Barak UpdatesHappeningsBreaking News
সুদর্শনের স্মৃতিচারণ আমার জীবনের অন্যতম কঠিন কাজ, লিখেছেন ড. গঙ্গেশ ভট্টাচার্য
//ড. গঙ্গেশ ভট্টাচার্য//
শিক্ষক সুদর্শন, সমাজ ও ছাত্রদরদী সুদর্শন, সংবাদ পরিবেশক সুদর্শন, শিক্ষক সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়া সুদর্শন, রসিক সুদর্শন, যে নামেই ডাকুন সর্বোপরি আপাদমস্তক একজন বড় ভালো মানুষ সুদর্শন৷ প্রিয় বন্ধু সুদর্শনকে নিয়ে আজ যখন কলম হাতে নিয়েছি, তখন সে আমাদের মধ্যে নেই। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে সদাহাস্য সুদর্শন এই সবুজ পৃথিবীকে বিদায় জানাবে, আর তার স্মৃতিচারণ আমাকে লিখতে হবে, তা কল্পনাতীত ছিল৷ এটা আমার জীবনের অন্যতম কঠিন কাজ। কারণ ৩০ বছরের পুঞ্জিভূত অসংখ্য স্মৃতি আমাকে স্থবির ও বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।
এই ছোট্ট পরিসরে আমার দেখা রোগা-পটকা সুদর্শন থেকে শুরু করে শ্মশানঘাটে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করা সুদর্শন সম্পর্কে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তার এই অকাল মৃত্যু, তার বন্ধু মহলে, পরিচিত মহলে, শিক্ষক সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে, ছাত্রছাত্রী, সমাজ ও ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে যে শূন্যতা ও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, তা পূরণ হওয়ার নয়। যে কোনও সমস্যার সহজ সমাধান ছিল তার হাতের মুঠোয়। শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে সুদর্শন শুধুমাত্র নিজেকে একজন সফল শিক্ষক হিসেবে আবদ্ধ করে রাখেনি, বরং শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রকে আরও শক্তিশালী-অবাধ ও সুষ্ঠু করে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেছে। বরাক উপত্যকার প্রায় প্রতিটি কলেজের সঙ্গে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এর পেছনে ছিল ব্যক্তি সুদর্শনের দৃঢ়চেতা, ব্যক্তিত্ব, সহজ- সরল ভাষায় নিজের বক্তব্যকে উপস্থাপন করার অপরিসীম দক্ষতা, সবাইকে আপন করার ক্ষমতা এবং সর্বোপরি সুদর্শনের প্রবল জনসংযোগ এবং গ্রহণযোগ্যতা। বলতে গেলে, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সুদর্শন। স্নাতক স্তরে বর্তমানের সিবিসিএস পাঠ্যক্রমের গঠন প্রণালী তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সে । বিশেষ করে স্নাতক স্তরে ইতিহাসের পাঠ্যক্রম তৈরি করার ক্ষেত্রে তাকে দিনরাত কাজ করতে দেখেছি। এই পাঠ্যক্রম নির্ধারিত করার ক্ষেত্রে ওর সোজাসাপটা বক্তব্য ছিল,এমন একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে যার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের কাছে সহজভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয় এবং বরাক উপত্যকার ইতিহাস চর্চা আরও সমৃদ্ধ হয়।
শিক্ষকতার পাশাপাশি যে বিষয়টি সুদর্শনকে খুব বেশি আকৃষ্ট করত তা হল সংবাদ জগৎ। ব্যস্ততম জীবনের ফাঁকেও সংবাদ জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল সুদর্শন। ২০০৪ সালে বিটিএন নিউজ চ্যানেল বাংলা সংবাদের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। চার মাস পর অর্থাৎ সে বছরের এপ্রিল মাসে বিটিএনে ইংরাজি সংবাদ শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কর্ণধার মনীষ দাসের সম্মতিক্রমে আমি সুদর্শনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইংরাজি সংবাদ পরিচালনার অনুরোধ জানাই। বিনা পারিশ্রমিকে দায়িত্ব গ্রহণে রাজি হয় সুদর্শন। সুদর্শনের তৎপরতায় দুদিন পর থেকেই বিটিএনে ইংরাজি সংবাদ যাত্রা শুরু করে। সে সময় থেকেই আমাদের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। বিটিএনকে কীভাবে উন্নত ও প্রসারিত করে সমৃদ্ধ করা যায়, সে নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হত। প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও হার না মেনে লক্ষ্যে পৌঁছার তীব্র মানসিকতা খুঁজে পেয়েছিলাম সুদর্শনের মধ্যে। দৃঢ়চেতা, মেধাবী, প্রতিভাবান, ইংরাজিতে দক্ষ এবং কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমস্ত গুণ সুদর্শনের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। ইংরাজি সংবাদের স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ে যেমন দক্ষ ছিল, সমান তালে সংবাদ পাঠকের ভূমিকায়ও তার জুড়ি মেলা ভার। বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিখুঁতভাবে সঞ্চালনা করত বাকপটু সুদর্শন। বিটিএনের প্রতিজন কর্মীর সঙ্গে সুদর্শনের সম্পর্ক নিবিড় ছিল। ওর কথা বলার ধরন এবং রসিকতা সবাইকে আকৃষ্ট করত । ২০০৪ এবং ২০০৭ সালের বন্যা, ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন বা মুন্না মজুমদার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে শিলচরে কারফিউ জারি হওয়ার সময়কালীন সংবাদ সম্প্রচার, সঞ্চালনা বা সরাসরি অনুষ্ঠান সবকিছুতেই সুদর্শনের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বিভিন্ন সময়ে আমরা অসুবিধার সম্মুখীন হলেও মৃদুভাষী সুদর্শনের হালকা ও সহজ- সরল উত্তর ছিল “চিন্তা করিস না হয়ে যাবে” । সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখার একটা প্রবণতা ছিল সুদর্শনের মধ্যে। তাই ওয়েটুবরাক প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সুদর্শন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কিছু সময় আগে পর্যন্তও ওয়েটুবরাকের মাধ্যমে সংবাদ জগৎ তথা পাঠকের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছিল।
বন্ধুত্বের পাশাপাশি আমরা দুজনই ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় সুদর্শনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠতর হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নতির জন্য সুদর্শন ছিল সদা সচেষ্ট। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার আগের দিন গভীর রাতেও সুদর্শনের বাড়িতে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ নানা আলোচনার মধ্যেই উঠে আসে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে তার গভীর ভাবনার কথা। ২০২৩ সাল থেকে শুরু হতে যাওয়া স্নাতক কোর্সের গঠন প্রণালী ও সিলেবাস নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়। সুদর্শন বলে, এসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীর উন্নতির কথা মাথায় রেখে সিলেবাস তৈরি করতে হবে।
লক্ষ্যে অবিচল ও সিদ্ধান্তে অটল থাকার মানসিকতা ছিল তার। সবাইকে নিয়ে কাজ করার এক অনন্য কারিগর ছিল সদা হাস্যময় সুদর্শন। অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে সবাইকে আপন করে নেওয়ার দক্ষতা ছিল তার মধ্যে। অত্যধিক কাজের চাপ সত্বেও কোন ব্যক্তি সহায়তা চাইলে কখনও ফিরিয়ে দিত না। সব ক্ষেত্রেই মুশকিল আসান ছিল সুদর্শন। প্রচন্ড ব্যস্তময় জীবনের ফাঁকেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরিচিতদের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেছিল। কর্মতৎপর সুদর্শনের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বা যারা ওর সংস্পর্শে এসেছেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা কখনই সুদর্শনকে ভুলতে পারবেন না, কোনও না কোনভাবে তাদের মননে, তাদের স্মৃতির কোঠায় সুদর্শন কোনও না কোনও সময় উঁকি দেবেন।
প্রায় ৩০ বছরের পরম বন্ধুকে আচমকা হারিয়ে আজ আমি অনেকটাই নিঃস্ব। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও আমার অদম্য বিশ্বাস ছিল সুদর্শন অপরাজিত, সে হার মানতে পারে না। কারণ হার না মানার তীব্র মানসিকতা নিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই লড়াই করতে পারদর্শী ছিল সুদর্শন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, জীবন যুদ্ধের শেষ দশ দিন হাসপাতালে মৃত্যুদূতের সঙ্গে লড়াইয়ে সুদর্শনকে হার মানতে হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি সকাল ৭টা ১০ মিনিটে যখন হাসপাতালের ভেন্টিলেশন কক্ষে প্রবেশ করে সুদর্শনের শারীরিক অবস্থা আরও অবনতি হতে প্রত্যক্ষ করি, তখন আমি প্রথমবারের মতো বুঝতে পারি যে সুদর্শন জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অজান্তেই আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে, ভেতর থেকে নীরবে নিভৃতে উচ্চারিত হয়, “বিদায় বন্ধু”। শেষ পর্যন্ত ১৪ জানুয়ারি সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে না ফেরার দেশে পাড়ি দেয় সে। সুদর্শনের জীবনের শেষ ১০ দিন হাসপাতালে তার সঙ্গে কাটানো সময়গুলি আমার জীবনের চরম বেদনাদায়ক ও হৃদয় বিদারক। স্বপ্নভঙ্গের তীব্র দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়েও বলছি, সুদর্শনকে পরম বন্ধু হিসেবে পাওয়ায় আমি গর্বিত। ৩০ বছরের স্মৃতিকথা মনের কোণের আড়ালে রেখেই বলছি, বীরের মত মৃত্যুবরণ করে সুদর্শন মৃত্যুকেও ছাপিয়ে গেছে। সুদর্শনের আত্মার চিরশান্তি হোক ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।
(ড. গঙ্গেশ ভট্টাচার্য উধারবন্দের জগন্নাথ সিং কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান)