Barak UpdatesHappeningsCultureBreaking News
লোকমঞ্চের দ্বি-দিবসীয় ধামাইল নৃত্য ও প্রতিযোগিতায় ব্যাপক সাড়া
ওয়েটুবরাক, ১৩ ফেব্রুয়ারি: লোকসংস্কৃতি কেবলমাত্র আত্মপরিচয় নয়, বরং সংস্কৃতি ও ভূগোলের চিহ্নের পরিচায়ক । লোকসংস্কৃতির লোক বলতে নির্দিষ্ট একই ভাষাভাষী ও একই জীবনদর্শনে বিশ্বাসী এক জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। রবিবার শিলচর শিশু উদ্যানে সম্মিলিত লোকমঞ্চ আয়োজিত দ্বি-দিবসীয় ধামাইল নৃত্য ও প্রতিযোগিতার সমাপণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এই মন্তব্য করেন বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক ও লেখক-অধ্যাপক ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্য।
এদিন সম্মিলিত লোকমঞ্চের সভাপতি ড. অনুপ কুমার রায়ের সভাপতিত্বে আয়োজিত আলোচনাচক্রের মুখ্য বক্তা অধ্যাপক ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্য তাঁর বক্তব্যে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বলেন, এই অঞ্চলের মানুষের মানসিকতা ও জীবনধারণের পদ্ধতি যদি জানতে হয় তবে সেই অঞ্চলের লোক সংস্কৃতি জানা অতি প্রয়োজন। তিনি বলেন, লোক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভূগোলের এক বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। লোকগান কেবলমাত্র গান নয়, এর সঙ্গে রয়েছে এক জীবনদর্শন। নিজেদের আত্মপরিচিতির প্রয়োজনে এবং ইতিহাসের প্রয়োজনে লোকসংস্কৃতি চর্চা অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে। আর এক্ষেত্রে সম্মিলিত লোকমঞ্চ শিলচর দ্বি-দিবসীয় ধামাইল নৃত্য ও প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার যোগ্য, মন্তব্য করেন ড. ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বাঙালির সংস্কৃতি বিগত দিনে কৃষিজীবনের মূল্যবোধের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল। কেননা বাঙালির সব অনুষ্ঠানের পেছনে ক্রিয়াশীল কৃষি। কিন্তু আজকের দিনে আমাদের সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞাপন। আজকের প্রজন্মের মূল্যবোধ গড়ে উঠছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে৷ ফলে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের প্রাচীনত্বের প্রতীক লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এবং তার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান অমলেন্দুবাবু।
রবিবার ছিল ধামাইল প্রতিযোগিতার অন্তিম দিন। দ্বি-দিবসীয় প্রতিযোগিতায় মোট ৩২টি দল অংশগ্রহণ করে । প্রথম পুরস্কার লাভ করে তারাপুর বিনাপাণি সম্প্রদায়, দ্বিতীয় দুধপাতিল নাট্য সংস্থা ও তৃতীয় রণফাঁড়ি শিববাড়ি ধামাইল গ্রুপ, পানিভরা। প্রতিযোগিতায় যৌথভাবে বিশেষ পুরস্কার লাভ করেছে মনমোহন মজুমদার বালিকা বিদ্যালয় ও ছোটলাল শেঠ স্কুল। প্রথম পুরস্কার হিসাবে স্বর্গীয় অশোক রানি দাস স্মৃতি পুরস্কার বাবদ নগদ ১০,০০০ টাকা, স্মারক ও শংসাপত্র তুলে দেওয়া হয়৷ স্মারক ও অর্থ স্পন্সর করেন সংস্থার উপ-সভাপতি রসরাজ দাস এবং নিজ হাতে শিল্পীদের পুরস্কার তুলে দেন। দ্বিতীয় পুরস্কার হিসাবে স্বর্গীয় সুরুচি নাথ স্মৃতি পুরস্কার বাবদ নগদ ৭,০০০ টাকা, স্মারক ও শংসাপত্র তুলে দেন সুরুচি নাথের পুত্র পিনাকপাণি নাথ, তৃতীয় পুরস্কার স্বর্গীয় মোঃ আব্দুল বারি স্মৃতি স্মারক পুরস্কার বাবদ নগদ ৫,০০০ টাকা, স্মারক ও শংসাপত্র প্রদান করা হয়। পুরস্কার, স্মারক ও অর্থ স্পন্সর করেন তাঁর পুত্র লোকগবেষক মোঃ মহবুবুল বারি৷ তাঁর হয়ে শিল্পীদের পুরস্কার তুলে দেন সংস্থার সভাপতি ড. অনুপ কুমার রায় । বিশেষ পুরস্কার হিসাবে যৌথভাবে দুটি দলকে স্বর্গীয় মীরা রানী নাথ স্মৃতি পুরস্কার হিসাবে নগদ ৪,০০০ টাকা, স্মারক ও শংসাপত্র তুলে দেওয়া হয়৷ পুরস্কার তুলে দেন ঝিমলি নাথ। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলগুলি হলো পারমিতা সঙ্গীতালয় তারাপুর, শিবানী সংঘ বিবেকানন্দ রোড, নবদুর্গা ধামাইল সম্প্রদায় মেহেরপুর নরসিংপুর, নরসিংপুর মঞ্জুরী সম্প্রদায়, নৃত্যাঙ্গন স্বামীজি রোড, আশুতোষ গ্রুপ পানিভরা, উনিশের প্রেরণা বিবেকানন্দ রোড, রাধারাণী ধামাইল দল চাতলা শ্যামপুর, মনসা সম্প্রদায় আশ্রম রোড, পূর্ব্বাশার আলো সংস্থা চিরিপুল, মা সারদামণি ধামাইল গ্রুপ ইটখলা, কৃষ্ণকলি ধামাইল সংস্থা তারাপুর নেতাজি নগর, রাধাকৃষ্ণ গ্রুপ লক্ষীপুর, নয়নতারা ডান্স গ্রুপ জয়পুর রাজাবাজার, দীপা সম্প্রদায় আশ্রম রোড, অষ্টসখী বৃন্দা বিবেকানন্দ রোড, পঞ্চানন কলা নিকেতন মালুগ্রাম, প্রয়াস ২য় লিংক রোড, দীশান্ত ডান্স গ্রুপ স্বামিজি রোড, বাঁশরিয়া সংস্থা মধুরাঘাট, মুন্নী দাস গ্রুপ মালুগ্রাম, পয়লাপুল সংগীত বিদ্যালয়, অষ্টসখী সম্প্রদায় নরসিংপুর এবং ভগবতী গ্রুপ রাঙিরখাঁড়ি । দুইদিন ব্যাপি চলা ধামাইল নৃত্য ও প্রতিযোগিতার বিচারক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন শিলচর সংগীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা নন্দিনী চক্রবর্তী, নৃত্যশিল্পী সৌমিত্র শঙ্কর চৌধুরী এবং বিনাচ্ছন্দম সংগীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ দেবতোষ নাথ।
দ্বি-দিবসীয় ধামাইল নৃত্য ও প্রতিযোগিতাকে সামনে রেখে সন্ধ্যায় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী বিধান লস্কর, মঞ্জুশ্রী দাস, মঙ্গলা নাথ, মনিমিতা গোস্বামী, দুলন পালিত সহ সম্মিলিত লোকমঞ্চের শিল্পীবৃন্দ লোকসংগীত পরিবেশন করেন। কি-বোর্ডে লোক সংগীতের সুর বাজিয়ে শোনান মধুমিতা দাস। শেষ লগ্নে অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন প্রবীণ মহিলা ও তারাপুর গাঁও পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সভানেত্রী বিনাপাণি নাথ। তিনি মঞ্চে ধামাইল গান ও সঙ্গে ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করে গোটা অনুষ্ঠানস্থল মাতিয়ে তোলেন।
সবশেষে অনুষ্ঠিত হয় পুরস্কার বিতরণী সভা। প্রতিযোগী দলের শিল্পীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন লোক গবেষক ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সম্মিলিত লোকমঞ্চের সভাপতি ড. অনুপ কুমার রায়, কার্যকরী সভাপতি শ্যামলি কর, উপ-সভাপতি রসরাজ দাস, সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর দাস, আহ্বায়ক কৃষ্ণেন্দু নাথ, যুগ্ম আহ্বায়ক কানাইলাল দাস, অফিস ইনচার্জ পিনাকপাণি নাথ, সদস্য মনোরঞ্জন মালাকার, চঞ্চল ভট্টাচার্য, সহ লোকমঞ্চের সদস্য যথাক্রমে ঝিমলি নাথ, অঙ্কিতা ভট্টাচার্য, সুমনা দাস, কমলেশ দাশ প্রমুখ। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন লোকমঞ্চের সদস্য তথা সাংবাদিক দেবাশিস পুরকায়স্থ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন যথাক্রমে সুদীপা নাথ, ভাস্কর দাস ও সপ্তমিতা নাথ।
উল্লেখ্য, দীপ প্রজ্জ্বলন করে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন কবি সাংবাদিক অতীন দাশ ও লোকশিল্পী নৃপেন্দ্র কুমার দাস। রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে ঘুরে বেড়ানো দৃষ্টিহীন শিল্পী শ্রীহরি দাসকেও সংস্থার পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানের প্রথম দিন মঞ্চে সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানের প্রথম দিন ধন্যবাদ সূচক বক্তব্য রাখেন উপ-সভাপতি রসরাজ দাস।