NE UpdatesBarak UpdatesHappeningsBreaking News

দাদাগিরি করেই অসমিয়া ভাষা আজ বিপন্ন, আক্ষেপ দেবব্রত শর্মার

ভাষার প্রশ্নে নেতাজির উদারনীতি আঁকড়ে ধরার পরামর্শ

ওয়েটুবরাক, ২৯ জানুয়ারি : আসামের ভাষারাজনীতি ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়েছিল, তা আজও অব্যাহত৷ নানা উদাহরণ টেনে রবিবার  এই কথা বললেন যোরহাট কলেজের অধ্যক্ষ, ভাষাতাত্ত্বিক ড. দেবব্রত শর্মা৷ তিনি এ দিন বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের দূর শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষা সমাপন অনুষ্ঠানে বীজভাষণ প্রদান করেন৷

তিনি বলেন, অসম সাহিত্য সভার ঘর ভেঙে পড়ছে, দৈন্যদশা বিরাজমান৷ এর তুলনায় বঙ্গভবন বড় চাকচিক্যময়৷ গ্রন্থাগার ঘুরে, দূরশিক্ষা কেন্দ্রের পাঠক্রম দেখে তিনি বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনকে “নক্ষত্রখচিত সংগঠন” বলে অভিহিত করেন৷
তিনি জানান, ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ করে ১৮৫৮ সালে পিয়ালি ফুকন সহ দুইজন শহিদ হন ব্রহ্মপুত্রে৷ বরাকে একই বছর প্রচুর শহিদ হন৷ চা শ্রমিকদের “মুলুক চলো” বরাক থেকে শুরু হয়েছিল৷ ফলে বরাক থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনুপ্রেরণা পেয়েছিল৷
তাঁর কথায়, ভাষা ইতিহাসের কথা বললেও বরাক থেকে শিক্ষা নিতে হয়৷ পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ যে কাজ করেছেন, তাতে আসামের ইতিহাসই উঠে এসেছে৷ রাজমোহন নাথের কথা উল্লেখ না করলে এ প্রসঙ্গে বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে থেকে যায়৷ অসমিয়ারা যখন ‘জয়মতী’ সম্পর্কে জানতে পারেননি, তখন বাংলায় চর্চা হয়েছে ‘জয়মতী’৷ হেমাঙ্গ বিশ্বাস ভূপেন হাজরিকাকে গণনাট্যের আঙিনায় নিয়ে এসেছিলেন৷
তিনি অসমিয়া-বাংলা ভাষারাজনীতির সূচনার উল্লেখ করে বলেন, ১৮২৬ সালে ইয়ান্ডাবু সন্ধির দশ বছর পরও ব্রিটিশ অসমের বিদ্যালয়, অফিসে অসমিয়া চালাত৷ এর দশ বছর পর তারাই বাংলা করেছিল৷ পরে আবার অসমিয়াকে ফেরানো হয়েছিল৷ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বলা হয়, বাঙালিরা ইংরেজকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ১৮৩৬ সালে তা করেছিল৷ অসমিয়া-বাংলার ব্যবধান জানত না ব্রিটিশরা, এটা বিশ্বাস করা যায় না৷ ব্রিটিশরা আসাম দখলের আগেই অসমিয়া ভাষার ওপর বিরাট গবেষণা করে৷ ফলে একথা স্পষ্ট, ব্রিটিশরা ইচ্ছাকৃত ভাবে বিভাজনের অঙ্কে একবার অসমিয়া, একবার বাংলা করেছে৷
দেবব্রত বলেন, ব্রিটিশরা জানত, হিন্দু-মুসলমান সংঘাতে হবে না, ভাষার প্রশ্নে সংঘাত জিইয়ে রাখতে হবে৷ বাঙালি-অসমিয়া উভয় জনগোষ্ঠী সেই ফাঁদে পা দিয়েছিল, তাতেই সংঘাত বেঁধে রয়েছে৷
উদাহরণ টেনে দেবব্রত জানান, যাদুরাম ডেকা বরুয়ার বাংলা-অসমিয়া শব্দকোষ লুকিয়ে রাখা হয়েছে সংঘাত বাঁধানোর জন্য৷ নইলে দুই ভাষাগোষ্ঠীর ব্যবধান কবে ঘুচে যেত৷ অসম সাহিত্য সভার নগেন শইকিয়াকেও তিনি এ ব্যাপারে দোষারোপ করেন৷ বলেন, রেভারেন্ড নাথান ব্রাউনের বইয়ের নামটাও বদলে দিল এরা! এগুলিকে ইতিহাসের বিকৃতি বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু উজান অসম দিয়ে অসমিয়া হয় না৷ তাঁর কথায়, “জনজাতিরা অসমিয়া গ্রহণ করতে পারত, আমাদের দাদাগিরির জন্য পারেনি৷ ১৯৬১-র ১৯ মে নিয়ে অসমিয়াদের আবেগ নেই৷ এ যেন অন্য গ্রহ!” দেবব্রত আক্ষেপের সঙ্গে শোনান, ১৭৯৫ সালে প্রথম অসমিয়া অভিধান হয়৷ হেমকোষের আগে মোট ১১টি অভিধান ছিল৷ সেগুলিকে কবর দিয়ে হেমকোষকেই প্রথম বলা হচ্ছে৷
তিনি বলেন, শুধু বরাকের একাদশ ভাষাশহিদ নয়, ১৯৬০-৬১ সালে ভাষাসংগ্রামে ব্রহ্মপুত্রে ১৫৪ জন প্রাণ হারান৷ ১৩২ জনই বাঙালি৷ শিশির নাগ নগাঁও একতা সভার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন৷ অসমিয়া ভাষার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন৷ তবু অসমিয়ারা তাকে খুন করেছিল৷ লেডি ম্যাকবেথের প্রসঙ্গ টেনে দেবব্রত খোলামেলা বলেন, “রক্তের দুর্গন্ধ কোনও পারফিউমে যায় না৷ আমিও একজন অসমিয়া হিসাবে সে দিনগুলির মহাভুল স্বীকার করছি৷ এ বার প্রায়শ্চিত্ত করেই নতুন দিন শুরু করা যেতে পারে৷” নাগা, গারো-খাসি, মিজোরা যে বেরিয়ে গেল, তা ১৯৬০ সালের ভাষা চাপানোরই ফল বলে স্পষ্ট মন্তব্য করেন৷ বলেন, দশ-এগারো বছর ধরে তারা যে আপত্তি করছিল, বাংলা-অসমিয়া সংঘাতে কেউ সেদিকে নজর দিল না৷ তাই তার পরামর্শ, ভাষা নিয়ে দাদাগিরি করতে নেই৷ ভাষা কখনও চাপাতে নেই৷
তা চাপানোর পরিণাম যে ভালো হয়নি, এর উল্লেখ করে জানান, অসমিয়া বিদ্যালয়েও এখন অসমিয়া চলবে না বলে নিদান দেওয়া হয়েছে৷ বিটিএডিতে অসমিয়ার জায়গা নেই৷ গণিত, বিজ্ঞান অসমিয়ায় হবে না বলে দেওয়া হয়েছে৷ বড়োরা বলছে, অসমিয়া লিপিতে লিখব না৷ বিভক্ত হলে রাজ্যটা হবে ৫০-৫০ শতাংশ৷ ডিমাসা-কারবি-মিসিংরা আগে বলেছিলেন, অসমিয়ায় লিখব আমরা৷ এখন রাভা এবং দেউরিরা শুধু লিখছে অসমিয়ায়, আর কেউ নয়৷
দেবব্রতর আহ্বান, ভাষাবিকাশে উপভাষাকে গুরুত্ব দিতে হবে৷ অন্য ভাষাভাষীরাও যাতে সেই উপভাষা গ্রহণ করতে পারে৷
তিনি নেতাজির ভাষানীতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, আজাদ হিন্দ ফৌজে অসমিয়ারা ছিলেন, ডিমাসারাও ছিলেন, শহিদ হয়েছেন৷ আজাদ হিন্দের প্রচারপত্র অসমিয়াতেও মুদ্রিত হয়েছিল৷ আসামের চা বাগান অঞ্চলে ওই অসমিয়া প্রচারপত্র নিয়ে এসেছিলেন তিন প্যারাশুটার৷ নেতাজির অস্থায়ী সরকার ভাষার উদারনীতি গ্রহণ করেছিলেন, এ কথা জানিয়ে ভাষাবিশারদ শর্মা বলেন, উদারনীতি আজও সেরা পন্থা৷ দাদাগিরি, দিদিগিরি চলবে না৷

অনুষ্ঠানে চার শিক্ষাবর্ষের মোট ৪৮৫জনকে বাংলা ডিপ্লোমা কোর্সের সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়৷ আচার্য বিভাসরঞ্জন চৌধুরী সহ অন্যান্য অতিথিবর্গ তাঁদের হাতে এই সার্টিফিকেট তুলে দেন৷ অতিথিদের মধ্যে ছিলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. সুপ্রবীর দত্তরায়, সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, গৌতমপ্রসাদ দত্ত, সব্যসাচী রায়, ইমাদউদ্দিন বুলবুল, তৈমুর রাজা চৌধুরী প্রমুখ৷ সভাপতিত্ব করেন দূর শিক্ষা কেন্দ্রের সঞ্চালক ড. পরিতোষ দত্ত৷ সঞ্চালনায় ছিলেন সব্যসাচী রুদ্র গুপ্ত৷

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker