Barak UpdatesFeature Story
রাষ্ট্রসংঘে দেশের প্রতিনিধি, সে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা, লিখেছেন সুস্মিতা দেবRepresenting the nation in UN, a rare pride, writes Sushmita Dev
-সুস্মিতা দেব-
অক্টোবরের কথা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সভায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করি। তখনই অরাজনৈতিক এই কর্মকাণ্ডের কথা নিয়ে লেখার আগ্রহ ছিল। কিন্তু হয়ে উঠছিল না।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সভায় যাওয়ার সঙ্গে দলীয় রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। তবু হঠাৎ করে চিঠি পেয়ে বিস্মিতই হয়েছিলাম। ভারতের প্রতিনিধিত্ব করব বিরোধী দলের সাংসদ হয়ে ! খোঁজ নিয়ে দেখলাম, সব দলের সাংসদ রয়েছেন। বিজেপি, শিবসেনা তো বটেই, কেরলের এক ইউএমএফ সাংসদও ছিলেন। প্রথমে আমাকে যে সফরসূচি জানানো হয়েছিল, তাতে দেখি পুজোর দিনগুলিতে বাড়ির বাইরে থাকতে হবে। কত মানুষ আসেন বাড়ির পুজোয়! এই সুযোগে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যায়। এ বার কি সব বাদ দিতে হবে! ফোন করি সংশ্লিষ্ট যুগ্ম সচিবকে। তিনিই বললেন, দুটো গ্রুপ যাচ্ছে। তাহলে আপনাকে দ্বিতীয় গ্রুপে রেখে দিই।
আসলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ছয়টি কমিটি রয়েছে। সাংসদরা একেক কমিটিতে ভারতের বক্তব্য তুলে ধরবেন। সবাই যে সব কমিটির সভায় যাবেন, এমনও নয়। পরে জানলাম, কারা কারা যাচ্ছেন, সেই তালিকা প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত করেন। আর কে কোন কমিটিতে বলবেন, তাও সরকারই ঠিক করে। কী বলা হবে, সেই ভাষণটিও তাদেরই তৈরি করা। তবে তা দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বেই হয়। আমার বক্তৃতায় যেমন মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের কাজকর্মের উল্লেখ ছিল। আবার বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও-য়েও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। গোটা বক্তৃতাটাই ভালো। দেশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব হয়েছে। আমরা বাইরে গিয়ে দেশের জন্য বড় মুখ করেই কথা বলি। সে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক। এ ছাড়া, বক্তৃতার বিষয়টিও ছিল আমার একেবারে পছন্দের। মহিলা সবলীকরণ ও সামাজিক দায়দায়িত্ব। মাতৃত্বকালীন ছুটি, পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলা সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয় যথাযথই তুলে ধরা হয়েছে। রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে দেশের জন্যই বললাম।
আগেই অবশ্য দলের বরিষ্ঠ নেতা আনন্দ শর্মাকে চিঠির কথা জানিয়েছিলাম। তিনি বললেন, তোমার যাওয়া উচিত। দলের সংসদীয় নেতা মল্লিকার্জুন খড়গেও অনুমতি দিলেন। বললেন, তোমাকে বাছাই করায় খুব খুশি হয়েছি। অবশেষে এল সেই দিন। ৬ অক্টোবর। উড়লাম নিউইয়র্কের উদ্দেশে। পৌঁছনোর পরই মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রসঙ্ঘের মিটিং নিয়ে প্রচুর কথা বোঝালেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ইতিহাসও সুন্দরভাবে তুলে ধরলেন। মূল কাজের আগেই যে বিষয়টা আমাকে স্বস্তি দিয়েছে, তা হল ভারতীয় খাবারের বন্দোবস্ত। পুরো সফরে খাওয়া নিয়ে সমস্যা হয়নি। আগে অনেক জায়গায় এ নিয়ে আমাকে সমস্যায় পড়তে হয়।
৮ তারিখে ছিল আমার বক্তৃতা। ৫ মিনিটে কতটা আর বলা যায়! তবু ভাল লেগেছে, সবাই প্রশংসা করেছেন। বাবার কথা সে সময় বেশ মনে পড়ছিল।
ভাল লাগছে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদে ভারত এ বার সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছে। ১৯৭ সদস্যরাষ্ট্রের জন্য মোট ৫ আসন। ৫ দেশই প্রার্থী দেয়। তবু ভোটাভুটি হয়েছে। এটাই রীতি। তাই আগে থেকেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়। ভারত ছাড়াও নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ, ফিজি, ফিলিপাইন্স ও বাহরিন। ফিজির প্রার্থী শাড়ি পরে প্রচার করেছেন। বিদেশে গিয়ে এমনটা দেখতে পেলে বেশ মজাই লাগে।
তবে একটা কথা খোলামেলা বলি, বাইরে ভারতের খুব মর্যাদা। কোন সরকারের কী কৃতিত্ব, সে সব বিচার করতে যাচ্ছি না। ভারতীয় সাংসদদের সবাই অন্য উচ্চতায় দেখেন। এ এক দারুন অভিজ্ঞতা। ভোটাভুটির আগে ভারতের তরফে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। সব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাই অনুপ্রবেশ নিয়ে কথা বলছিলেন। দেখলাম, ভারত রিফিউজি ট্রিটিতে সই না করলেও অন্য দেশ থেকে আমাদের ভাবমূর্তি বেশি উজ্জ্বল। অনেক, অনেকটাই বেশি। অন্যদের কাছে জোর দিয়েই বলি, এ দেশে কেউ আশ্রয় চেয়েছে, আর ফিরিয়ে দিয়েছে, এমন ঘটনা নেই। নানা প্রসঙ্গে গান্ধীজির কথা উল্লেখ করেছি। বলেছি, বিশ্বশান্তির জন্য ভারতীয় শান্তি রক্ষী বাহিনীর ভূমিকার কথা। দেখলাম, রাজনীতিতে মহিলাদের কম অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই এক বড় সমস্যা।
বিদেশের অনেকেই অবশ্য আসামকে চেনেন। মূলত চায়ের জন্যই এই পরিচিতি। হোটেলে বলল, আমাদের আসাম টি-ই দিচ্ছে। সভা-সমিতির বাইরে সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েছি। একা ঘুরলাম নিউইয়র্কে। এ দেশে এটা তো আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। এমনিতেও তো এখানে মহিলাদের একা বেরনোর নানা সমস্যা। সে যাক্। বিদেশি প্রতিনিধিদের কাছে গর্ব করেই বললাম, ভারতে দেখুন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী মহিলা ছিলেন। অধ্যক্ষ মহিলা ছিলেন, এখনও একজন মহিলাই লোকসভার অধ্যক্ষ। আর কোন দেশে এমন উদাহরণ রয়েছে! আমেরিকাতেও নেই। এ অবশ্য সত্য কথা, বিভিন্ন সঙ্কটের মধ্যেও ভারতীয় মহিলারা কম এগোননি।
আমি দুই মহিলার কথা উল্লেখ করেই আমার লেখার ইতি টানব। তাঁদের একজন হানসা মেহতা। এই গুজরাটি সমাজসংস্কারক ১৯৪৬-৪৭ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভারতীয় প্রতিনিধি মনোনীত হয়েছিলেন। তখনই তিনি বিশ্বের কাছে লিঙ্গ সমতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর ইন্দিরা গান্ধী তো বিশ্ববাসীর কাছে ভারতবর্ষের লিঙ্গসমতার এক উদাহরণই বটে। তাই যে যাই বলুন, আমাদের গর্বের জায়গা কিন্তু কম নয়!