Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
তৃষ্ণা নিয়ন্ত্রণ যে কী মুশকিল, তা বুঝতে পেরেছি ১৩-১৪ দিনে, লিখেছেন হিমাদ্রি শেখর দাস
বন্যার বিভীষিকা (তিন)
“Water, water, everywhere,
Nor any drop to drink…”
বন্যার জলের দিকে তাকালেই স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের বিখ্যাত কবিতার লাইনখানি মনে পড়ে যায়। চারিদিকে অথৈ জল, কিন্তু পান করার উপায় নেই। আমাদের জীবনে বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা যেন এই পরিস্থিতিতে একটু বেশিই বুঝতে পারছি। ঘরে পানীয় জলের স্টক খুব সীমিত থাকার কারণে জলতৃষ্ণাও অনেক বেড়ে গেছে। তৃষ্ণা নিয়ন্ত্রণ করা যে কী মুশকিল তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। মনকে এই ঝড়ের দেশ থেকে নিয়ে গেলাম বালুর দেশে। রাজস্থানের থর মরুভূমিতে বসবাসকারী মানুষের কথাই ভাবছি। এদের তো জল কষ্ট অনেক বেশি। তবুও তো ওরা টিঁকে থাকে। আমরাও নিশ্চয় পারবো। বৃষ্টির দেশে থাকি বলেই বোধ হয় পানীয় জলের বেহিসাব খরচ করাটা আমাদের মজ্জাগত রোগ হয়ে গেছে। আর তাই প্রকৃতি কিছুটা রুষ্ট হয়েছিলেন! পানীয় জলের গুরুত্ব উপলব্ধি করার শিক্ষাটাও তিনি দিয়ে গেলেন।
এমন হিসেব করে জলপান বোধ হয় এর আগে কোনও দিন করিনি। প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার কিছু টিপস্ জানা ছিলো বলেই জীবন রক্ষা হয়েছে। ঘরে ফিটকিরি আর ব্লিচিং ছিল৷ তাই বন্যার জল শোধন করে প্রাত্যহিক কাজ করা গেছে। টয়লেট আর স্নানের জল ম্যানেজ হয়ে গেলেও দু’দিন পর খাওয়ার জলের সমস্যা বেড়ে গেল। বৃষ্টির জল রিজার্ভারে জমিয়ে রাখার তেমন ব্যবস্থা নেই। অগত্যা সরকারি অথবা বেসরকারি সাহায্য ছাড়া আগামী কয়েকদিন বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে। প্রথম তিনদিন বন্যার জলের নট নড়নচড়ন দেখে মনে হয়েছে যে খুব শীঘ্র তিনি বিদায় নেবেন না।
মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখা কতটা জরুরি, তা এই মহাসংকটে বুঝতে পেরেছিলাম। মানুষের বিপদে মানুষ কীভাবে ছুটে আসে, তা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগও আবার এলো। পরিচিত আর অপরিচিত কিছু পরোপকারী মানুষ এই বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই হয়তো এই বিধ্বংসী বন্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে।
বন্যায় আমাদের অসুবিধার কথা নানাভাবে নানা মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পেরেছি। কিন্তু যারা করতে পারেননি তাদের কথাই এখন বলছি। এই বন্যায় গবাদি পশুরা যেভাবে কষ্ট পেয়েছে, সেটা বলে লাভ নেই। যাদের বাড়িতে বিড়াল, কুকুর বা পাখি পোষ্য হিসেবে রয়েছে তাঁরা অনেকটাই বুঝতে পেরেছেন। গ্রাম দেশে গরু, ছাগল, ভেড়া, ইত্যাদির অবস্থা খুব শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল। মূল সমস্যা হচ্ছিল গবাদি পশুর খাবার নিয়ে। যেখানে মানুষের খাবার জুটছে না, সেখানে অবলা পশুর খাবার কোথা থেকে জুটবে! বন্যার জল নেমে যাবার পর আমাদের পাড়ায় আশ্চর্যজনক ভাবে রাস্তার কুকুর আর বিড়াল গায়েব হয়ে গেছে। বন্যার জল ওদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো কে জানে!
২০ জুন, ২০২২। আমার প্রিয় পোষ্য সিম্বা ভোরবেলা থেকেই একটু উসখুস করছে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি। এদিকে ঠিক সাড়ে সাতটায় নিউজপেপার হকার এসে বললো যে, বেতুকান্দির বাঁধ ভেঙেছে। খুব তীব্র গতিতে শিলচর শহরে জল প্রবেশ করছে। সিম্বাকে বেঁধে আমাদের ঘর গোছানোর পালা শুরু হল। মাত্র দেড় ঘণ্টায় আমাদের ঘরে জল প্রবেশ করল। সিম্বা হতভম্ব হয়ে গেল। সর্বনাশের কাহিনী যে শুরু হতে চলেছে, তা হয়তো সে বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছে। তারপর আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে উপরতলায় আমাদের বাড়ির মালিকের ঘরে স্থানান্তরিত হলাম। সিম্বার ঠাঁই হলো সিঁড়িতে। উপরতলায় প্রায় প্রতিটি রুমে আমাদের আসবাবপত্রে ঠাসা। তাই সিঁড়িতেই রাখতে হয়েছে। সিম্বা অস্বাভাবিক ভাবে চুপ। সে চারিদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। এমন আজব ঘটনা সে জীবনে দেখেনি। সন্ধ্যার পর সিম্বা অন্ধকারে বসে রয়েছে । বেশ অবাক হলাম। সিম্বাকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আমরা বেঁধে রাখি না। কিন্তু প্রায় বারো ঘন্টা হতে চলল, কিন্তু সে বিরক্তি প্রকাশ করছে না। রাতে আমাদের ঘরেই সিম্বা ঘুমায়। সেই প্রথমদিন থেকে। কোনোদিন অন্য কোথাও ঘুমায়নি। ভাবছিলাম রাতে সিঁড়িতে একা ঘুমোতে পারবে কি না! হয়তো আমাদের ডাকবে। কিন্তু রাতে বিশেষ গণ্ডগোল করেনি। আর বাঁধন খুলে আসার চেষ্টাও করেনি।
পরদিন সিম্বার মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। সে প্রস্রাব বা পটির বেগ পেলেই আমাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিঁড়ি নোংরা করেনি। আর সেটা ১৩-তম দিন পর্যন্ত। প্রথম দুদিন সকালে বমি করেছিল। হয়তো একটু উদ্বেগের মধ্যেই ছিল সে। কিন্তু এরপর সব ঠিক। একদম নিয়মতান্ত্রিক ভাবে তার ১৩ দিন কেটেছে।
দুর্যোগের দ্বিতীয় রাতে আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিল। সিম্বা যথারীতি চিৎকার করে আমাদের জাগিয়ে তুলেছিল। আমরা নির্ভয়ে ঘুমিয়েছি। সারাটা রাত সে পাহারা দিয়েছিল। ডিউটিতে গাফিলতি করেনি। গেটে শব্দ হলেই সে ডেকে উঠতো। অচেনা কেউ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেনি।
মাছ বা মাংস সিম্বার পছন্দের খাবার। নিরামিষ হলে একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু দুর্যোগে সে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল। নিরামিষ খাবার দিব্যি খেয়েছে। এক অবলা পশুর পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেবার এমন প্রবণতা দেখে বেশ মুগ্ধ হলাম।
সিম্বাকে দেখে রাস্তার অন্য কুকুরের কথা ভাবতাম। তাদের যে কী কষ্ট! কেউ উদ্ধার করেছে কিনা এ খবরও পাইনি। আসলে জীবজন্তুর অসুবিধে সবচেয়ে বেশি হয়। এই বন্যা অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেলো।
(লেখক হিমাদ্রি শেখর দাস আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং প্রোক্টর)
Also Read: ঘরে জল ঢুকতে শুরু করল, বাকিটা ইতিহাস.., লিখেছেন হিমাদ্রি শেখর দাস