Barak UpdatesHappeningsBreaking News

৬৮ বছর মৌন, ৫৩ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে! শ্যামানন্দ আশ্রমের কর্তাবাবার জীবনাবসান

ওয়েটুবরাক, ১৯ নভেম্বরঃ ৬৮ বছর মৌনব্রত পালন করে সোমবার রাত দুইটায় প্রয়াত হলেন শিলচর শ্যামানন্দ আশ্রমের কর্তাবাবা। সন্ন্যাসপূর্ব জীবনে তাঁর নাম ছিল জিতেন্দ্র ব্রহ্মচারী, পরবর্তী সময়ে শিবানন্দ স্বামী নাম গ্রহণ করেন। আগে-পরে যে নামই থাক, সকলের কাছে তিনি কর্তাবাবা বলেই পরিচিত ছিলেন।  মঙ্গলবার ভোর থেকে ভক্তদের দর্শনের মধ্যেই বেলা সাড়ে দশটায় তাঁর সমাধির প্রস্তুতি শুরু হয়। বেলা দেড়টায় হয় পূর্ণ সমাধি।

কর্তাবাবা মৌনগ্রহণের প্রথম ১৫-১৬ বছর শ্লেটে বা কাগজে লিখে দর্শনার্থীদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। ফাঁকা জায়গায় হাত ঘুরিয়েও তিনি প্রয়োজনীয় কথা বোঝাতেন। ১৯৭১ সালে তা বন্ধ করে দেন। মানুষের সামনে আসাই ছেড়ে দেন তখন।

গত ৫২-৫৩ বছরে তাঁকে, বলতে গেলে, একবারই দেখা গিয়েছিল। ২০০৯ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাঁকে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।ডা. সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য জানান, তখন তাঁর বুকে পেসমেকার বসানো হয়েছিল। তবে দশবছর পরে ফের গিয়ে এর ব্যাটারি বদলে ছিলেন তিনি। মাস চারেক আগেও সাউথ সিটি হাসপাতালে গিয়ে হাঁটুর যন্ত্রণার ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন। কিন্তু পরের দুইবার কেউ জানতেই পারেননি তাঁর বেরনোর কথা। একই ভাবে তাঁর মায়ের মৃত্যুদিনেও ঘনিষ্ঠতর বৃত্তের বাইরে কারও দেখার সুযোগ হয়নি তাঁকে। সে দিন তিনি আশ্রমপ্রাঙ্গণেই মা হেমন্তকুমারী দেবীর মুখাগ্নি করেন, পরে ভেতরে ঢুকে পড়েন।

তবে একেবারেই কাউকে দেখা দিতেন না, সে কথা বলা যায় না। দুজনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ৯৯ বছরের মৌনীবাবার। তাঁরা হলেন, সজল চক্রবর্তী ও কাজল চক্রবর্তী। এই দুই ভাইয়ের মধ্য দিয়েই শ্যামানন্দ আশ্রম পরিচালনা করতেন তিনি।

আবার দিন-রাত নিজের কুঠুরিতে আটকে থাকতেন তিনি, এমনও নয়। গভীর রাতে কখনও মন্দিরের এদিক-ওদিক ঘুরে দেখতেন। প্রতিদিন ভোরে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মন্দিরে ঢুকে পুজো দিতেন। তখন আশ্রমের গেট পুরোপুরি বন্ধ থাকত। তিনি ঘরে ঢোকার পরেই মন্দিরের গেট খোলা হতো।

১৯৪৯ সালে শিলচরে শ্যামানন্দ আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয়। শুরু থেকেই ব্রহ্মচারী বাবা ছিলেন প্রধান কর্মকর্তা। বছর-ছয়েক পরেই তিনি মৌনব্রত গ্রহণ করেন। তবে মৌন রইলেন কি দর্শন বন্ধ করে দিলেন, সে বড় কথা নয়। আশ্রম পরিচালনার ব্যাপারে সমস্ত সিদ্ধান্ত তিনিই নিতেন। অন্যরা শুধু তাঁর সিদ্ধান্ত কার্যকর করতেন।

আকারে-ইঙ্গিতে তিনি কাজল-সজলবাবুদের সমস্ত কথা বুঝিয়ে দিতেন। এতদিন ধরে দেখতে-দেখতে তাঁদের অবশ্য কোনও ইঙ্গিতই বোঝার বাকি থাকত না। তবু কিছু নির্দেশ কাগজে লিখে দিতেন। কর্তাবাবার কঠোর নির্দেশ ছিল, ‘ও সব প্রচার করো না।’ তাই ৬৮ বছর ধরে মৌন থাকলেও আশ্রমের কেউ এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।

স্বামী স্বরূপানন্দ ও স্বামী গহনানন্দ শিলচরে এসে শ্যামানন্দ আশ্রমে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, মৌন থাকলেও তাঁদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ভাব বিনিময় হয়।

আর তাঁর ব্রহ্মচারী-পূর্ব জীবনের কথা? ‘অবিভক্ত ভারতে বাংলাদেশের হবিগঞ্জে তাঁর বাড়ি ছিল’, এর বেশি এক বর্ণও বলতে চান না ভক্তরা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, বানিয়াচুঙের বিশাল এলাকায় জমিদারি ছিল তাঁদের। ছোট ভাইদের একজন কলকাতায় ব্যবসা করতেন।

আশ্রমের ভেতরের আবাসিক স্থলে দীর্ঘদিন কাটানো হিমাংশু দে বললেন, ‘তাঁর বহু কথা শুনেছি। কিন্তু একটি দিন দেখার সুযোগ মেলেনি।’ আরেক ভক্ত জানালেন, ‘এত বছর ধরে আশ্রমে আসি ব্রহ্মচারীকে প্রণাম করার বাসনায়। কিন্তু লাভ হয়নি। দেখা দেননি ব্রহ্মচারী।’

আশ্রম প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েই সাউথ সিটি হাসপাতালের কর্ণধার মৃদুল মজুমদার শোনান, পেসমেকার বসানোর সময় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়, এটাই সরকারি নিয়ম। কিন্তু কর্তাবাবার কোথায় আর কী কাগজ ! শেষে তখনকার জেলাশাসক গৌতম গাঙ্গুলিকে বিষয়টি বলতেই তিনি নিজে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেন। আশ্রমের পাশেই বসবাসকারী ৬৮ বছর বয়সী তাপস রায় বললেন, “আমি ছোটবেলা থেকে নিয়মিত আশ্রমে আসি। কখনও কথা বলতে দেখিনি তাঁকে।চারটি কাঠের তক্তা পেতে এর ওপর বহু পুরনো এক হরিণের চামড়া পেতে ঘুমোতেন।”

সকলের আক্ষেপ, শ্রাবণেই তিনি শতবর্ষে পা রাখতেন। এর ঠিক আগে তাঁর জীবনাবসান ঘটল!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker