Barak UpdatesBreaking News
সবুজ ধ্বংস করে গান্ধীবাগে কি কংক্রিটের জঙ্গল হবে? জেনে নিন জনাকয়েকের অভিমতShall green pave way for forest of concrete at Gandhi Bagh? Read opinion of citizens
২৫ এপ্রিল :গান্ধীবাগ নিয়ে এখন শিলচরে জোর আলোচনা। শিলচর পুরসভা গান্ধীবাগকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে ইতিমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছে। এই কাজের জন্য পুরসভা একটি কোম্পানিকে বরাতও দিয়েছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ যেমন আছড়ে পড়েছে, তেমনি পুরসভাকে স্বাগতও জানানো হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মহল থেকে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। ‘সবুজ ধ্বংস করে গান্ধীবাগে কি কংক্রিকেটের জঙ্গল হবে?’ — এই শিরোনামে ওয়ে টু বরাকও বিভিন্নজনের মতামত শুনেছে। এখানে কয়েকজনের মতামত তুলে ধরা হল।
শিলচরের ফুসফুসটুকু কেড়ে নেবার অধিকার পুরসভার নেই
লিখেছেন অধ্যাপক দিলীপকুমার দে
সব দেশের, বিশেষত উন্নত দেশের, শহরে বিভিন্ন অঞ্চলে গাছপালা ও বাগান থাকে বিশুদ্ধ বায়ুর জন্য, পায়ে হাঁটার জন্য। এমুজমেন্ট পার্কও থাকে। ছোটদের জন্য তো বেশিই থাকে। শিলচরে সেগুলো নেই। কিন্তু কংক্রিটের বহুতল হোটেল, বাণিজ্যিক বাড়ি ও ‘মল ‘ বানিয়ে, পেট্রল-ডিজেলের গাড়ির পার্ক করে শিলচরের সবেধন নীলমনি ‘গান্ধীবাগকে’ ব্যবহারের প্রয়াস চলছে। আমরা প্রবীণ নাগরিকরা এর বিপক্ষে। হোক না সেখানে শিশুদের জন্য বাগান, খেলাধুলা, নৌকাবিহার ও সাঁতারের আধুনিক ব্যবস্থা। আমি ইংল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, আরব ও অন্যান্য দেশের পার্ক দেখেছি, বাচ্চাদের খেলাধুলা দেখেছি। ওদের সঙ্গে ছোটাছুটি করেছি বৃদ্ধ বয়সে। কোথাও সংলগ্ন পাঁচতারা হোটেল দেখিনি, কোথাও দেখিনি, কোথাও না।
তাই আমি এই বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিবাদ করি। দাবি করি বিলম্বে হলেও এই গান্ধীবাগকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সাজিয়ে তোলা হোক। জোরগলায় বলি, শিলচরের ফুসফুসটুকু কেড়ে নেবার অধিকার পুরসভার নেই।
পুরসভা যখন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখায় তখন যে কোন সংবেদনশীল মন বিদ্রোহ করবে
লিখেছেন দীপক সেনগুপ্ত
কবির শহর শিলচরকে নগরায়নের নামে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সাধারণ মানুষের উন্নাসিক নির্লিপ্ততার সুযোগে। প্রদূষণের ক্রমবর্ধমান মাত্রা প্রতিরোধে স্বল্পমেয়াদী বা সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে তারা হোটেল ও মল নির্মাণে মনোযোগী পুর কর্তৃপক্ষ শিলচরবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই করছেন। উন্নত দেশসমূহের কথা নাই বা ভাবলাম, আমাদের দেশের এমন কি আমাদের রাজ্যের কোথাও এ ধরনের আত্মঘাতী পদক্ষেপ নেওয়ার নজির নেই। মল কিংবা তারা হোটেল নির্মাণে আপত্তি থাকার কোনও কথা নয়। কিন্তু স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে শহরের কেন্দ্রস্থল নির্বাচন নিয়েই আপত্তি।
যে পুরসভার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, যে পুরসভা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্পত্তি থেকে কর সংগ্রহ করছে, কিন্তু সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছে না, যে পুরসভা ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা দিতে সক্ষম নয় সেই পুরসভা যখন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখায় তখন যে কোনও সংবেদনশীল মন বিদ্রোহ করবে। এই বিদ্রোহকে কাজে লাগিয়ে ন্যায়সঙ্গত নাগরিক আন্দোলনের পথে নিয়ে যেতে রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, সুশীল সমাজ ব্যর্থ, অথচ এই শহরে গত শতকের আশির দশকে পুর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং এক গৌরবময় সফল অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল।
প্রয়াত মৃণাল কান্তি দত্ত বিশ্বাস, রামেন্দ্র দেশমুখ্য, কান্তি সেন, পুষ্প রঞ্জন গুপ্ত, অহীন ঘোষ প্রমুখের আপসহীন নেতৃত্বকে স্মরণ করে বর্তমান অবিভাবকহীনতার অসহায়তা নিয়ে ভাবলে মনে কষ্ট হয়। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না, অথচ এমনটাই হল আমাদেরই ভোটে নির্বাচিত পুর বোর্ড শহরবাসীর কথা চিন্তা না করে কিছু ব্যবসায়ীর কথা চিন্তায় ব্যস্ত। শিলচর ডেভেলপমেন্ট অথরিটিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। যখন ছিল তখনও যে খুব সদর্থক কোনও গঠনমূলক কাজ করে শহরের শ্রীবৃদ্ধি করেছে এমন নজির স্মরণে আসছে না। টাউন এন্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং সহ প্রদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের নির্লিপ্ততা মনে নানাবিধ সন্দেহের জন্ম দেয়। আমরা জানি, প্রদূষণকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি যেখানে আবর্তিত হচ্ছে অবিরত, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রদূষণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শিলচর শহরকে নরক বানানোর পরিকল্পনা অত্যন্ত নিন্দাজনক।
শিলচর পুরসভার শহরের স্বার্থ বিরোধী অন্যায় এবং অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে প্রচার মাধ্যম ওয়ে টু বরাক নামের নিউজ পোর্টালের ইতিবাচক পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়ে শহরের সব সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্রীড়া সংস্থাকে এগিয়ে এসে পুরসভার শহরের স্বার্থ বিরোধী কাজের প্রতিবাদ করুন। এটা সময়ের দাবি।
সবুজ ধ্বংস করে আত্মহত্যার পথে এগোচ্ছে শিলচর পুরসভা
লিখেছেন ধর্মানন্দ দেব
শিলচর শহরের হৃদপিণ্ড পার্ক রোডের গান্ধীবাগের এক কোণে রয়েছে একরাশ সবুজ। কংক্রিটের জঙ্গলে এক টুকরো অক্সিজেন নেওয়ার স্থান ছিল শিশুদের। অগোছালো হলেও তো সবুজ। এমনিতে শহরজুড়ে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বহুতল ভবন, আবাসন তৈরির জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। গাছ কাটার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিপূরক গাছ রোপণ করা উচিত। কিন্তু শিলচর শহরে এটা কতটুকু মানা হচ্ছে সে নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। কোনও স্থানে প্রাথমিকভাবে হয়তো কয়েকটি গাছ লাগানো হচ্ছে, তারপর সব বন্ধ। এ যেন অনেকটা শেয়ালের কুমিরছানা দেখানোর মতোই একটি ঘটনা।
তাই শহরের গাছ বা সবুজ বাঁচানোর জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন করা উচিত। পরিপূরক গাছ রোপণ করা না হলে ওই আইনে শাস্তির বিধান রাখা সময়ের দাবি। শিলচর শহরে সবুজ বাঁচানোর কোনও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই শিলচর পুরসভার। অনেক সামাজিক সংগঠন সবুজ রক্ষায় কোনও এক বিশেষ দিনে এগিয়ে আসে এবং ওইদিন চারাগাছ রোপন করা হয় শিলচর শহর ও শহর সংলগ্ন এলাকায়। কিন্তু সেগুলোর সঠিক কোনও পরিচর্যা করা হয় না। জানা যায়, ১৯০৪ সালের আগে গান্ধীবাগ ছিল এক গভীর জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। শহরের প্রায় সব জল এই এলাকার উপর দিয়ে বেরিয়ে যেত। আর সেই সময় এই এলাকাটি ছিল সেনা ক্যান্টনমেন্টের আওতায়। পরে শিলচর পুরসভার চেয়ারম্যান কামিনী কুমার চন্দ এবং সেনা ক্যান্টনমেন্টের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলার মধ্যে আলোচনা হয় এই এলাকা সংস্কারের জন্য। আর সেই সংস্কারের জন্য গভর্নর ফুলার অনেক অর্থ সাহায্য করেন বলে জানা যায়। সাপের মতো আঁকাবাঁকা করে খনন করে এলাকার সংস্কার হয়। তখন থেকেই নাকি এটির নাম সাপনালা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
শিলচর শহরের একটি মাত্র উদ্যান গান্ধীবাগ পার্ক। শহরের বুকে দাঁড়িয়ে প্রাণখোলা আলো-বাতাস লুফে নেওয়া একটিমাত্র স্থান। সাপনালার পর এই পার্কের শোভাবর্ধনের জন্য অনেক দূর থেকে গাছ ও ফুলের চারা এনেও রোপণ করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর এই সাপনালার নাম হয়েছিল গান্ধীবাগ। ১৯৬২ সালের ১১ মে শিলচর পুরসভার বোর্ড মিটিংয়ে শহীদ স্মৃতি ভবন নির্মাণের প্রস্তাব পাস হয়।এজন্য পুরসভার পক্ষ থেকে শহীদ স্মৃতি রক্ষা সমিতি গঠন করা হয়েছিল। পুরপতি ছাড়াও এই কমিটিতে ছিলেন অনিল কুমার বিশ্বাস, গোলাম ওসমানি, তারাপদ ভট্টাচার্য প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
খবরে প্রকাশ, বর্তমানে এই গান্ধীবাগেই নাকি উন্নয়নের নামে স্টার হোটেল ও মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি করবে শিলচর পুরসভা। এজন্য নাকি প্রায় ১৯ বিঘা জমি পুরসভা লিজও দিয়েছে। এক্ষেত্রে কি রাজ্য সরকারের সম্মতি রয়েছে? এই লিজ কি সম্পূর্ণভাবে ন্যায়সঙ্গত হয়েছে? যদি পুরসভার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্মতি থাকে তবে এটি আত্মহত্যার শামিল হবে। কারণ পুরসভার আয় বৃদ্ধির জন্যই কি শুধু ধ্বংস করতে হবে সবুজ? কেড়ে নিতে হবে নিষ্পাপ শিশুদের জন্য আলো বাতাস?
আইন তোয়াক্কা না করে কেনই বা যত্রতত্র নির্মাণ হবে?
লিখেছেন রাহুল দাশগুপ্ত
সভ্যতার দোসর হলো দূষণ। সভ্যতার দাবিদার মানব সমাজ দূষণকে তার একান্ত সাথী করে নিয়েছে। শুধু সাথী করে নেয়নি, আরও অনেকটা এগিয়ে। এক শ্রেণির মানুষ দূষণকে হাতিয়ার করে সমাজের উপর ক্ষমতা বিস্তারের প্রতিযোগিতায় মানব সভ্যতাকেই ধংস করার কাজ ত্বরান্বিত করে চলেছে।
শতাব্দী শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক Dr. Stephen Hawking-এর ভবিষ্যৎবাণী হলো “Environmental damage to our beautiful planet, endangering the natural world for us and our children”. তিনি আমদের আরও সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “The human race must start leaving Earth within 30 years to avoid being wiped out by over-population and climate change”.
কিন্তু যাদের জন্য আজ আমাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে তারা এ বিষয়টি সম্বন্ধে অজ্ঞ, সেটা মানা যাবে না। বরং আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবী ও প্রজন্মের অস্তিত্ব রক্ষার চিন্তা, তাদের কায়েমি স্বার্থরক্ষার কাছে নিতান্তই নগণ্য। আজ আমরা যারা নিজেদের সভ্য ও শিক্ষিত বলে দাবি করে থাকি, অথচ এই সভ্য মানুষের শহরে ট্রাফিক আইন নিয়ন্ত্রণে ডাণ্ডা হাতে পুলিশ থাকতে হবে কেন ! কেনইবা শিক্ষিত-ভদ্রের শহরে পৌর ও নগর উন্নয়নের আইনগুলিকে তোয়াক্কা না করে, পরিবেশকে ধ্বংস করে যত্রতত্র নির্মাণ কার্য চলবে?
কাজেই যেখানেই পরিবেশকে প্রত্যাহ্বান জানানো হবে, সেখানেই সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রতিবাদ করা উচিত। কারণ এটা আজ আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। না হলে যেমন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে, তেমনি লেখাপড়া জানা অশিক্ষিতের দল হয়েই চিহ্নিত হবো।আপনারা অনেকেই হয়তো অবগত নন, শিলচর শহরতলী মেহেরপুরে বিশাল এলাকায় শিলচর পুরসভা দীর্ঘ বছর ধরে যে আবর্জনার স্তূপ নির্মাণ করেছেন, যা এই এলকার বাসিন্দাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। তাই শুধুই গান্ধীবাগ নয়, মেহেরপুরে পুরসভার Trenching Ground-এরও তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
পরিকল্পনা মাফিক সেজে উঠুক না গান্ধীবাগ
লিখেছেন দেবযানী চৌধুরী
গান্ধীবাগে সবুজ ধ্বংস বা কংক্রিটের জঙ্গল বলতে কি বোঝানো হল? আমাদের শহর শিলচরের ঐতিহ্যবাহী পার্ক এই গান্ধীবাগে সবুজ বলতে আছেই বা কি? শৈশব থেকে মেয়েবেলা অব্দি তো শুধু দেখলাম গান্ধীবাগ আগাছায় ভরা জঙ্গল, এমনকি গান্ধীবাগের শহিদ বেদিতে যাওয়ার পথটি অব্দি ছিল যাচ্ছেতাই অবস্থায়, সাপনালার উপর ছিল বাঁশের সেতু। কোনও রক্ষনাবেক্ষণ ছিল না। অনেক দাবি দাওয়া, অনুনয়-বিনয়ের পর আগাছা সাফাই করে টয়ট্রেন বসলো, জলের ফোয়ারা, শিশুদের জন্য কিছু বিনোদনের সামগ্রী দিয়ে সাজানো হল। যাইহোক, তবু কিছুদিন ছোট্ট শিশুরা ছুটির দিন বিকেলে একটু অবসর বিনোদনের জায়গা পেলো, তবে রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে টয়ট্রেন তো ক’মাস পরেই মুখ থুবড়ে পড়ল, এখন তো শহরের বুকে গান্ধীবাগ বলতে যা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ভাল একটা পার্ক বলা যায় না।
গান্ধীবাগের অদূরে শিশু উদ্যান বলতে যা আছে, তাও একই অবস্থায়। দুটি পার্কে সবুজায়ন তো যথেষ্ট আছে, গাছ-গাছালির তো অভাব নেই, কিন্তু সেটা কি হতে পেরেছে উন্নতমানের একটা পার্ক? শুধু সবুজায়ন দিয়ে কী হবে? আসামের এই ঈশান বাংলায় তো সবুজের অভাব নেই, চারপাশই শ্যামলিমায় ভরা। পশ্চিম বাংলার সায়েন্স সিটি, নিকো পার্ক, ত্রিপুরার রোজভ্যালি পার্ক, গুয়াহাটির আকুয়া পার্ক, হায়দরাবাদের রামোজি ফিল্মসিটির মত বিশাল পরিসরে না হোক, কিন্তু গান্ধীবাগের পরিসরেও তো এরকম কিছু একটা গড়ে উঠতে পারে শহরের বুকে। সায়েন্স সিটিতে সায়েন্স মিউজিয়াম যেমন আছে, তেমনি সেখানে যথেষ্ট অবসর বিনোদনের সামগ্রী রয়েছে । রামোজি ফিল্মসিটি ফিল্ম নির্মাণের কেন্দ্র হলেও সারা দেশ, এমনকি বিশ্বের পর্যটকের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এরকম কিছু একটা গড়ে তোলার তাগিদে যদি সবুজ সাফাই করে পরিকল্পনামাফিক ইট, সিমেন্ট, বালি পাথরের ইমারত গড়ে ওঠে, তো ক্ষতি কি? এটাকে তখন নিশ্চয়ই কংক্রিটের জঙ্গল বলা যাবে না? প্রশ্ন হল শুধু কংক্রিটের জঙ্গল বলে আমাদের আঁতকে উঠলে হবে না, সবুজ সাফাই করে হচ্ছেটা কি সেটা বুঝতে হবে, জানতে হবে।
