Barak UpdatesAnalyticsBreaking NewsFeature Story
স্বামীদের বিদেশি বলে ধরে নিয়ে যাওয়ায় সমাজচ্যুত কামাখ্যাদেবী, যূথিকা দাসরা
আগে কুষ্ঠরোগীদের সমাজচ্যুত করে রাখা হতো। এখনও এইডসে আক্রান্ত শুনলে অনেকে অহেতুক নাক সিঁটকান। অসমের কাছাড় জেলায় আমড়াঘাটের কামাখ্যা দেবী বা যূথিকা দাসদের বাড়িতে কারও কোনওকালে কুষ্ঠরোগ হয়নি। নেই এইডসের সংক্রমণও। এমনকী, পরিবারের কারও নামে কোনও সামাজিক কলঙ্কও নেই। তবু তাঁরা সমাজচ্যুত। কারণ একটাই, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল তাঁদের স্বামীকে বিদেশি বলে রায় দিয়েছে। প্রতিবেশীদের বক্তব্য, কোনও ঘৃণা বা বিদ্বেষে নয়। তাঁরা আতঙ্কে ভুগেন, ‘বিদেশি পরিবার’-এর সঙ্গে মেলামেশার কথা পুলিশ জানলে যদি তাঁদেরও সন্দেহ করে।
৯ মাস আগে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষিত হন ৬৫ বছর বয়সী সবজি ব্যবসায়ী কুমুদরাম। পুলিশ পরে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দিয়েছে। তখনই তাঁরা জানতে পারেন বিদেশি নোটিশের কথা। একই কথা শোনান পাড়ার যূথিকা দাসও। ‘স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে একবারও কেউ কোনও কাগজপত্র দেখতে চাননি। এনআরসি-র প্রথম খসড়ায় পরিবারের সকলের নাম রয়েছে, সে কথাটাও কাউকে বলার সুযোগ হয়নি।’
কুমুদবাবুর পরিবারের সদস্যদেরও একই অভিযোগ, ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে (নির্বাচক খণ্ড ১২১, সিরিয়াল নম্বর ১০১০)। এখনও তা দেখানোরই সুযোগ মেলেনি তাঁদের। আপিল মামলার শুনানি এখনও শুরুই হয়নি। একদিন বিচারক ছুটিতে তো অন্যদিন আইনজীবীর সমস্যা। এরই মধ্যে সর্বস্ব খুইয়ে খাওয়া-পরার সঙ্কটে। ব্যাঙ্কে ৫০ হাজার টাকার স্থায়ী আমানত ছিল। সুদ ছেড়ে দিয়েই তুলতে হয়েছে। চারটি গরু ছিল, সস্তা দরে বিক্রি করেছেন। স্ত্রী কামাখ্যাদেবীর কথায়, ‘কী করব, কারও সঙ্গে কোনও কথা বলতে গেলেই টাকা লাগে।’
এখনও ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে কুমুদবাবুর চার ভাই সহ বাড়ির মোট ১১ জনের নামে। এর মধ্যে রয়েছে তাঁর বড় ছেলেও। বাবাকে জেলে পোরার পরে সে আর রাতে বাড়িতে ঘুমোয় না। কামাখ্যাদেবীর কাছে এর চেয়ে বেশি কষ্টকর ঠেকে, পাড়ার কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁদের ডাকা হয় না বলে। এমনকী, তাঁদের জামাতার সঙ্গেও প্রতিবেশীরা কথা বলেন না।
যূথিকাদেবীর আরেক সমস্যা। মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী। বাবাই তাঁর সবকিছু দেখভাল করতেন। তাঁকে না দেখতে পেয়ে তাঁকে সামলানোই কঠিন হয়ে পড়ে। কাউকে ডেকে কথা বলবেন, এরও জো নেই। পাড়ার মানুষ অবশ্য সমাজচ্যুত করে রাখার কথা মানতে চান না। তবে তাঁরা যে গত নয়মাসে ওই দুই বাড়িতে যাননি, তা স্বীকার করেন। কেন যাননি, একেকজনের একেক জবাব।
মাঝে মাত্র একদিন। ৩০ জুলাই সকাল ১০টায় অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-র চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ হবে। চরম উতকণ্ঠায় তাঁরা।
এ অবশ্য সত্যি, অসমের বাঙালিরা এনআরসি-র জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিয়েও স্বস্তিতে নেই। কারণ প্রথম খসড়ায় অনেকের নাম ওঠেনি। বাদ গিয়েছেন এমন বহু বিশিষ্টজন, যাঁদের নথি পরীক্ষার প্রয়োজনই ছিল না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে ভিত্তিবর্ষ ধরে তৈরি হচ্ছে এই নাগরিক পঞ্জি। অথচ কুমুদবাবুদের মতো একতরফা রায়ে বিদেশি বা ডি ভোটার (অর্থাত সন্দেহভাজন)-দের হাতে এর আগের নথিপত্র রয়েছে। কিন্তু এনআরসি-র রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা প্রথমে জানিয়েছিলেন, ডি ভোটারদের নাম এনআরসি-তে থাকবে না। পরে ঘোষণা করেন, ডি ভোটারের পরিবারেরই কারও নাম থাকবে না।
যূথিকাদেবীদের প্রশ্ন, প্রয়োজনীয় নথি হাতে রেখে ডি ভোটার কি আমরা স্বেচ্ছায় হয়েছি। না হলে এর দায় আমরা কেন ভুগব। কেন বাদ যাবে আমার ছেলে-মেয়ের নাম এনআরসি থেকে। জবাব নেই কারও কাছে।
প্রথম খসড়া প্রকাশের পর ডি বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন বিজেপি বিধায়ক কিশোর নাথ। ২০দিনের মাথায় তিনি অবশ্য ট্রাইব্যুনালে গিয়ে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণে সক্ষম হন। এই জায়গাতেও প্রশ্ন, কয়জনের ভাগ্যে আর ২০দিনের মাথায় রায় পাওয়ার সুযোগ মেলে!