Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
স্বজন হারানোর অব্যক্ত কান্না, লিখেছেন দীপক সেনগুপ্ত
২০ এপ্রিল : মুঠো ফোনে হঠাৎ ভেসে এল সেই মর্মান্তিক খবর, জয়িতা আর নেই। জয়িতা মানে জয়িতা ভট্টাচার্য, প্রয়াত রাজ্যসভা সাংসদ নৃপতি চৌধুরী ও করিমগঞ্জের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ লোপামুদ্রা চৌধুরীর কন্যা এবং বিখ্যাত সাইবার বিশেষজ্ঞ সুবিমল ভট্টাচার্যের স্ত্রী। এই পরিচয় যথেষ্ট নয়, জয়িতার নিজস্ব একটা পরিচয় ছিল ( ‘ছিল’ বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে) SENIOR FELLOW AT THE OBSERVER RESEARCH FOUNDATION। সীমান্ত শহর করিমগঞ্জ থেকে রাজধানীর মহানগরী, না এখানেই থামা নয়, দেশের সীমা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘নিজেকে’ মেলে ধরার ক্ষমতা জয়িতার ছিল। ‘নিজেকে’ শব্দটা নিছক ব্যক্তি জয়িতা নয়, এই শব্দের মধ্য সমাহিত জয়িতার দেশ, জয়িতার জন্মশহর, তাঁর রাষ্ট্র এবং সমাজ।
আন্তর্জাতিক সেমিনারে নিজের দেশের কথা এবং জাতীয় পরিসরে বিভিন্ন আলোচনা সভায়, টিভি’র প্যানেল আলোচনায় বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে নিজের জন্মশহর এবং বরাক উপত্যকার সুখ-দুঃখের কথা অত্যন্ত স্পষ্ট বক্তব্যে তুলে ধরত। নৃপতি চৌধুরী ছিলেন মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদ এবং বহমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব৷ জয়িতা বাবার থেকে পেয়েছে কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। মা লোপামুদ্রা চৌধুরী শুধুমাত্র শিক্ষাবিদই নন, তিনি অত্যন্ত সাহসিনী। ১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই পুলিশের গুলি চালনার পরবর্তী সময়ে বাঙালিদের উপর নেমে আসা বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন৷ জয়িতা মা’র থেকে পেয়েছিল সাহস ও আত্মবিশ্বাস। জীবনসঙ্গী সুবিমল ভট্টাচার্যের থেকে পেয়েছিল আধুনিকতার পাঠ।
বহুমাত্রিক সত্তার সমন্বয়ে তৈরি জয়িতার চেতনে অবচেতনে ছিল এই উপত্যকার প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা। জীবনসঙ্গী সুবিমলকে অনুপ্রেরণা দিয়ে তৈরি করেছিল একটি তথ্যচিত্র (ডকুমেন্টারি ফিল্ম), যে তথ্যচিত্রের বিষয় ছিল কাঁটাতারের বেড়ায় আবদ্ধ মানুষের জীবন যন্ত্রণার সাতকাহন। জয়িতা ছিল বরাক উপত্যকার নবীন প্রজন্মের সাংস্কৃতিক কর্মীদের শ্রদ্ধার, ভালোবাসার বৌদি বা দিদি এবং অগ্রজদের জয়ু। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সরকারি স্তরের আলোচনায় জয়িতা ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতো। এনআরসি পরবর্তী সময়ে উদ্ভুত সমস্যায় বাঙালিদের সুখ-দুঃখের কথা অত্যন্ত সংবেদনশীলতা নিয়ে বোঝার চেষ্টা করতো এবং যথাযথ জায়গায় তুলে ধরতো।
ফেসবুকে দেখছি, জয়িতার চলে যাওয়ার দুঃখে শ্রদ্ধার্ঘের ঢল । অজস্র স্মৃতিচারণে জয়িতাকে খুঁজে পাচ্ছি ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে । একজন লিখছেন, জয়িতা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠাবান গবেষিকা, অন্যজন লিখছেন জয়িতার বন্ধুবাৎসল্যের কথা। জয়িতার চলে যাওয়ার বয়স হয়নি, তবু চলে গেল। এই চলে যাওয়ায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হল সেই শূন্যতা পরিবারকে অতিক্রম করে সমাজ ও দেশে বিরাট ক্ষত তৈরি করল ।
মৃত্যুমিছিলের খবরে অভ্যস্ত মনও কোনও কোনও খবরে অসাড় হয়, জয়িতার মৃত্যুসংবাদে এক বিমূঢ় অসহায়তা আমার নিজের অস্তিত্বকে অসাড় করে দিল । আমাকে ‘কাকু’ সম্বোধনে ডাকতো। না আর হয়তো শুনবো না জয়িতার গলায় এই ডাক, তবে অবচেতনে এই ডাক অনন্তকাল ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে, এটা নিশ্চিত।