গোলদিঘি মল এখন শহর শিলচরের গর্ব, এই মল শুধু মার্কেটিং স্থল নয়, শহরবাসীর অবসর বিনোদনের একমাত্র জায়গা। শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউ এখন অবসর বিনোদনের জন্য গান্ধীবাগে যায় না, যায় গোলদিঘি মলে। অথচ মল গড়ে ওঠার আগে এখানে দিঘি বলতে যা ছিল, তা হল আবর্জনার স্তূপ। ওই জায়গায় গোলদিঘি মল গড়ে ওঠার আগেও অনেক বিরোধিতা হয়েছিল, কিন্তু মল গড়ে ওঠার পর আমরা যা পেলাম, তাতে তো আমরা হতাশ হইনি।
গান্ধীবাগ আর শিশু উদ্যান বলতে এখন যা অবশিষ্ট, সেটা হল বছরে দু-চারটে অনুষ্ঠান, যেমন উনিশে মে তে শহিদ বেদিতে মাল্যদান আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পৌষপার্বণে পিঠেপুলির মেলা, বসন্ত উৎসব আয়োজনের জায়গা হিসেবে বেঁচে আছে। গান্ধীবাগে যদিও বা কোনও ইমারত গড়ে ওঠে, সেটা কতটুকু আমার শহর আর শহরবাসীর স্বার্থে, সেটা দেখতে হবে। তবে আমাদের আত্মপরিচয় শহিদ স্তম্ভের ঐতিহ্যটা যেন কোনওভাবেই ইমারতের আড়ালে ঢাকা না পড়ে। সেটিকে আরও সুন্দরভাবে সাজানো যেতে পারে, সাপনালাটিকেও সাফাই ও রিনোভেশন করে বড়-ছোট সবার জন্য বোটিংএর সুন্দর একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। পরিকল্পনামাফিক যদি ইমারত গড়ে ওঠে, তাহলে ইমারত থাকলেও সেগুলো বহাল তবিয়তে আরও সুন্দরভাবে সেজে থাকতে পারবে, তখন সেটা কংক্রিটের জঙ্গল হবে না, হতে পারে সবার দর্শনীয় কেন্দ্র।
ওই পার্ক রোডটায় সবুজ বাঁচুক, এ বোধকরি সব নাগরিকেরই চাওয়া
লিখেছেন তমাল চক্রবর্তী
স্কুলে একটা ভাব সম্প্রসারণ খুবই কমন ছিল– ” বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”। ব্যাপারটা উত্তরাকাশের ধ্রুবতারার মতই চিরন্তন সত্য। মোদ্দা কথায়, যে যেখানকার উপজীব্য, তার সৌন্দর্য সেখানেই। এর অন্যথা মানেই ছন্দপতন। পড়ুয়ার শোভা যেমন বিদ্যানিকেতনে, কর্মীর স্বীয় কর্ম সংস্কৃতিতে। রাজা শোভিত যেমন প্রজাপালনে, রাজমুকুটে, ঠিক তেমনি ‘বাগ’-এর শোভা তার সবুজভাগে। ইট-কংক্রিটের ঔদ্ধত্য, অট্টালিকা সেখানে প্রচণ্ড বেশি বেমানান। সে যে কোনও মোড়কেই হোক না কেন।
পত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়া মারফত জানতে পারা খবর অনুযায়ী, শিলচর পুরসভার সৌজন্যে গান্ধীবাগের প্রস্তাবিত ‘সৌন্দর্যায়ন’, ‘আধুনিকীকরণ’ (কারও চোখে ‘বাণিজ্যায়ন’) সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে ওই স্কুলজীবনের ভাব সম্প্রসারণটি আশ্রয় করেই আমার প্রতিক্রিয়া বাঁধা। আসলে কী আর করা, বাগান যে কখনও সবুজকে ফেলে কংক্রিটের জামা গায়ে চাপানোর কথা ভাবতে পারে, এ তো বাংলা অভিধান বিরুদ্ধ। তাই ব্যাপারটা শোনামাত্রই তেতো করলা আর চিরতা পাতার জল খাওয়ার মত বিস্বাদ হল রুচিভাব। শ্বাসাঘাতে মনে পড়ে গেল সেই স্কুলের ভাব সম্প্রসারণ- – ‘বন্যেরা বনে সুন্দর…’ ইত্যাদি, ইত্যাদি ।
