Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
কেন ডুবল শিলচর শহর, অনুসন্ধান করে লিখেছে মার্চ ফর সায়েন্স
ওয়েটুবরাক, ২২ জুলাই : বিজ্ঞান ভিত্তিক সংগঠন ‘মার্চ ফর সায়েন্স’, শিলচর চাপ্টার এবারের প্রলয়ঙ্করী বন্যার কারণ অনুসন্ধানে গত ১০ জুলাই থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত লাগাতার চারদিন শিলচরের তোপখানা থেকে সোনাবাড়িঘাট পর্যন্ত বরাক নদীর তীরে তীরে ৩২ কিলোমিটার জায়গা পায়ে হেঁটে সরজমিনে তথ্য অনুসন্ধান করে। আমরা, অনুসন্ধানকারী দলের সদস্যবৃন্দ, মূলত শিলচর শহরে বরাকের জল ঢোকার জায়গাগুলো খুঁজে পেতে নদী তীরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের এই তথ্য সংগ্রহের ফলাফল এবার জনসাধারণের সামনে তুলে ধরছি।
মজুমদার বাজার রেল সেতু পার হয়েই মূল রাস্তা বেঁকে গেছে বাঁদিকে। আগে রাস্তা সোজাই ছিল। কিন্তু ১৯৬৬’র বন্যায় নদী ভাঙ্গনের ফলে রাস্তা বাঁদিকে ঘুরিয়ে নিতে হয়েছে। এই রাস্তার পাশে দু-আড়াই ফুট উঁচু একটা বাঁধের মত দেওয়া হয়েছিল কোনও এক কালে, এখানে একটি ছোট স্লুইস গেটও আছে। পুরনো রাস্তার পাশে কাশিপুর নাথ পাড়া নামে একটি ছোট্ট আবাসিক এলাকা রয়েছে। এই নাথপাড়ার বাসিন্দাদের সোজা মেন রোডে ওঠার জন্য রয়েছে ছয়টি সরু রাস্তা৷ সেই রাস্তা দিয়ে বছরের পর বছর হাঁটার ফলে যে দু-আড়াই ফুট উঁচু বাঁধ ছিল, তা ছয়টি জায়গায় অনেকটাই নেমে গেছে। স্থানীয়দের বয়ান অনুযায়ী, কাশিপুর নাথ পাড়ার পশ্চিম প্রান্তে প্রায় ২৬০ মিটার জায়গা দিয়ে কমবেশি তিনফুট উঁচু হয়ে এবার জল ঢুকেছে নদীর কূল ছাপিয়ে। সেই জল মাছিমপুর যাওয়ার রাস্তা পেরিয়ে তোপখানা, দুর্গানগর, রামনগর, খেলমা, রামনগর আনুয়া, চিরুকান্দি, বিশফুটি, দেবগ্রাম ইত্যাদি ব্যাপক অঞ্চলকে প্লাবিত করেছে। এমন কী মালিনী বিল, চিরুবিল ইত্যাদিতে জল ঢুকে তা ভর্তি করে দেয়।
মজুমদার বাজারের স্কুলের সামনে থেকে নদী বাঁধ বেশ উঁচু এবং মজবুত থাকায় এদিকে জল সরাসরি ঢোকেনি। কিন্তু রায়গড় থেকে দেড়শ মিটার পূর্বে বাঁধ যেখানে উত্তরমুখী বাঁক নিচ্ছে, সেখানে প্রায় ত্রিশ মিটার জায়গা দিয়ে বাঁধ উপচে জল ঢুকতে শুরু করে। স্থানীয় মানুষেরা নিজেদের চেষ্টায় সিমেন্টের খালি বস্তায় মাটি ঢুকিয়ে জল আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এর আগেই প্রচুর জল ঢুকে যায়। রায়গড়ের এই পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ দিকে শিববাড়ি পর্যন্ত প্রায় ২৯০ মিটার জায়গায় কোনও বাঁধ নেই, শিববাড়ির জায়গাটুকুই শুধু উঁচু। কিন্তু বড়খলার প্রাক্তন বিধায়ক কিশোর নাথের বাড়ি থেকে দক্ষিণ দিকে আরও ২১০ মিটার জায়গায় প্রকৃতপক্ষে কোনও বাঁধ নেই। কানোই ইন্ডাস্ট্রিজ এবং এস এস রাইস মিলের পিছন দিক থেকে বাঁধ উপচে প্রচুর জল এদিকে ঢুকেছে। এদিকে মাটির তলা দিয়েও জল ঢুকেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
রেলস্টেশনের উত্তর দিকে একটি ছোট ও একটি বড় নালা রয়েছে। এই দুই নালা দিয়ে নদীর জল অন্নপূর্ণাঘাট পেট্রোল পাম্প এবং রোটারি ক্লাবের সামনে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ঢুকেছে। অন্নপূর্ণা ঘাট থেকে চৈতন্যনগর, ইটখোলা, বিবেকানন্দ স্কুল, চুনাভাট্টা রোড়, মালুগ্রাম, মধুরাঘাট, দেবীপ্রসাদ রোড, ডাইভারশন রোড হয়ে সদরঘাট পুরসভার অফিস পর্যন্ত দীর্ঘ বাঁধে আমরা মোট ১৪টি স্লুইস গেট পেয়েছি। এগুলোর মধ্যে ৮টি সচল রয়েছে। কিন্তু এইসব স্লুইস গেট পর্যন্ত আসার জন্য যে নালা নর্দমা রয়েছে, সেগুলো আবর্জনা জমে এবং জবরদখলের ফলে জল পরিবহণ করতে পারে না। তাছাড়া প্রতিটি স্লুইসগেটের তলা দিয়ে যে কালভার্ট রয়েছে, সেগুলি মাটি জমে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নদীর জল বেড়ে গেলেই এই ৮টি গেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে মালুগ্রাম এলাকা বৃষ্টির জমা জলে ডুবে যায়। চুনাভাট্টা রোডের শেষ মাথায় যে স্লুইসগেটটি রয়েছে, তার বাঁধের তলার বক্স কালভার্টটি ভেঙে যাওয়ায় এখানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। স্থানীয় মানুষেরা বালির বস্তা ফেলে সেই ভাঙন রোধ করেছেন। বি সি গুপ্তের বাড়ির সামনে যে স্লুইস গেটটি রয়েছে, সেটা দিয়ে ভিতরের জল বাইরে যায় না, উল্টো নদীর জল ভিতরে ঢোকে।
বরাক সেতুর নীচ থেকে শুরু করে সদরঘাট, গভর্নমেন্ট বয়েজ এইচ এস স্কুল হয়ে রুদ্র ট্রেডিং পর্যন্ত কোনও বাঁধ নেই। এই এলাকাটিতে নদীর পাড় স্বাভাবিক ভাবেই উঁচু থাকায় এদিক দিয়ে অবশ্য কোনও জল আজ অব্দি কোনও বন্যায়ই রাস্তা পেরিয়ে শহরে ঢোকেনি। জানিগঞ্জের রুদ্র ট্রেডিং নামক দোকান থেকে মহাবীর মার্গ, কালীবাড়ি চর, শুটকিপট্টি, হয়ে কাড়ারপার পর্যন্ত আর কোনো জায়গায় বাঁধ টপকে জল ঢোকেনি। কিন্তু কালীবাড়ি চর এলাকার তিনটি স্লুইস গেটের মধ্যে দুটির অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। প্রকৃত অর্থে এগুলো কোনও কাজই করে না।
কাড়ারপারে প্রায় ছয় ফুট জায়গায় বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছিল। পরে নদীর জলের স্রোতে সেই ছয় ফুট জায়গা প্রায় দশ মিটার চওড়া হয়ে মহিষা বিলে জল ঢুকেছে। কাড়ারপার পেরিয়ে বেতুকান্দি, বড়জুরাই, সাংজুরাই গ্রাম। এদিকেও উঁচু মজবুত বাঁধ থাকায় জল ঢোকার সুযোগ পায়নি। কিন্তু মহিষা বিলের জলে এই গ্রামগুলির নীচু এলাকা গুলিও কম বেশি প্লাবিত হয়েছে।
