ থেকে এখন অনলাইনেরই গুরুত্ব বাড়ছে৷ আপনার কি মনে হয়, মুদ্রণ এখন অতীত হতে চলেছে?
পুণ্যপ্রিয়: হ্যাঁ, এখন অনলাইন বা ডিজিটাল বইয়ের প্রতি ঝোঁক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ক্ষেত্রে বই প্রকাশের ব্যয়ভার কমে গেছে। তাই এর প্রতি বিশেষ ঝোঁক। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বই পড়ার যে আনন্দ তা ডিজিটাল বইপাঠে অনুভূত হয় না। কোথায় যেন খামতি থেকে যায়! আমার বিশ্বাস, সে কারণেই বই প্রকাশের বিষয়টি বজায় থাকবে। তবে পাঠকের চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রেখে একটি ডিজিটাল ভার্সন প্রকাশের প্রয়ােজন আছে বলে আমার মনে হয়। সেইজন্য আমাদের মত ক্ষুদ্র সংস্থাও ডিজিটাল ভার্সন চালু করার বিষয়টি চিন্তাভাবনা করছি।

প্রশ্ন: আপনার কোন্ ইতিবাচক ভূমিকা আপনাকে এমন ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দিয়েছে?
পুণ্যপ্রিয়: গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে উন্নতমানে ছাপা, বাঁধাইসম্পন্ন দ্রব্য নায্যমূল্যে সরবরাহ করা।

হিমব্রত: আপনার ব্যবসার উত্তরোত্তর সাফল্য করি৷ আর এর মধ্য দিয়ে বরাক উপত্যকার প্রকাশনা শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হোক৷

পুণ্যপ্রিয়: ধন্যবাদ৷

**Dr. Himabrata Das, Registrar, Department of Psychiatry, Tezpur Medical College & Hospital (TMCH). Apart from this, he is a vivid lover of sports, an eloquent commentator and a columnist. 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker