India & World UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
মুখে সংবিধান, বুকে তালিবান, লিখেছেন সুব্রত দাস
১৯ অগস্ট : সম্প্রতি তালিবান আফগানিস্তানের দখল নিয়ে আরেকবার প্রমাণ করলো, জোর যার মুলুক তার। গোটা বিশ্ব এই ঘটনায় স্তম্ভিত; শুধু চিন, পাকিস্তান, রাশিয়া, ইরান ছাড়া। চিন আর পাকিস্তান যেন দুই যমজ ভাই চাংকি-পাংকি! দুজনেরই বক্তব্য, তালিবান আসলে স্বাধীনতা সংগ্রামী। ওরা আফগানিস্তানের স্বাধীনতার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করছে। শুনে অবশ্য রাস্তায় হেঁটে চলা ঘোড়াগুলো দুদিন ধরে বিদঘুটে আওয়াজে বেজায় হাসছে। অন্যদিকে, রাশিয়া আর ইরান তালিবানের কাজে বিরক্তি প্রকাশ করেছে বলেও জানা যায়নি। ওদিকে বিশ্বপিতা অ্যামেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান নানাভাবে ওখান থেকে আমেরিকান সৈন্য উঠিয়ে নেবার কাজকে যুক্তিযুক্ত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কথার মারপ্যাঁচে কখনো তার পূর্বসূরি ট্রাম্প সাহেব নয়তো আফগান সরকারকে দায়ী করছেন। এদিকে, আমাদের দেশে একদল মানুষ ওৎ পেতে বসে আছেন যারা কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সমস্ত ব্যাপারে অসাংবিধানিক কাজ করে বেড়ান, তারা মুখোশের আড়ালে লুকোনো মুখ দেখাতে শুরু করেছেন। তাদের অনেকেই চিন আর পাকিস্তানের সাথে একমত। অর্থাৎ তারাও সরাসরি নয়তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন যে, এই দখলদারি তালিবানের জিহাদ নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ! যে তালিবানরা নারী, শিশু এবং অসহায় মানুষের সাথে যথেচ্ছাচার করে, তারাও তাদের চোখে এখন হিরো। মোদীকে একটা জম্পেশ শিক্ষা দেবার স্বপ্নে তারা বিভোর।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা কখনো কখনো আমাদের উপলব্ধির ভিত্তিতে অন্য মানুষ বা তাদের কাজকে মূল্যায়ন করি; আমরা অনেক সময় বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী সেটা না করে আবেগের বশে করে থাকি। তাই কখনো সেখানে থাকে ভাবের ঘরে চুরি। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা কাউকে বিচার করতে আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস বা অনুভূতির দ্বারা প্রতারিত হই। যদি জিজ্ঞাসা করি, বলুন তো সাধারণ আফগান নাগরিকের মাইন্ডসেট কী? ওরা কি সত্যি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী? কী উত্তর দেবেন? এখানে আমরা ধরেই নিয়েছি যে, আফগান জনগণের অধিকাংশই গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার; এমনকী তারা ইসলামিক থিওক্র্যাটিক এবং খিলাফত পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। আমরা অনেকেই খবর রাখি না যে ৯৯ শতাংশ আফগান নাগরিকই শরিয়া আইন সমর্থন করেন এবং সেটাকেই বাস্তবায়িত করতে চান, সেখানে পাকিস্তান ৮8 এবং বাংলাদেশ ৮২ শতাংশ।
আশ্চর্য ঠেকলেও সত্যি, আফগান নাগরিক অধিকাংশই শরিয়া আইনের পক্ষে। তাই যিনি যতই কাবুলিওয়ালা নিয়ে আবেগ দেখিয়ে গল্প উপন্যাস লিখুন না কেন, যাদের দুঃখে আজ আমরা কষ্ট পাচ্ছি বা উদ্বেগে ভুগছি, আজকের পরিণাম তাদেরই চয়েস। আরো তথ্য জানলে অবাক হতে হয় যে, তারা ইসলামিক শাস্তির বিভিন্ন বিধানেও আগ্রহী। সবকিছু দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, আজকের তালিবান শক্তির উৎস কোথায়? তার মানে, আজকে তাদের আশ্রয় খোঁজের যে চেষ্টা, সেটা কি নিজেদের বাঁচার জন্য; নাকি একদিন যাতে অন্যের অধিকার হরণ করে সেখানেও ধর্মীয় রীতি-নীতি বা আইন প্রয়োগ করতে পারে, তার জন্য? অন্যদিকে, আফগান সেনাবাহিনীর সততা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। অনেকসময়ই তারা সামান্য কিছুর বিনিময়ে তালিবানের সাথে সহযোগিতা করে। এমনিতেই এই তালিবান উগ্রপন্থীর বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীর মোট শক্তি ভারতের কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মোতায়েন করা ভারতীয় সেনা বাহিনীর চাইতেও সংখ্যায় অনেক কম। এই অপ্রতুল সেনা নিয়ে এরকম একটা ভয়ংকর এবং অপ্রতিরোধ্য মৌলবাদী শক্তির সাথে পেরে ওঠা কি খুব বাস্তবসম্মত? আফগানিস্তান কি জানত না যে তালিবান তাদের উপর আবার হামলা চালাতে পারে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের সতর্ক করেনি?
ট্রাম্প বিদায় নেবার পর নতুন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন অ্যামেরিকান সেনা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। হয়তো তিনি তালিবানকে ততটা গুরুত্ব দেননি। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তার পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না। আফগানিস্তানের উচিত ছিল নিজেদের ব্যাপারে সিরিয়াস হওয়া। অনেকে এটাকে ভারতের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ব্যর্থতা বলতে চাইছেন। তবে এখানে ভারতের নিজেদের সুরক্ষা ছাড়া অন্য কিছু করার নেই। হয়তো ভারতীয় নাগরিক অনেকেই তালিবানদের কথা ভেবে আসন্ন বিপদের জন্য চিন্তিত। অবশ্য পৃথিবীর যে কোনো সুস্থ এবং স্বাভাবিক মানুষই এরকম মধ্যযুগীয় বর্বর যুগে ফিরে যাবার কথা ভাবলে আঁতকে উঠবেন।
ইতিমধ্যে অসংখ্য নারী এবং শিশু শরিয়ত অনুযায়ী শুধু নির্যাতিত এবং নিহত হননি, পাকিস্তানে রাখা মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের মূর্তিও এক পাকিস্তানি তালিবান উপড়ে ফেলে দিয়েছে৷ কারণ শরিয়ত অনুযায়ী কোনও ভাস্কর্য বা মূর্তি ভয়ংকর অপরাধ। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে প্রকাশ্যে হাত, পা বেঁধে নারী পুরুযষের চুল কেটে দেওয়া হচ্ছে, ছবি কালো রংয়ে মুছে দেওয়া হচ্ছে। নারীদের যৌনদাসী বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কয়েকশো শিশুসহ অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন। নারীদের হিজাব না পড়ে বেরনো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ব্যাংকে চাকরি করা বা পরিচিত পুরুষ ছাড়া নারীর একা বাইরে বেরুনো নিষিদ্ধ হয়েছে।
অনেকদিন ধরেই সমস্ত পৃথিবীর সাথে ভারতও ভীষণভাবে ধর্মীয় উগ্রপন্থার শিকার। তাই এসব ঘটনা সুস্থ মনন ও চিন্তনের ভারতীয়দের যে উদ্বেগ বাড়াবে সেটা স্বাভাবিক। তবে, সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, তালিবান চট করে সমস্ত বাধা পেরিয়ে ভারতের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ, একে তো আফগানিস্তান আর ভারতের মধ্যে পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভৌগোলিকভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অন্যদিকে, ইমরান খান ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের তেহরিক ই তালিবান বা টিটিপির কার্যকলাপ নিয়ে চিন্তিত। তারা পাকিস্তানকে প্রায়শই বিপন্ন বা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পছন্দ করে। সমস্ত বিশ্বের কাছে চাপের কারণে পাকিস্তান ইতিমধ্যেই কোণঠাসা হয়ে আছে। তার অবস্থা এতটাই খারাপ যে পৃথিবীর বিভিন্ন অর্থনৈতিক অনুমোদন হারানোর ভয়ে পাকিস্তান তালিবানদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক রাখতে একটু হলেও ভীত বা সন্ত্রস্ত থাকবে।
এবার আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে, কেন আমরা শুধুমাত্র আফগানিস্তানের শরিয়া আইন সম্পর্কে সংবেদনশীল থাকবো? বিশ্বে শরিয়া আইন অনুসরণকারী অন্যান্য অনেক দেশ আছে যাদের সাথে রয়েছে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তাহলে কেন আমরা কেবল আফগানিস্তানের তালিবান নিয়ে ভাবছি? ধর্মের নামে দেশ শাসন করা এবং জিহাদের নামে শহিদ হওয়া তো অনেক পুরোনো caliphate theocratic design. এই দর্শনের ভিত্তিতে শুধু এই দেশের বিভাজন হয়নি, পৃথিবীর অনেক দেশেই এই থিওরি চলছে। আমাদের বরং এই দেশের সেইসব মানুষদের নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিত নয়, যারা চীন, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশের মতো তালিবানদের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে বৈধতা দিয়ে একই সুর প্রতিধ্বনিত করে। চীন এবং পাকিস্তান তালিবানকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর শিরোপা দিয়েছে। পাকিস্তান দেবেই, কারণ তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠার পেছনে কারণটা সবারই জানা। চীনও একই সুরে গলা সাধবে; কারণ- তার স্বৈরাচারী নীতি, তার অগণিত উইঘুর মুসলমানকে কনসেনষ্ট্রেশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া, কোরান পুড়িয়ে দেওয়া, রমজানের রোজা নিষিদ্ধ করা – ইত্যাদি প্রমাণ করে যে তারা তালিবানেরই দোসর।
এবার প্রশ্ন, যদি আফগানীরা শরিয়া আইনকে এতোটা গুরুত্ব না দিতো, তালিবানরা কি আফগানিস্তান দখল করতে পারতো? নাকি আফগানীরা অধিকাংশই তালিবানদের দ্বারা শাসিত হতে পছন্দ করেন? কে জানে, হয়তো মধ্যযুগীয় বর্বর যুগে ফিরে যাওয়া তাদের অসহায়ত্ব নয়, এটা তাদের চয়েস। তবে শুধু এখানে আমাকে আপনাকে লক্ষ্য রাখতে হবে, আমাদের আশেপাশে ধূর্ত দুপেয়ে জানোয়ার, যাদের মুখে সংবিধান আর বুকে তালিবান, তাদের কথা বা কাজে যেন ভুলেও আমরা আবেগের বশে প্রতারিত না হই। এমন কি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ সম্পর্কেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় এটি পশ্চাদপদ মানসিকতার তৃতীয় দেশ যেখানে ৮২ শতাংশ মানুষ তাদের দেশে শরিয়া প্রয়োগ করতে মরিয়া, সেখানে পাকিস্তানের ৮৪ শতাংশ মানুষ শরিয়তের পক্ষে। ভুললে চলবে না যে, একসময় বাংলাদেশে হিন্দু বাঙালির সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ, আজ ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে অপারেশন সার্চলাইট নামে যে জেনোসাইড হয়েছিল, যেটা ভুলে গিয়ে আমরা আজ গর্বিত, তাতে প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যার মধ্যে কয়েক লক্ষ শিশুর হত্যা এবং নারী ধর্ষিতা হয়েছিল এবং একই ঘটনা সংখ্যায় কম হলেও কাশ্মীরে পণ্ডিতদের নিধন বা এথনিক ক্লিনজিংয়ের সময় ঘটেছিল, যে চিত্রনাট্য লিখেছিল খিলাফত মন্ত্রে বিশ্বাসী পাকিস্তান, যাদের হাত ধরেই আজ আবার তালিবান ফিরে এলো। একদিন যেটা ছিল পাণিনির জন্ম স্থান, আজ তা উগ্রপন্থার বিচরণ ভূমি যা বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত। এটাও মাথায় রাখতে হবে, কোনও একদিন কান্দাহারের নাম ছিল গান্ধার, আর সেই দেশের রাজকুমারী ছিলেন মহাভারতের গান্ধারী। ঔদার্য সবসময় মহত্ত্বের নিদর্শন হয় না, কখনো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবেও প্রমাণিত হয়। একদিকে মধ্যযুগীয় আইন চাইব, অন্যদিকে তালিবানের ভয়ে কাবুল, কান্দাহার ছেড়ে পালাবো; এটা পরস্পর বিরোধী। কিংবা বলা যায়, এই দিবাস্বপ্নের আরেক নাম, সোনার পাথর বাটিতে কাঁঠালের আমসত্ত্ব! কে জানে, হয়তো ওদের অসহায়তা আমাদের কষ্টকল্পিত স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। কে জানে, হয়তো ওদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আজকের পলায়ন ভবিষ্যতে কোন একদিন আশ্রয়দাতার নিজেরই পলায়নের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অন্ততঃ ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ জাজ্বল্যমান। সুতরাং, সাধু সাবধান!
(মতামত, বিশ্লেষণ লেখকের একান্ত নিজস্ব)