বড়জুরাই থেকে সাংজুরাই পর্যন্ত রাস্তাটিকে বাঁধ হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। কিন্তু সাংজুরাই, নয়াগ্রাম এলাকার রাস্তা (নয়া সড়ক) মোটেই জল আটকানোর মত উঁচু নয়। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা বাঘাডহর এলাকার দীর্ঘ বাঁধের। নয়া সড়কের ‘ফয়জুরের দোকান’ পয়েন্ট থেকে পূর্ব দিকে ১৬৭ মিটার ব্লক রাস্তায় ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যায় বাঘাডহর বাঁধের। এখান থেকে উত্তর হয়ে পূর্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া অংশে বাঁধের দৈর্ঘ প্রায় ১৮৩৬ মিটার। এই অংশে গত ত্রিশ বছরে কোনও কাজ হয়নি বলে অভিযোগ করলেন স্থানীয় মানুষ। বাঁধের চেহারা দেখলে তাদের অভিযোগ সত্য বলেই প্রতিভাত হয়। এই দীর্ঘ অংশে ছোট বড় মোট ১৬টি জায়গায় বাঁধ ডিঙিয়ে এক থেকে তিন ফুট উচ্চতায় জল ঢুকেছে। এই ১৬ টি জায়গার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০০ মিটার। ভেবে দেখুন, ৫০০ মিটার এলাকা দিয়ে যদি দুই ফুট উচ্চতায়ও জল ঢোকে, তা হলে সেই জলের মোট পরিমাণ কত হতে পারে। এই পুরো জলই গিয়ে পড়েছে মহিষা বিলে এবং সেখান থেকে রাঙ্গিরখাল হয়ে সেই জল এসেছে শহরে। এ তো গেল উত্তর হয়ে পূর্বের দিকে এগিয়ে যাওয়া বাঁধের কথা।
বাঁধের আরেকটি অংশ পূর্ব হয়ে দক্ষিণ দিকে গিয়ে বাদ্রিঘাট এলাকায় অর্ধনির্মিত বরাক সেতুর কাছে পুরোনো লক্ষ্মীপুর রোডে, বেরেঙ্গা প্রথম খণ্ডে গেছে। এই অংশের শুরুতেই ১৩০ মিটার জায়গা জুড়ে বরাকের জল বাঁধ টপকে ঢুকেছে মহিষা বিলে। স্থানীয় মানুষদের কথায় এখানে বাঁধের প্রায় দুই ফুট উপর দিয়ে জল ঢুকেছে। ৬৩৫ মিটার এগিয়ে যাওয়ার পর একটি স্লুইস গেট রয়েছে। মে মাসের বন্যায় সেখানে বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছিল তীব্র গতিতে। সামান্য মেরামতি করতে না করতেই জুন মাসে বন্যা এসে আবার এই দিক দিয়ে জল ঢুকতে শুরু করে। এখানে জ্লের উচ্চতা এত বেশি ছিল যে, কিছু কিছু বাড়ির টিনের চালের উপর প্রায় ৬/৭ ফুট জল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এই জলের পুরোটাই বিভিন্ন পথে মহিষা বিল এবং কিছু জল সরাসরি রাঙ্গিরখালে গিয়ে পড়েছে।
বাদ্রিঘাটের কাছে ওল্ড লক্ষ্মীপুর থেকে নদীবাঁধের আরেকটি অংশ শুরু হয়ে দক্ষিণ হয়ে পশ্চিম দিকে গেছে। এখানেও বাঁধ পেরিয়ে নদীর জল ঢুকেছে প্রায় ১৯০ মিটার জায়গা জুড়ে। এর মধ্যে প্রায় ত্রিশ মিটার জায়গা তো জলের তোড়ে ভেসেই গিয়েছিল। বাঁধ বলতে এই ত্রিশ মিটার জায়গায় কোনও কিছুর অস্তিত্বই ছিল না। এরপর প্রায় দু কিলোমিটার জায়গায় বাঁধ বেশ শক্তপোক্ত থাকায় জল ঢুকতে পারেনি। কিন্তু ক্যাটল মার্কেট বা গরুবাজার এলাকায় প্রায় চল্লিশ মিটার