Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
বিধ্বংসী বন্যায় বিধ্বস্ত শিলচর, অসহায় আমরা, লিখেছেন মানস ভট্টাচার্য
বন্যার্তের ডায়েরি (এক)
(বন্যার্তের ডায়েরিতে মানস ভট্টাচার্য কয়েক কিস্তিতে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন৷ আজ প্রথম কিস্তি৷)
বৃহস্পতিবার ( ১৭ জুন ‘২২ ইং ) থেকেই প্রবল বৃষ্টি । ঘর থেকে বেরনোর উপায় ছিল না । শিলচর দাস কলোনিতে প্রতিটি গলির রাস্তাও ডুবে গিয়েছিল। শনিবার বিকেলে বৃষ্টি থামল। পরদিন সুন্দর সকাল– ভাবলাম বাজার করে নিই, পরে জল উঠাব। দুইদিন মোটর চালাইনি। উপরে দুই হাজার লিটারের ট্যাঙ্ক, এক্সট্রা পাঁচশো লিটারের আরেকটি। চা খেয়ে বেরনো মাত্র শুনি চারিদিকে হইহল্লা– খুব স্পিডে জল আসছে। যদিও এর আগের দুইদিন অনেকবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে, শহরের কাছাকাছি বেতুকান্দি বাঁধ দিয়ে প্রবল বেগে জল ঢুকছে। শহর ডুবতে পারে । কিন্তু ঝলমল সকাল দেখে আমি কনফিউজড্ হয়ে যাই । কোনওভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, বাঁধ ভেঙে শহরে জল প্রবেশ করতে পারে।
দুই দিনের প্রবল বৃষ্টিতে বাসায় জল ঢুকেছিল, জলে থাকায় স্কুটারও স্টার্ট হচ্ছিল না। দৌড়ে দোকানে গেলাম। যদিও বেশির ভাগ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ভালো পরিমাণেই ঘরে ছিল, এক দুটো ছিল না। দোকানে এতো ভিড় যে ঢোকার উপায় নেই– এই সিচুয়েশন্ সবদিনই আমি অ্যাভয়েড্ করি। এভাবে হুড়মুড় করে কিছু কেনা বা করা আমার একদমই ভালো লাগে না। কিন্তু নিরূপায়। করতেই হবে। অনেক কষ্টে কিছু জিনিস কিনে বাসায় ফিরি। আসার পথে কয়েক কেজি সব্জিও নিয়ে আসি । তখনও আশেপাশে কোথাও জলের চিহ্ন পর্যন্ত নেই । মনে মনে আশ্বস্ত হলাম, আবার কিছুটা শঙ্কিতও ।
সকালের টিফিন খাওয়ার পরে পরেই দেখি, গলির দুপাশের নালা ফুলে উঠছে । জল আসার পূর্ব লক্ষণ। বুঝতে আর বাকি রইল না যে জল আসছে । তখনও কিন্তু সম্ভাব্য প্রলয় সম্পর্কে মন কোনও বিপদসঙ্কেত দেয়নি । এর আগে ২০০৭ সালে বড় বন্যা হয়েছিল । বেরেঙ্গা-র বাঁধ ভেঙে শহর ডুবে গিয়েছিল । আর ১৯৮৫ সালের ভয়ঙ্কর বন্যার সময় তো এখানে ছিলাম না। ২০০৭-এর বন্যায় ঘরে জল উঠেনি। বাসায় ঢুকেছিল, বেশ কয়েকদিন জল ছিল। তাই, এবার ওভার-কনফিডেন্ট্ ছিলাম, ঘরে উঠবে না ।
মূহুর্তের মধ্যে সব কনফিডেন্স চুরমার হয়ে গেল । তখন সকাল ১০টা ২০ । জল ঢোকা শুরু হয়ে গেছে । ইতিমধ্যে ইলেক্ট্রিসিটিও চলে গেছে । জল ওঠানো গেল না। গলি ডুবে যাচ্ছে । কী কারেন্ট ! জলের তান্ডব! চোখের নিমেষে একের পর এক সিঁড়ি জলের তলায় ।
ত্রয়ী-কে (আমার মেয়ে) ডাকলাম। অঞ্জনা (মিসেস) চটপট স্নান সেরে দেবতাদের দোতলায় ঠাকুর ঘরে নিয়ে গেল। আমি ডিভানগুলো খুলছি। এটা ওটা উপরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যুদ্ধকালীন অবস্থা। কিছুতেই যেন জিনিস উঠানো শেষ করা যাচ্ছে না । ত্রয়ী খুব টায়ার্ড ফিল করছে । আমরাও । এত টেনশন, বোঝানো সম্ভব নয় । জল যেন আমাদের ঘরকে ঘিরে ধরেছে । এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটা। ঘরে জল ঢুকছে। মূহুর্তের মধ্যেই ঘর প্লাবিত হয়ে গেল। নিদারুণ বেদনায় কাতর হয়ে পড়লাম । আমাদের স্বপ্নের ঘর, এতো প্রিয় ঘর– “অর্যমন”-ও শেষে জলমগ্ন ! কয়েক মিনিটের মধ্যেই খর-স্রোতে আমরা দিশেহারা! প্রকৃতির রোষ। মেনে নিতেই হবে। এ ছাড়া পথ নেই । আমরা একেবারেই অসহায় । এখন শুধু প্রাণে বাঁচা, আর সবকিছু বাঁচাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করা । নজরে না-থাকা কতো ছোটোখাটো জিনিস এদিক সেদিক ভাসছে, নয়তো ডুবছে । কোনটা বাঁচাবো আর কোনটা নয়, ভাবার সময় নেই ।
নতুন তৈরি, আমার প্রিয় ডিভান, ত্রয়ীর প্রাইজের শোকেস, আমার লেখার টেবিল, স্কুটার, অনেক বাসনপত্র, সোফাসেট, ফ্রিজ ইত্যাদি সহ আরও কতো কিছু জলের তলায় । জলের উচ্চতা ক্রমে বেড়েই চলছে । আগ্রাসী জল সব গিলে নিতে চায় । দারুণ উৎকণ্ঠা, ভীতি আর দুশ্চিন্তা আমাকে অক্টোপাসের মতো চেপে ধরে, আমি চরম অবসাদগ্রস্ত । নড়ার সামান্য ক্ষমতাটুকুও নেই । সবাই বিধ্বস্ত । জলের মধ্যেই গ্যাস সিলিন্ডার, উপরের তাকে রাখা অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র কোনওভাবে উঠাতে লাগলাম । গোদরেজ আলমিরা থেকেও সব কাপড়, ডক্যুমেন্টস্ ইত্যাদি মিসেস বের করে নিল । সেনিটারি লেট্রিন সিল করাও হলো । কারও শরীরেই আর একফোঁটাও শক্তি নেই। জলের মধ্যেই রয়ে গেল ফ্রিজ । আশিস (ছোট ভাই) বলছিল– ও হেল্প করবে না কি, উপরে উঠাব কি না ? আমি আর পারলাম না।
ভীষন ঠাণ্ডা জল। ঘরের মধ্যেও ভয় ভয় করছে । এর আগে জীবনে কখনও ঘরে জল দেখিনি । এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা । এত চেনা, এত প্রিয় অন্তরময় ঘরও যেন এখন কেমন অচেনা অন্ধ-গুহার মতো বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে। গলির জলে যেন মিনি বরাকের হিংস্র স্রোত।
আমার, কর্মপটীয়সী এবং আ্যজাইল সহধর্মিণী রান্না সেরে নিলে আমরা খেতে বসলাম। তখন বিকেল । চারদিকে স্তুপাকার জিনিসপত্র । প্রবল ঝড়ে উপড়ানো গাছের মতো পড়ে রয়েছি আমরা। কতো অসহায় ! অন্ধকার সব কিছু গ্রাস করে নিচ্ছে। ভয় আরও বেড়ে গেল যখন তূর্য-র (আমার ছেলে) কথায় খেয়াল হলো, আমাদের মিটার বক্স, এমসিবি (দেখার সুবিধার জন্য, এটা ওল্ড কনসেপ্ট্ ) গ্যারেজে অনেক নীচুতে লাগানো, যদিও ডিজিট্যাল মিটারের বেলায় এটা খাটে না।
আমাদের মনে একটাই প্রশ্ন- জল আর কতটুকু বাড়বে? আর কতটুকু ? সকাল থেকে ৬ ঘন্টায় প্রায় ৫ ফুট জল বেড়েছে । ………..
(ক্রমশ)