Barak UpdatesBreaking News
ভোটকর্মীর আতঙ্ক ধুয়ে মুছে দিয়েছে যে আতিথেয়তাReal life experience of a Presiding Officer
(প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরি থেকে)
–ভাস্করজ্যোতি দাস–
২১ এপ্রিল : ছোটোবেলা থেকেই, বাড়িতে একটা রাজনৈতিক আবহ দেখে বড় হয়েছিলাম। তার উপর জাতে বাঙালি, সুতরাং রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ থাকবে না, তা হতে পারে না। কিন্তু রাজনীতিকে ভালোবাসলেও রাজনৈতিক হিংসা প্রতিহিংসাগুলো বড় ব্যাথা দিত মনে। ভোট এলেই কিছু মানুষ মরবে, এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে যখনই নির্বাচনের শঙ্খ বাজে, বুকটা ভয়ে কেঁপে ওঠে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের তাজা স্মৃতি, যা মোটেও ভালো নয় তার উপর যখন প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে নিযুক্তির চিঠি পেলাম, খুশি হলাম কিন্তু মুহূর্তে বুকটা কেঁপে উঠল। তবুও এ বয়স বড় ভয়ংকর, যেখানে ভয়, সেখানেই যেতে ইচ্ছে হয়। সুতরাং প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম, গন্তব্যে পৌঁছবার।
ডি কোড করেছিলাম একদম সাতসকালে। তারপর টিম এর অন্যদের খোঁজা, জিনিস সংগ্রহ করে মিলিয়ে নেওয়া, গাড়ি খোঁজা… সব হ্যাঁপা কাটিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বেলা একটা নাগাদ উঠলাম গাড়িতে। আমাদের জন্য একটা ম্যাজিক গাড়ি বরাদ্দ ছিল। যাওয়ার পথে সবুজ পাহাড়গুলির মাঝখান দিয়ে মসৃণ পিচের রাস্তা, আমাদের নিয়ে গভীরে প্রবেশ করছিল।
বাক্স পেট্রা মেশিন নিয়ে পৌঁছলাম পি এস…. কালাবাগান চা বাগান নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাহাড়ের চূড়ায় স্কুল, একটু একটু নীচে লোকের বসতি। স্কুলের সামনে বিরাট ফাঁকা জায়গা, মাঠ বলা যেতে পারে, সামনে বিরাট একটা নাচঘর, একটা পিএইচই আছে, যা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
স্পট দেখে তো আমি বিরাট খুশি, কিন্তু খেয়াল করলাম, এলাকা বিদ্যুৎবিহীন। পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই এলাকার লোকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। সবাই কৌতূহলী, সহজ সরল বাগানের শ্রমিকদের প্রশ্নগুলোও ভীষণ সহজ, কেমন যেন মায়া মাখানো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব গুছিয়ে নিলাম। স্থানীয় বাসিন্দারা জলের ব্যবস্থা করে দিলেন। বহুদূর ছড়া থেকে কাঁধে করে জল এনে দিয়েছিলেন। আমার মতো শহরের জটিল মনের মানুষের এই পরিশ্রমের, উদারতার, ভালোবাসার কোনও সঠিক ডেফিনেশন জানা ছিল না।
সেক্টর অফিসার হিসাবে যাকে পেয়েছিলাম, তিনি আমাকে অবাক করে নিজের টাকায় জেনারেটারের ব্যবস্থা করেছিলেন, মিনারেল ওয়াটার এনেছিলেন। নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে অন্যের সুবিধা করে দেওয়া, এমন সরকারি অফিসার আমি প্রথম দেখলাম।