এলাকা জুড়ে জল ঢুকেছে বাঁধ ছাপিয়ে। এই জল গিয়ে পড়েছে রাঙ্গিরখালে। সেখান থেকে নতুন ভাবে নির্মিত বাঁধ দিয়ে মোটামুটি ১৯০ মিটার এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে সেই জায়গা, যেখানে প্রায় ৩৫ মিটার নীচু বাঁধ পেরিয়ে জল ঢুকেছে ভেতরে। এখানেও এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন জলের উচ্চতা দুইফুটের কাছাকাছি ছিল। এই জলও মাটির স্বাভাবিক ঢাল দিয়ে গিয়ে পড়েছে রাঙ্গিরখালে। তোপখানা থেকে শুরু করে যত জায়গায়ই জল ঢুকেছে, প্রতিটি জায়গায়ই শুধু স্থানীয় মানুষের মুখের কথায় জলের উচ্চতা আমাদের বিশ্বাস করতে হয়নি। সব জায়গাতেই কোথাও ঘরের দেওয়ালে, কোথাও বাঁশঝাড়ে, কোথাও সুপারি গাছের গায়ে নদীর ঘোলা জলের দাগ দেখেই আমরা ওইসব স্থানের জল ঢোকার উচ্চতা অনুমান করেছি।
এ ছাড়াও উত্তর কৃষ্ণপুর এলাকায়, নাগাটিলার রাস্তার বিপরীত দিকে গঙ্গাপুর ফেরিঘাটের সামনে ক্ষয়ে যাওয়া দুর্বল বাঁধ টপকে জল ঢুকেছে। সোনাবাড়িঘাটের সামনে শিলচর বাইপাসের জন্য বরাকের উপর নির্মীয়মাণ সেতুর পাশ দিয়ে মে মাসের বন্যায় যেভাবে জল ঢুকেছিল, সামান্য মেরামতি সত্বেও সেদিক দিয়ে জুন মাসের বন্যায়ও প্রচুর জল ঢুকেছে।
আপনারা ভেবে দেখুন, মহিষা বিল হয়ে রাঙ্গিরখালে এবং সরাসরি রাঙ্গিরখালে তা হলে কত জল নদী থেকে ঢুকেছে। কাড়ারপারের দশ মিটার জায়গা দিয়ে যদি দুই বা তিন মিটার উচ্চতায়ও জল ঢুকে, তবুও বিস্তীর্ণ বাঘাডহর এবং বেরেঙ্গা প্রথম খণ্ডের টুকরো টুকরো এইসব জায়গা দিয়ে বাঁধ ছাপিয়ে যে পরিমাণ জল শহরে ঢুকেছে, তা কি কাড়ারপারের চেয়ে দুই তিন গুণ বেশি হবে না? এইসব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের বক্তব্য প্রশাসন, জল সম্পদ বিভাগ এবং শেষ পর্যন্ত খোদ মুখ্যমন্ত্রী এসে কাড়ারপারের কাটা বাঁধকেই জুন মাসের বন্যার জন্য দায়ী করে যে বক্তব্য রেখে গেছেন এবং সংবাদমাধ্যমেও তা ফলাও করে প্রচার হয়েছে, তা আংশিক সত্য। আসলে দীর্ঘ দুই তিন দশক ধরে জল সম্পদ বিভাগের দুর্নীতি, উদাসীনতা ও অবহেলা এবং জেলা প্রশাসনের নজরদারি রাখার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা এবং সরকারের চরম উদাসীনতা এবারের বন্যার জন্য দায়ী।
কাড়ারপার, বাঘাডহর, বেরেঙ্গা প্রথম খণ্ড ইত্যাদি এলাকায় এখন ব্যাপক হারে বাঁশের গড় দিয়ে ‘জিও’ ব্যাগে মাটি ভরে ঠেকনা দেওয়ার যে কাজ কাজ চলছে, তাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে, সে হিসেব কি কেউ দেবেন? এই টাকাটাই যদি গত দুই বছরে বাঁধে মাটি ফেলা এবং স্থায়ী মেরামতির জন্য খরচ হতো, তা হলেও শিলচর শহরের নাগরিকদের এতো ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখী হতে হতো না। সরকারি উদাসীনতা ও ব্যর্থতাকে লঘু করে দেখিয়ে মানুষের ক্ষোভের সূচীমুখ ও বন্যার দায়ভাগের তীর অত্যন্ত সচেতন ভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে কাড়ারপারের দিকে।
