Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
বন্যার দিনগুলিতে আমরা ছিলাম টোটালি আনসিকিওরড, লিখেছেন মানস ভট্টাচার্য
বন্যার্তের ডায়েরি (ছয়)
আগের দু দিনের মতো আজও সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা থেকেই হেলিকপ্টারে ড্রপিং শুরু হয়েছে। যেসব জায়গায় গত দুই দিন ড্রপিং হয়নি, সেই সব বাদ পড়া এলাকার নাম প্রশাসন জানতে চেয়েছিল। ওই সব জায়গায় আজ ড্রপিং হতে পারে। আমাদের গলিতে এখন অবধি কোনও ড্রপিং হয়নি। খুব নীচে এসেও ড্রপিং করেনি। হয়তো কোনও টেকনিক্যাল কারণে। এরকম আরও বেশ কিছু এলাকা রয়েছে। মোট পাঁচ দিন ড্রপিং হবে। যেখানে একটি বিল্ডিং-এ অনেক বন্যার্ত, সেই জায়গাগুলোকে ড্রপিং স্পট হিসেবে বেছে নিয়েছে । তবে শিলচরের মতো একটা আনপ্ল্যানড্ শহরে, যেখানে বাড়িঘরের উচ্চতার কোনও মিল নেই, যত্রতত্র টিনের চাল, সেখানে এয়ারড্রপিং খুব একটা সাকসেসফুল হতে পারে না। সহজও নয়।
বেলা বারোটার দিকে জলের বোতল বিক্রি করতে গলিতে একটি নৌকো এল। শুধু জলই । ৩০ টাকা করে লিটার। অনেকেই কিনেছে। এ ছাড়া উপায়ও নেই। ব্যক্তিগত টার্মস্-এ এক দুজন হয়তো ইতিমধ্যে জল বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করতে পেরেছেন কিন্তু প্রশাসনের মাধ্যমে অর্গ্যানাইসড ওয়েতে গলির ভেতরে ত্রাণ বন্টন হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। ত্রাণের বহর মেইন রোডে।
মেইন রোড দিয়ে অনেক নৌকোই চলছে, কিন্তু গলিতে ঢোকে না। এক দুটো যাও ঢুকছে গলির মিডল্ থেকেই ফিরে যায়। একদিনের পর একদিন নৌকার সংখ্যা কিছু না কিছু বাড়ছে। ভালো বিজনেস্। গত পনেরো বছর ফ্লাড না হওয়ায় নৌকার চল অনেকটাই কমে গেছে। এবারে থার্মোকলের ছোটো ছোটো ‘ভেলা ‘ বেশ ভালোই চলছে। একজন যাওয়া যায়। ভাড়াও কিছুটা কম। দুটো-তিনটে থার্মোকল উপর-নীচ বসিয়ে বাঁশ দিয়ে বাঁধা। ইনোভেটিভ আইডিয়া। কিন্তু এই সব ভেলা স্রোত ঠেলে সামনে এগোতে পারে না। খুব কষ্ট হয়। ছোটো মেসিনবোট যা অনায়াসে পারে ।
শহরের বেশকটি জায়গায় মেসিনবোট, এনডিআরএফ-এর নৌকাকে ঢুকতেও অনেক বেগ পেতে হয়েছে। পাবলিক স্কুল রোগ, শহিদ চন্ডীচরণ রোড, সোনাই রোড ইত্যাদি জায়গায় প্রচন্ড কারেন্ট। ডিসেসটার্স্ ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টকে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী করে সাজিয়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে স্পিডবোট, মেশিনবোট এসবের সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে হবে। শিলচর শহর ফ্লাড-প্রোন্ , এই শহরে বেশ কয়েকটি বিধ্বংসী বন্যার পাস্ট রেকর্ড রয়েছে। অতীতের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে।
এ পর্যন্ত কয়েক ইঞ্চি জল কমেছে। জল আসছে তো আসছেই। প্রথম থেকে জলে যে স্পিড এখনও তাই। কোনও ঘাটতি নেই। এই হারে কমলে– কবে যে জল নামবে কে জানে ?
শেষ বিকেল। আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে সব নীরব হয়ে যায়। কোনও শব্দ নেই। মিটিমিটি মোমবাতি কিংবা প্রদীপের আলো। কোনও উচ্ছ্বাস নেই। একই পরিবারের লোকজন হয়তো থাকার অসুবিধায় দুভাগে তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। ছাদ থেকে ছাদে অথবা জানালা থেকে জানালায় কথাবার্তা। খাদ্যসামগ্রীর আদান প্রদান, এসব চিরদিন মনে থাকবে। কখনও ভোলা যাবে না।
মোমের আলোয় রাতের খাওয়া -দাওয়া হলো। তূর্য-র (আমার ছেলে) ফোন এলো। সে জানাল, ২৬-২৭ তারিখ থেকে তিনদিন আবার বৃষ্টি। খুব সাবধানে থাকতে, জলে না নামতে। যেভাবেই হোক্ অন্তত একটি মোবাইল চার্জ দিয়ে রাখতে। ভয় আর আশঙ্কা যেন আমাদের গ্রাস করে ফেলছে।
হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো। বেরোব কি না ভাবলাম, তারপর দরজা খুলে বাইরে আসি। চারদিকে প্রচন্ড চিৎকার। চোর না ডাকাত বুঝতে পারছি না। পরের গলি থেকে বলছে– আমাদের সামনের ফাঁকা, জঙ্গলে ভরা প্লটে কেউ নাকি লুকিয়ে রয়েছে। অন্যরা বলছে, ন্যাশনাল হাইওয়ের দিক থেকে নাকি ৩-৪ জন নৌকা নিয়ে এদিকে ঢুকেছে। বোঝার কোনও উপায় নেই, আসলে যে কী ? মনে হলো, আমরা টুটেলি আনসিকিওর্ড্ !
Also Read: এনডিআরএফের ত্রাণ বিতরণে ছিল তাচ্ছিল্যের ভাব, লিখেছেন মানস ভট্টাচার্য