খবরটা আমরা প্রত্যেকেই মোটামুটি শুনেছি। ইতিমধ্যে এ নিয়ে রাজনৈতিক তৎপরতা, অরাজনৈতিক নাগরিক সভা, চিঠি, স্মারকপত্র, ফেসবুক স্ট্যাটাস সবই হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু পুরসভার তরফে স্পষ্টত কিছু জানা যায়নি। আদৌ কি যা শোনা যাচ্ছে তা-ই সত্য ? নাকি ভুল ব্যাখ্যায় অর্ধসত্য লুক্কায়িত ? স্পষ্ট হয়নি কিছুই। কারণ বিতর্ক চরমে চললেও পুরসভার তরফে এখনও সরকারিভাবে সবই অঘোষিত। আশা, শীঘ্রই এই ধোঁয়াশা কাটবে।
এই ঘিঞ্জি রাস্তা আর গাড়ি-ফ্ল্যাটের ভিড়ে অন্তত ওই পার্ক রোডটায় সবুজ বাঁচুক– এ বোধকরি সব নাগরিকেরই চাওয়া। কেননা সারাদিন নানা ব্যস্ততার তাগিদে যখনই দৌড়ই গান্ধীবাগের দেয়াল ঘেঁষে, এক অন্য ছায়াবৃত, প্রশান্ত পরশে ওই সবুজ চত্বরটি মগজে ভরে দেয় একঝাঁক শীতল অক্সিজেন। এখনও, ঠিক একইভাবে। তাই সরকারিভাবে সঠিক তথ্য জানার আশা, আগ্রহ দুটোই প্রবল। পুরসভার পাশে নাগরিককুল সর্বদা ছিলেন, থাকবেন নিশ্চিত। তবে উন্নয়নটা সবুজের শর্ত মাফিকই কাম্য।
গান্ধীবাগে বিনোদন পার্ক হলে সব বয়সীর মনেই আনন্দ জাগবে
লিখেছেন সোমশিখা মজুমদার
গান্ধীভাগে সত্যিই যদি এমনই এক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক হয়, তাহলে খুশির ঠিকানা থাকবে না শিলচরের মানুষের। কারণ সত্যি কথা বলতে শিলচরে এমন কিচ্ছু নেই, যা দিয়ে একটা ঘন্টা অবসর সময় কাটানো যেতে পারে। বাইরে থেকে কেউ এলে শিলচরের ঘোরাফেরার জায়গা বলতে রয়েছে এক গোলদিঘি মল, আর কিচ্ছুই এমন নেই।
গান্ধীবাগ এমন একটা জায়গা, যেখানে ভালো করে প্রেমিক প্রেমিকা চুটিয়ে প্রেমও করতে পারে না। বাচ্চারাও মন খুলে আনন্দ করতে পারে না। এমন এক জায়গায় যদি একটা সুন্দর পার্ক গড়ে তোলা হয়, তা সব বয়সী মানুষের মনে আনন্দ জাগাবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী শহর গুয়াহাটিতেও এমন সুন্দর বিনোদনমূলক পার্ক রয়েছে, তাহলে শিলচরে থাকলে ক্ষতি কি!
হ্যাঁ, যদি সবুজ ধ্বংস করা অর্থাৎ গাছপালা বিনাশের কথা ধরা হয় তাহলে শিলচর পুরসভার অধীনে শহর ও শহরতলিতে এতো বহুতল ভবন ও ফ্ল্যাটের অনুমতি দেওয়াও কমানো দরকার। পুরসভা যদি এতো ভবন তৈরি করার অনুমতি দিতে পারে, তাহলে মন মুগ্ধ করার মতো একটা বিনোদন পার্কের জন্য কী অসুবিধে! এমনও নয় যে, এখন যেভাবে পার্কটি রয়েছে, তাতে খুব যত্ন করা হচ্ছে, তা কিন্তু মোটেই নয়। প্রতি মাসে একটি করে হয়তো চারাগাছ লাগানো হয়, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। ফলে পার্কটিকে নতুন করে সাজালে একটা কিছু অন্তত হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আরও একটা কথা, নাম কা ওয়াস্তে বিনোদনমূলক পার্ক যদি বানাতে হয়, তাহলে তা বানানোর চেয়ে না বানানোই ভালো।