ভালো সহকর্মী পেয়েছিলাম, যে দুজন পুলিশ সঙ্গে ছিল, তাদের ব্যবহারও যথেষ্ট সহযোগিতাপূর্ণ। স্কুলের রাঁধুনি রান্না করে দিয়েছে, আমরা খেয়েছি, ছবি উঠেছি, একটা জম্পেশ পিকনিক ভাব। সবাই মিলেমিশে খুব আনন্দ করে দিন কাটালাম। শত আনন্দের মাঝেও আমি প্রিসাইডিং অফিসার সেটা ভুললে হবে না। তিনজন পোলিং অফিসার, দুজন পুলিশ এবং মেশিনের দায়িত্ব আমার। রাতে ঘুম ভালোভাবে হয়নি, একটা টেনশন তো ছিলোই।
সবকিছু কাটিয়ে শান্তিতেই সব সেরে নিলাম। স্থানীয় মানুষ সত্যিকারের ভাল। ভোটার আইডি কার্ড ছাড়া একটা মানুষও ভোট দিতে আসেননি, কেউ ঝামেলা পাকাননি। আমি গল্প করতে ভালোবাসি, মাঝে মাঝে গল্প করেছি… ওরা খুব সহজেই আপন করে নিয়েছে। ৪০% হিন্দু বাঙালি ৬০% হিন্দু চা শ্রমিক মানুষের মাঝখানে আমি একসময় ওদের হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু একসময় বিদায় নিতে তো হবেই। ঠিক ৫টায় সব সিল করে বেরিয়ে এলাম… ছবি উঠলাম.. ওরা বারবার আমাকে থাকার অনুরোধ করছিল, রাতে লোকাল মুরগি খাবার নেমতন্ন। কিন্তু মাথায় তখনও দায়িত্বের বোঝা। নেমে এলাম পাহাড় থেকে, সবাইকে পেছনে রেখে।
গাড়ি আবার ছুটছে, আকাশকে লালে লাল করে সন্ধ্যা নামছে। ভাবছিলাম পঞ্চায়েত নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা, আর এই নির্বাচনের ভালোবাসা প্রাপ্তির কথা। সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো, নেট্রিপ পৌঁছে কাজকর্ম সেরে, মাছ ভাত খেয়ে…. ঘর পৌছলাম। এখনও স্বপ্ন দেখছি পাহাড়ের ভালোবাসায়, গরীব চা শ্রমিকদের আদরে যত্নে, সমতলের কুটিল জটিল মানুষও সহজ সরল হয়ে যাচ্ছে। জানি তা সম্ভব নয়… অনুভব করেছি… পাহাড় এখনও সুন্দর, শহরের প্রদূষনে আর অতিরিক্ত আলোতে আমাদের চোখ ঝলসে গেছে।
ভারতীয় রাজনীতি এবং সংসদীয় গণতন্ত্রে এই চিত্র স্বাভাবিক বা গড় চিত্র নয়। সততার সঙ্গে বললে, এর উল্টো। সংবাদপত্র যতোই “শান্তিপূর্ণ নির্বাচন” প্রচার করুক, গভীরে অন্য সত্যই থাকে। উল্টো এই রীতির মাঝে আমার অভিজ্ঞতা সুখকর, কিন্তু এই দুই পর্যায়ের মাঝেই বহু হিংসা, রিগিং, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোটের খবর এসেছে, যা মোটেও গণতন্ত্রের জন্য সুখবর নয়। আরও পাঁচ পর্যায়ের ভোট বাকি, জানিনা পরিস্থিতি কেমন হবে। তবে সরকারি কর্মীদের মনে নির্বাচনে ডিঊটি নিয়ে যে আতঙ্ক থাকে, তা আমারও ছিল। কিন্তু এ যাত্রার অভিজ্ঞতা সব আতঙ্ক ধুয়ে মুছে সরে গিয়েছে। সত্যি, আমার এই অভিজ্ঞতা যদি সব সরকারি কর্মীর হতো, তাহলে নির্বাচন নিয়ে সেই আতঙ্ক থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমি মনে প্রাণে শুধু চাই, আমার অভিজ্ঞতা সবার হোক, হিংসা প্রতিহিংসার পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন আসুক, গনতন্ত্র বাঁচুক, মানুষ বাঁচুক।