Barak UpdatesHappeningsBusinessBreaking News

অনিশ্চয়তায় নিশ্চয়তা দেখিয়েছিলেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, লিখেছেন ড. সব্যসাচী রায়

//ড. সব্যসাচী রায়//

যাকে চোখে দেখা যায় না, যার গতিবিধি অনুসরণ করা অসম্ভব, তার সুনির্দিষ্ট কক্ষপথ আছে বলাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। ১৯১৩ সালের নিলস বোর বিবৃত পরমাণু মডেলে ইলেকট্রনের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের মন্তব্য এমনটাই ছিল। বোর-মডেলের সীমাবদ্ধতা এবং সহকর্মী-অভিভাবকদের অনুপ্রেরণাকে সম্বল করে হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে নতুন আলোর রশ্মি ছুড়ে দিয়েছিলেন, যার বিচ্ছুরণে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের নতুন দ্বার উদ্ঘাটন হয়েছিল, সুপ্রশস্ত হয়েছিল যাত্রাপথ।

বিশ শতকের প্রথম তিনটি দশক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার স্বর্ণযুগ ছিল বললে অত্যুক্তি হবে না। জে জে থমসন, ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড থেকে শুরু করে আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, এরউইন শ্রোডিঙ্গার, উলফগ্যাং পাওলি, ম্যাক্স বোর্ন — একঝাক বিজ্ঞানী রাশিরাশি নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবনের মাধ্যমে পদার্থবিদ্যায় জোয়ার বয়ে আনছিলেন। তাঁদের থেকে কোনও অংশে কম ছিলেন না হাইজেনবার্গ। বিজ্ঞানের তীর্থভূমি ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত জার্মানির ভ্যুর্ৎসবুর্গ-এ জন্ম তাঁর (৫ ডিসেম্বর ১৯০১ সাল)। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাশালী। ১৯২০ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আর্নল্ড সোমারফেল্ড, উইলহেম উইনের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের তত্বাবধানে পদার্থবিদ্যায় গবেষণা শুরু করেন। এরপর তিনি জার্মানীর শহর গোটিনজেনের জর্জ অগাস্ট ইউনিভার্সিটিতে  ভিজিটিং স্টুডেন্ট হিসাবে অধ্যয়ন শুরু করেন। সেখানে তিনি ম্যাক্স বোর্ন, জেমস ফ্রাঙ্ক এবং ডেভিড হিলবার্টের মতো বিজ্ঞানীদের সঙ্গে গবেষণা করেন (১৯২২-২৩ সাল)। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে তিনি ১৯২৩ সালে, মাত্র ২২ বছর বয়সে, পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯২৪ সাল থেকে এক বছর কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নিলস বোরের সঙ্গে কাজ করেন। এরপর স্বল্প সময়ের জন্য তিনি ফিরে যান গোটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৬ সালে তিনি নিলস বোরের অধীনে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার প্রভাষক নিযুক্ত হন এবং ১৯২৭ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

১৯২৫ সালে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের নতুন দিকনির্দেশক তত্ত্ব সংবলিত গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন হাইজেনবার্গ, যার জন্য তাঁর নাম পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে সবসময় উজ্জ্বল থাকবে। তাঁর নতুন তত্ত্বটি ছিল পর্যবেক্ষণ-ভিত্তিক — পরমাণু দ্বারা নির্গত বিকিরণের উপর ভিত্তি করে। তিনি বলেছিলেন, কোনও এক নির্দিষ্ট সময়ে পরমাণুর ভিতরে একটি ইলেক্ট্রনের অবস্থান নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা যায় না বা ইলেক্ট্রনের গতিপথ যথাযথভাবে অনুসরণ করা যায় না। তাই, নিলস বোর প্রস্তাবিত ইলেক্ট্রনের কক্ষপথগুলো আসলেই বিদ্যমান কী না, তা বলা সম্ভব নয়। সেই ধরণের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদার্থ-কণার বিভিন্ন ভৌতিক রাশি, যেমন অবস্থান, বেগ, ইত্যাদি বর্ণনা করতে সাধারণ সংখ্যা প্রযোজ্য নয়, এর জন্য পৃথক গাণিতিক কাঠামো প্রয়োজন। এর পরই ম্যাট্রিক্স পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে হাইজেনবার্গের তত্ত্বের গাণিতিক ভিত দেন ম্যাক্স বোর্ন।

১৯২৭ সালে হাইজেনবার্গ তাঁর সেই বিখ্যাত ‘অনিশ্চয়তা নীতি’ বা ‘আনসার্টেন্‌টি প্রিন্সিপল’ সংবলিত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন৷ সেখানে তিনি বলেন, কোনও পারমাণবিক স্তরের কণার যথাযথ অবস্থান এবং ভরবেগ যুগপৎ নির্ধারণ করা অসম্ভব। ত্রুটি থাকবেই। অবস্থান এবং ভরবেগ নির্ধারণের ত্রুটিগুলোর গুণফল প্লাঙ্ক ধ্রুবক ‘h’-এর সমানুপাতিক। অবস্থান বা ভরবেগ, যেকোনও একটির ক্ষেত্রে প্রায় ত্রুটিমুক্ত হিসেব নির্ধারণ করা সম্ভব হলে অন্যটির ত্রুটি সেই অনুপাতে বেশি হতে বাধ্য। আমাদের দৈনন্দিন জড়বস্তুর গতিবিধি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে যদিও এই ত্রুটিগুলি নগণ্য, কিন্তু পারমাণবিকস্তরে মাপজোখের ক্ষেত্রে এই ত্রুটিগুলোকে উপেক্ষা করা যায় না। ১৯২৯ সালে হাইজেনবার্গ এবং পাওলি আপেক্ষিক কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপনকারী দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। একই বছর, চীন, জাপান, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা সফরে যান হাইজেনবার্গ। ভারতে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে আসেন এবং রবিঠাকুরের সঙ্গে ভারতীয় দর্শন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। হাইজেনবার্গ পরে মন্তব্য করেছিলেন, এই সাক্ষাৎ পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক সাহায্য করেছিল। ১৯৭২ সালে হাইজেনবার্গের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ফ্রিটজফ ক্যাপ্রা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আনকমন উইসডম’-এ মন্তব্য করেছেন, হাইজেনবার্গ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের নতুন বিকাশের ব্যাপারগুলো আসলে ততটুকু বিক্ষিপ্ত নয়। এর পেছনে এক নিবিড় সংস্কৃতি রয়েছে — যার ধারাগুলোর রবিঠাকুর বর্ণিত দর্শনের সঙ্গে মিল রয়েছে।


বস্তুতঃ হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি ব্যবহারে পরমাণুর অনেক পর্যবেক্ষিত বৈশিষ্ঠ্যকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়। এর ফলশ্রুতিতে শ্রোডিঙ্গার তাঁর তরঙ্গ বলবিজ্ঞানের সমীকরণটি প্রস্তাব করলেন। হাইজেনবার্গের তত্ত্ব এবং এর প্রয়োগে হাইড্রোজেনের অ্যালোট্রপিক ফর্ম আবিষ্কারের জন্য হাইজেনবার্গকে ১৯৩২ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
তিনি জার্মানিতেই তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু। যদিও তিনি নাৎসি দলের সদস্য ছিলেন না, তিনি একজন দেশপ্রেমিক জার্মান নাগরিক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জার্মান পারমাণবিক চুল্লি এবং পারমাণবিক বোমা কর্মসূচিতে জড়িত ছিলেন। বার্লিনের কায়সার উইলহেম ইনস্টিটিউট ফর ফিজিক্স-এ এই নিয়ে গবেষণায় তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যদিও জার্মানি এই পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যাপারে হাইজেনবার্গের ভূমিকা বিতর্কিত ছিল বলে অনেকক্ষেত্রে মন্তব্য করা হয়।

হাইজেনবার্গের ‘ফিজিক্স অ্যান্ড ফিলোসফি’ শীর্ষক বইটি আজও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা চর্চায় এক অনন্য পথপঁজি হিসেবে সমাদৃত। তাঁর লেখা আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে, ‘দ্য ফিজিক্যাল প্রিন্সিপ্‌লস অব কোয়ান্টাম থিওরি’ এবং ‘ফিজিক্স অ্যান্ড বিয়ন্ড’। পদার্থবিদ্যার দর্শনগত রুঢ় তত্ত্ব সংশ্লেষণের বাইরেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর নেশা ছিল, তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট পিয়ানোবাদক। ১৯৭৬ সালে জার্মানীর মিউনিখে মৃত্যু হয় ‘হাইজেনবার্গ আনসার্টেন্‌টি প্রিন্সিপল’-খ্যাত, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম জনক ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ৷

(ড. সব্যসাচী রায় করিমগঞ্জ কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker