Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
উনিশে মে এবং আমরা, লিখেছেন ড. রাহুল চক্রবর্তী
১৯ মে : মাতৃভাষাকে বলা হয় মাতৃদুগ্ধের মতো l এ একেবারে মানুষের নিজস্বতার অনুভূতি l যে অনুভূতির স্বাদকে ধারণ করে একটি মানুষ নিজেকে উজাড় করে দিতে পারে বহু বিভিন্নতায়, বহু সামাজিক বীক্ষণে, বহু উষ্ণতার সান্নিধ্যে l
বাংলা ভাষা, তথা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বরাক উপত্যকার ১৯৬১ সালের ১৯ শে মে, অর্থাৎ আজকের দিনটিতে যে একাদশ শহীদ আত্মবলিদান দিয়েছিলেন সে তো আজ ইতিহাস l কিন্তু ওই ইতিহাসই তো গড়ে তুলছে আজকের বর্তমান ! সে জন্যই উনিশে মে আমাদের কাছে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা, অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় l কিন্তু সেই জিজ্ঞাসা শুধুই কী একাদশ শহীদের নাম উচ্চারণ ! শুধুই কী কৃষ্ণচূড়া ফুলের লাল রঙের উচ্ছাস, শুধুই কী বাংলা এবং বাংলা নিয়ে চর্বিতচর্বণ বক্তব্যকে চটকে চটকে দেখা !
আসুন, সকলের জানা সেই প্রেক্ষাপটকে একবার দেখি l
১৯৬০ সালের এপ্রিলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমিয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। ১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহাl তিনিই অসমিয়াকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বরাক উপত্যকার বাঙালিদের উপরে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়। অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন ।
বরাকের জনগণের মধ্যে সজাগতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২রা মে শেষ হওয়া এই পদযাত্রায় অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ই এপ্রিল,১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে-তে তারা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১৯ মে-তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারি কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয়নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল।
কিন্তু বিকালে স্টেশনে আসাম রাইফেলস এসে উপস্থিত হয়। দুপুর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারি বাহিনী আন্দোলনকারীদের বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তারা ১৭ রাউণ্ড গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; দু’জন পরে মারা যান।
এটি একটি ঘটনা এবং আপনারা সবাই তা জানেন l কিন্তু এই যে জলজ্যান্ত একাদশ শহীদের আত্মাহুতি, তার পেছনে রয়েছে বাংলা ভাষার জন্য লড়াই শুধু নয়, মাতৃভাষা রক্ষার লড়াইও বটে — আরোপিত ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাতৃভাষাকে অবলুপ্তির পথ থেকে পুনরুদ্ধারের লড়াই l তাই আজ বলতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যখন ভাষার জন্য প্রতিবাদ হয়, আত্মবলিদান হয়, তখন প্রান্তিক এই উনিশে মে সম্পর্কযুক্ত হয়ে যায় অনায়াসে l
আমাদের হতভাগ্য বরাক উপত্যকা দেশভাগের পর থেকেই শুধু ভাষাগত নয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, উন্নত মানের যোগাযোগ ব্যবস্থা – সকল দিক থেকেই অবহেলিত I কিছু পেতে হলে তাকে বারে বারে যেতে হয়েছে সংগ্রামে l কিন্তু কেন এই অবস্থা ! আসলে এই অবস্থার পেছনে রয়েছে সূক্ষ্ম ব্যবস্থা, ব্যক্তির অস্তিত্বকে যুগ যুগ ধরে লঘু করে দেখা l তাই আজ ইতিহাসের পাতা খুলে দেখলে বার বার খুঁজে পাই উনিশে মে-কে l
সে কারণেই শুধু ১৯৬১ নয়, ২০২১ সালে এসেও আসামের বুকে বাংলা মাতৃভাষা বলে কিছু লোককে যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের বাসিন্দা হয়েও চিহ্নিত হতে হয় স্বত্বহীন মানুষ কিংবা সন্দেহযুক্ত বিদেশী রূপে ! আসামের বুকে রাজনৈতিক ভাবে বহু পালাবদল ঘটেছে, কিন্তু নরম গরমে বাঙালির জন্য মাতৃভাষার পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাঁধা হয়ে থেকেছেন প্রায় সকলেই l তাই শুধু আজকের দিনেই নয়, প্রতিদিনই আমাদের উনিশে মে’র সংগ্রাম ও বলিদানকে স্মরণে মননে রাখতে হয় l
আজ নূতন প্রজন্মকে আমরা যতই বিদেশি শিক্ষায় গড়ে তুলি না কেন, নিজের ঘরে তাকে মাতৃভাষার পরিচয় করানোটা খুবই দরকার ! আর শুধু ভাষা নয়, নিজস্ব কৃষ্টিকেও বলিষ্ঠ ভাবে ভালোবাসা দিয়ে ধরে রাখতে পারাটাই আমাদের ১৯ মে ‘র সারা বছরের সাধনা l …….. সেখানে খোলা থাক একটি জানলা, হাওয়া আসুক — বর্তমান মহামারীর দমবন্ধ প্রতিকূল পরিবেশে ১৯ শে মে হয়ে উঠুক উন্নত ঢাল রচনা করার শক্তি, যা আটকে দেবে আজকের এবং আগামী দিনগুলোর ভাইরাসকে l
**Dr Rahul Chakraborty is an Associate Professor & Head, Department of Bengali, Radhamadhab College, Silchar.