এবার আসা যাক রাঙ্গিরখালের কথায়। শিলচর শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমের মূল খাল হলো রাঙ্গিরখাল। ১৭,৩০০ মিটার দীর্ঘ এই খাল বরাক নদী থেকে বেরিয়ে আসা এক ছোট জলপ্রবাহ ছিল, যা বিভিন্ন গ্রাম এবং ধানখেতের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে শিলচর শহরের দক্ষিণদিক হয়ে ঘাগরা নদীতে পড়েছিল। কিন্তু ছয়ের দশকে বরাকের তীর ঘিরে বন্যা নিয়ন্ত্রণের বাঁধ তৈরি হওয়ায় এই খালের সঙ্গে বরাকের সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তার মূল উৎসস্থল থেকে প্রায় সাড়ে তিন’শ মিটার বয়ে আসার পর মহিষা বিলের জল বয়ে নিয়ে এসে রাঙ্গিরখালে মিশেছিল আরেকটি খাল। বরাকের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মহিষা বিলের এই খালটিই হয়ে দাঁড়ায় রাঙ্গিরখালের বর্তমান উৎস। কমবেশি পনেরো লক্ষ বাষট্টি হাজার বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে থাকা এই বিল সুদূর অতীতে বরাক নদীর ধারা ছিল, তা তার অবস্থান দেখলেই বোঝা যায়। কোনও কারণে বরাক এই ধারা ছেড়ে আরও পূর্ব দিকে সরে গেছে। সমতলে এসে ঢোকার পর বরাক যে বহুবার তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে, উপত্যকার অনেক গুলি ‘আনুয়া’ তার সাক্ষ্য বহন করে। এই বিলের উত্তর পূর্বাংশ পলি মাটিতে উঁচু হয়ে যাওয়ায় এবং বাঁধ নির্মিত হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মহিষার অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক এবং একমাত্র রাস্তা হয়ে যায় রাঙ্গিরখাল।
১৯৭৬ সালের বন্যায় মহিষার উদ্বৃত্ত জল বের করার ব্যাপারে এই রাঙ্গিরখাল এক বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু সাতের দশক থেকেই শহরের জনসংখ্যা ও আয়তন বিপুল ভাবে বাড়তে শুরু করে। উত্তর দিক বরাক নদীতে ঘিরে থাকার ফলে শহরের দক্ষিণ দিকেই নতুন নতুন বসতি দ্রুত গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৬৫-৬৬ সালেও গোপীনাথ সিনেমা হলের দক্ষিণে দোকানপাট ঘরবাড়ি প্রায় ছিলই না। হলিক্রস স্কুল যখন নির্মিত হয়, তখন নাগরিকেরা বলেছিলেন, ঐ স্কুলে কে ছাত্র ভর্তি করাবে, ধানখেতের মাঝখানে বানিয়েছে এক স্কুল। এখন যেখানে সঞ্জয় মার্কেট, চণ্ডিচরণ রোড, শিব কলোনি রয়েছে এর পুরোটাই ছিল ধানের খেত। শুধু রাঙ্গিরখাড়ি তেমাথায় কয়েকটি হাতে গোণা দোকান ছিল।
