ওয়েটুবরাক, ৩১ জুলাই : “সায়েন্টিফিক আইডিয়াজ ইন দ্য কোরান – এ মডার্ন আউটলুক” এবং ” ইসলামি দর্শন – শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ”। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী নিবন্ধক ড. আবুল হাসান চৌধুরীর গবেষণাধর্মী এই দু’টি বইয়ের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন হল রবিবার। এ উপলক্ষে শিলচর কাঁঠাল রোডস্থিত আইরিশ ইংলিশ স্কুলে সে দিন সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বরাক এডুকেশন সোসাইটি। সোসাইটির সভাপতি তথা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আলা উদ্দিন মণ্ডল তাতে পৌরোহিত্য করেন।
যদিও “সায়েন্টিফিক আইডিয়াজ ইন দ্য কোরান – এ মডার্ন আউটলুক” বইটি ডিজিটাল মাধ্যমে অনেক আগেই প্রকাশ পেয়েছে। এবার বিজ্ঞজনদের হাত দিয়ে আনুষ্ঠানিকতার রূপ পেল। পরবর্তী বইটি “ইসলামি দর্শন – শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ” বরাকের বিভিন্ন দৈনিকে উত্তর সম্পাদকীয় পাতায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত নানা নিবন্ধের সংকলন।
সভায় মুখ্য বক্তা লেখক-আইনজীবী ইমাদ উদ্দিন বুলবুল বলেন, ইসলাম সবসময়েই মানব জাতির জন্য শিক্ষা দিয়েছে। পবিত্র কোরানে যে বিজ্ঞান বিদ্যমান সেটার অনেক প্রমাণ নানাভাবে প্রমাণিত। তিনি বলেন, যা ইসলাম সম্মত নয়, তা ইসলামিক হেরিটেজ বা ঐতিহ্য হিসেবে কখনো গণ্য করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, দিনের বেলায় পীরফকিরের কবরে মোমবাতি জ্বালানো, মহরমের সময়ে লাঠিখেলা ইসলামি ইতিহ্যের পরিচয় বহন করে না। এগুলো সমাজের জন্য বিভ্রান্তিকর । প্রসঙ্গক্রমে ড০ আবুল হাসান চৌধুরীর প্রকাশিত গবেষণা ধর্মী বই দুটির ভুয়সী প্রশংসা করে এই বই দুটিকে সমাজের দলিল বলে আখ্যায়িত করে এর ব্যাপক প্রচার ও প্রসার কামনা করেন তিনি। সোসাইটির মুখ্য উপদেষ্টা তৈমুর রাজা চৌধুরী বলেন, ড. আবুল হাসান চৌধুরী অত্যন্ত প্রচারবিমুখ মানুষ। তাঁর কাছ থেকে এধরনের পুস্তক আরো চাই। যেগুলো সমাজের জন্য অত্যন্ত উপকারী ও উপযোগী। বক্তব্যের পরিসরে চৌধুরীবাবু এও বলেন, আমাদেরকে অনেকে বিভ্রান্ত করেন। বিশেষ করে রাজনীতির কারবারিরা। ফলে আমাদের মধ্যে সম্প্রীতিতে চিড় ধরে, দূরত্ব বাড়ে সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই দুঃসময়ে ড. আবুল হাসান সাহেবের মতো মানুষের কাজ সমাজে শান্তির বার্তা বয়ে আনে। তিনি মূলতঃ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির বিষয়টি উল্লেখ করে সেটাকে প্রতিহত করে এক সুন্দর সমাজ গঠনের কথা বলেন। সুন্দর সমাজ গঠনে ড. আবুল হাসান চৌধুরীর লেখনিগুলো যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, সেটা তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত উদাহরণও উপস্থাপন করেন তৈমুর রাজা চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখতে গিয়ে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল রাজ্জাক টি বলেন, পবিত্র কোরান কোনও বিজ্ঞানের বই নয়, সেটা মানব জীবনের পরিপূর্ণ এক বিধান বা গাইডেন্স। আর এই পরিপূর্ণতার মধ্যেই রয়েছে বিজ্ঞানের আনুষাঙ্গিকতা। কিন্তু এটাকে না বুঝেই আমাদের মুসলমানরা কেবলমাত্র ‘তেলাওয়াত’ পড়েন, পাঠ করেন। আর এই পাঠ করার মধ্যে পুণ্য খোঁজেন। ফলে পবিত্র কোরানের বিধান জীবনে প্রতিফলিত হয় না বলে মনে করেন ড. আব্দুল রেজ্জাক টি।
আয়োজক সোসাইটি তথা সভার সভাপতি ড. আলাউদ্দিন মন্ডল বলেন, বিজ্ঞানের মধ্যে একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা গবেষণার মাধ্যমে সেটা বদলাতে থাকে। তিনি বলেন, ড. আবুল হাসান চৌধুরীর যে বই সায়েন্টিফিক আইডিয়াজ ইন দ্য কোরান-এ মডার্ন আউটলুক, সেটা হলো পবিত্র কোরানের দর্শন বা ফিলোসপিক্যাল পার্ট। এটা অন্তর দিয়ে অনুধাবন না করলে বোঝা মুশকিল। মন্ডল বলেন, অন্যকে ঠকানো যায়, কিন্তু নিজের আত্মাকে কখনো ঠকানো যায় না। ইসলাম ধর্ম যেহেতু অনেক পেছনে এসেছে, সনাতন ধর্ম হলো হিন্দু। ফলে ইসলাম ধর্ম বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর পরিপূর্ণতা লাভ করেছে । আর এই পরিপূর্ণতার বাস্তব উদাহরণ হল পবিত্র কোরান। বক্তব্যের পরিসরে সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মন্ডল এও বলেন, মানুষ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে বিবেচিত। কারণ মানুষ চিন্তা করে এবং প্রশ্ন করে ও প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। আর সেটার মধ্যে দিয়ে তাঁর নিজের ও সমাজের বিকাশ ঘটাতে সমর্থ হয়।
অনুষ্ঠানের মুখ্য অতিথি পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অশোক কুমার সেন বলেন, কোরান গ্রন্থে গ্রহ, নক্ষত্র এবং এর স্থিতি সম্পর্কে বিশদভাবে রয়েছে। রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরো অনেক কিছু। এর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানসম্মত অনেক যুক্তি এবং এর যথার্থ সংযোগ। যেসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ উপস্থাপনা ড০ আবুল হাসান চৌধুরীর গবেষণামূলক বই সায়েন্টিফিক আইডিয়াজ ইন দ্য কোরান, এ মডার্ন আউটলুক-এ রয়েছে । যেটা থেকে সমাজ উপকৃত হবে বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, লেখক তথা আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী নিবন্ধক চৌধুরীর পিএইচডি থিসিস হচ্ছে এই বইটি। লেখকের পিএইচডি কোর্সের কো-গাইড ছিলেন ড. অশোক কুমার সেন। গাইড ছিলেন বর্তমানে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন আরবি বিভাগীয় প্রধান প্রয়াত আব্দুল মোসাব্বির ভূঁইয়া। অধ্যাপক ভূঁইয়া প্রয়াত হবার পর অধ্যাপক রাজ্জাক টি ড. চৌধুরীর পিএইচডি-র গাইড-এর ভূমিকা পালন করেন।
এদিন বইয়ের লেখক ড. আবুল হাসান চৌধুরী তাঁর বইয়ের লেখার পেছনের অনুপ্রেরণার কথা জানান। তিনি বলেন, একসময় দৈনিক সোনার কাছাড় পত্রিকার উত্তর সম্পাদকীয় পাতায় নিবন্ধ লেখা শুরু করেছিলেন। সেই থেকেই তাঁর মাথায় সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, ধর্মীয় নীতিবিরুদ্ধ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সকল স্তরের মানুষকে সচেতন করে তুলতে কলম হাতে নেন। তিনি ‘বইপোকা’ মানুষ। তাঁর প্রথম ভাবনা হলো ইসলামে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। নারী শিক্ষার যত ব্যাপ্তি হবে তত সমাজের মঙ্গল হবে বলে মনে করেন তিনি।
এদিনের অনুষ্ঠানে সায়েন্টিফিক আইডিয়াজ ইন দ্য কোরান, এ মডার্ন আউটলুক বইটির সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন উপস্থাপন করেন ইউআইআইসি-র ডিভিশনাল ম্যানেজার আবুল হোসেন লস্কর। অন্য বই ইসলামী দর্শন, শিক্ষা সমাজ ও সংস্কৃতি নানা প্রসঙ্গ-এর রিভিউ উপস্থিত করেন বিশিষ্ট সংস্কৃতি ও সমাজকর্মী মিলন উদ্দিন লস্কর। অনুষ্ঠানে বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক প্রজিত কুমার পালিত, জীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শুভদীপ রায় চৌধুরী, সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন বখত, আরবি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ বশির কে। সোসাইটির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তাজ উদ্দিন লস্কর, জামিল আহমেদ বড়ভূঁইয়া, জাকারিয়া বড়ভূঁইয়া, লাইলী বেগম, রাগীব হোসেন চৌধুরী সহ অন্যান্যরা। শেষে ধন্যবাদসূচক বক্তব্য রাখেন জামিল হোসেন বড়ভুইয়া। সঞ্চালনায় ছিলেন সোসাইটির সচিব লালমিয়া লস্কর।