কিন্তু ছয়ের দশক থেকে মাত্র ত্রিশ বছরে রাঙ্গিরখালের দুই পাড় ভরে উঠল শয়ে শয়ে বাড়িঘরে। একের পর এক আবাসিক এলাকা তৈরি হয়ে গেল। তাদের সমস্ত বর্জ্য আবর্জনায় ভরে উঠতে থাকল রাঙ্গিরখাল। খালের পাড়ের বহু বাড়ির পায়খানার পাইপ সরাসরি রাঙ্গিরখাল, লঙ্গাইখাল এবং সিঙ্গিরখালে ছেড়ে দিয়েছে । প্রশাসন এবং ডেভেলাপমেন্ট অথরিটি এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ সময়মতো নেয়নি। এখনও পুরসভা এব্যাপারে প্রায় নিশ্চুপ।
রাঙ্গিরখালের উপর নির্মাণ করা হয়েছে ১৭টি বড় এবং অজস্র ছোট ও মাঝারি সেতু। সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক উপায়ে বেসরকারি, ব্যক্তিগত খরচে নির্মিত সেতুগুলিতে খালের মাঝখানেই দেওয়া হয়েছে একাধিক পিলার। এই সেতু গুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না? আমাদের জানা নেই। এর ফল হয়েছে মারাত্মক।
বিশালাকার মহিষা বিলের জল এখন আর রাঙ্গিরখাল হয়ে প্রয়োজন মতো বেরিয়ে যেতে পারেনা। খালের অন্তিম ৯ কিলোমিটার ছাড়া বাকি অংশ এখন প্রায় বুঁজে এসেছে। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান বানিয়ে রাঙ্গিরখালের আমূল সংস্কারের কথা ঘোষণা করা হলেও ওই প্রজেক্ট অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। রাজ্যে সরকার বদলের পর মাস্টার ড্রেনেজ প্রকল্পের কথা আর শোনাও যায় না। এর ফলে মহিষা বিলের চারপাশে গড়ে ওঠা শত শত ঘরবাড়ি এখন বছরে প্রায় ৮/৯ মাস জলের তলায় থাকে। বর্ষায় জল বেড়ে উঠলে তো আর কথাই নেই। বর্ষাকালে রাঙ্গিরখালের জল দ্রুত বেরিয়ে না যাওয়ার আরেক প্রধান কারণ বাংলাঘাট এলাকায় তৈরি স্লুইস গেটটির সঙ্কীর্ণতা। এত বিশাল শহরের জল বেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র স্লুইস গেটটি মাত্র ৮ ফুট চওড়া। এই স্লুইস গেটের পাশে সমান চওড়া আরও একটি স্লুইস গেট বানানো হলে দক্ষিণ ও পশ্চিম শিলচরের জল আরও দ্রুত বেরিয়ে যাবে, এটা নিশ্চিত। তবে রাঙ্গিরখালের প্রথম ৯ কিলোমিটার যদি অন্তত দুই-তিন মিটার গভীর করে খনন করা না হয়, তবে শিলচর শহর এবং মহিষা বিলের বন্যার সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। পাশাপাশি ‘নমামি বরাক’ জাতীয় চোখ ধাঁধানো উদযাপন নয়, সত্যিকার আন্তরিকতা নিয়ে বরাক ও ঘাগরা নদী খনন না করলে বরাকের জল বারবার আপনার, আমার ঘরবাড়ি, দোকানপাটে এসে হানা দেবেই।
আমরা ‘মার্চ ফর সায়েন্স, শিলচর চাপ্টার’ এই তথ্য অনুসন্ধানের পর শিলচর শহর ও জেলাবাসীকে বন্যার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে কয়েকটি দাবি অতি দ্রুত পূরণের জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানাচ্ছি এবং জেলাবাসীকে উক্ত দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করতে আহ্বান জানাচ্ছি –
1. তোপখানা থেকে সোনাবাড়িঘাট পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ উচ্চতা বজায় রেখে, বাঁধের পূর্ণসংস্কার করতে হবে, এবং কিছু স্থানে প্রয়োজনে নতুন করে নির্মাণ ও করতে হবে। কাশিপুর নাথ পাড়া, রায়গড় দাসপাড়া, শিববাড়ি রোড, রেল স্টেশন সংলগ্ন নিউ কলোনি, মধুরবন্দ থেকে কাড়ারপাড়, ভাগাডহর নয়াগ্রাম থেকে বেরেঙ্গা খাস, ওল্ড লক্ষ্মীপুর রোড সংলগ্ন বেরেঙ্গা পার্ট-১ থেকে সিরাজ মিয়ার কাঠের মিল, গঙ্গাপুর ফেরিঘাট, সোনাবাড়িঘাট সেতু সংলগ্ন এলাকার ভাঙা বাঁধগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
২. তোপখানা থেকে সোনাবাড়িঘাট পর্যন্ত স্লুইস গেটগুলোকে কার্যক্ষম করতে হবে।
৩. বাংলাঘাটের বেড়াখাল ও রাঙ্গিরখালের স্লুইস গেটের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. কাড়ারপারের অসম্পূর্ণ স্লুইসগেটটিকে চওড়া করে দ্রুত নির্মাণ করতে হবে।
৫. মহিষাবিল থেকে ঘাঘরা পর্যন্ত রাঙ্গিরখাল এবং এতে সংযুক্ত হওয়া লঙ্গাইখাল ও সিঙ্গিরখালকে জবরদখল মুক্ত করে আদি গভীরতা পর্যন্ত খনন করতে হবে এবং প্রয়োজনে দুপাশে রাস্তা সহযোগে বাঁধের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. শহরের প্রতিটি নালা, নর্দমা পূর্ণ সংস্কার করতে হবে।
৮. বরাক ও ঘাগরা নদী খনন করতে হবে এবং লক্ষীপুর–করিমগঞ্জ পর্যন্ত জাতীয় জলপথ চালু করে তাতে নিয়মিত জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. বরাক ও তার উপনদীসমুহের ভাঙ্গা বাঁধ সংস্কার ও নদী ভাঙ্গনের প্রতিরোধের স্থায়ী সমাধান করতে হবে। এবারের বন্যায় বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত গঙ্গাপুর ও মানিকপুরের ভাঙন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মেরামত করতে হবে।
এছাড়াও সরকারের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে বিশেষ আবেদন,
৯. বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে রোগ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে প্রতিটি পৌরসভা এবং পঞ্চায়েত ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত বিজাণুনাশক সামগ্রী ছেটানোর ব্যবস্থা এবং বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে
১০. শহরের পাশাপাশি প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত ওয়ার্ডে স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করতে হবে।
ধন্যবাদের সহিত –
তথ্য অনুসন্ধানকারী দলের সদস্যবৃন্দ
১. আশু পাল
২. হরিদাস দত্ত
৩. হানিফ বড়ভুঁইয়া
৪. বিশ্বজিৎ শীল
৫. চিন্ময় ভট্টাচার্য
৬. হিল্লোল ভট্টাচার্য
৭. জয়দীপ ভট্টাচার্য
৮. কৃশানু ভট্টাচার্য
৯. পিনাক রায়
১০. প্রেমানন্দ দাস