Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
প্রয়াত ড. আশিসকুমার রায় স্মরণে, লিখেছেন অসীমা রায়
–ড. অসীমা রায়–
‘স্মরণের আবরণে মরণেরে রাখি দূরে
যেখানেই থাকো তুমি, রয়েছো হৃদয় জুড়ে৷”
আজ এমন একজনের কথা লিখতে বসেছি, যিনি বেঁচে থাকতে আমরা কেউ তাঁর পুনর্মূল্যায়ণ করতে পারিনি৷ কারণটি ছিল, তাঁর নিজের কাজের ব্যাপারে নীরবতা বজায় রাখা৷ বলছি, আমাদের সবার প্রিয় বড়দাদা, যাকে আমরা ফুলদা বলেই ডাকতাম৷ যদিও কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন বরিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক, গুয়াহাটি রোটারি ক্লাবের জনপ্রিয় সদস্য এবং সাবেক সভাপতি৷ কিংবা শিলচর রাধামাধব এস্টেটের বিশাল জমিদারি পরিচালনার দক্ষ সেবায়েত বা পরিচালক৷ কিন্তু আমাদের কাছে তিনি পরম স্নেহশীল ও দায়িত্বপূর্ণ অভিভাবক৷ বিশেষ করে, সাত বছর আগে আমাদের মা চলে যাওয়ার পর থেকে একা্ন্নবর্তী পরিবারটিকে নিজের বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, তা সে যত বড় ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন৷ আমরা বাকি কখনও ফুলদাকে জিজ্ঞেস না করে কোনও কাজ করার কথা ভাবতেই পারতাম না৷ তাই ফুলদা, তুমি যেখানেই থাকো, নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছ, তোমার অভাবে তোমারই পারলৌকিক কাজকে সুচারুরূপে সমম্পন্ন করতে আমরা কী অসহায় বোধ করছি৷ আজ লিখতে বসে মনে হচ্ছে, কত কত তোমার থেকে জানার বাকি রয়ে গেল৷ কারণ তোমার কাছে ছিল আমাদের সকল জিজ্ঞাসার সহজ সমাধান৷দু-একদিনের বেশি কখনও দেরি হতো না, গুয়াহাটি থেকে তোমার ফোন আসত৷ সে জায়গায় গত উনিশে জানুয়ারি থেকে আজ অবধি কতদিন হয়ে গেল, তোমার কথা শুনি না ফুলদা৷ কথা বলতে বলতে কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি৷
ছোটবেলায় বাবাকে হারালেও তোমাদের মতো তিন দাদা থাকায় কোনওদিন বাবার অভাব বুঝতে পারিনি৷ বিশেষ করে, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনা-গবেষণা কিছুই সম্ভব হতো না, অভিভাবক হিসেবে তুমি সবসময় আমার পাশে না থাকলে৷
জন্মেছিলে তখনকার শিলচরের গুটিকয় বনেদী পরিবারের একটিতে৷ চলেও গেলে রাজার মতো, কাউকে কোনও কষ্ট না দিয়ে, বা নিজেও কোনও কষ্ট না পেয়ে৷কর্মক্ষেত্রে এত সুনাম বা পারিবারিক ঐতিহ্য কিছুই তোমার বিনয়কে কলুষিত করতে পারেনি৷তুমি ছিলে সবার কাছের মানুষ৷ সেই যে গুয়াহাটি বিশববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে সেখানে পড়াশোনা-গবেষণা সব শেষ করে চাকরিসূত্রে গুয়াহাটিতেই থেকে গেলে, আর সেই শহরকেই করে নিলে তোমার শেষ আশ্রয়৷ স্ত্রী-সন্তান বিয়োগের ব্যথা কাউকে বুঝতে দাওনি, শুধু আরও বেশি আপন করে নিয়েছিলে আমাদের সব ভাই-বোনদের৷নিজিকে বিলিয়ে দিয়েছিলে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে, সে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবকানন্দের মূর্তি স্থাপনেই হোক, বা শিলচর ডিএসএ-র বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাতেই হোক, অথবা দাদুর স্মৃতিতে সরকারি বালক বিদ্যালয়ের দেড়শো বছর পূর্তিতে তোরণ নির্মাণেই হোক৷
মৃত্যু অনিবার্য, আমরা সবাই জানি৷ কিন্তু মৃত্যুকে বরণ করার জন্য তোমার যে প্রস্তুতি আমরা দেখলাম, তা আমাদের স্মৃতিতে চিরঅমলিন হয়ে থাকবে৷ না হলে তুমি যে রাত দশটায় কথা বললে তোমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় ভাই অংশুর সঙ্গে, তোমার আদরের ভাইপোর সঙ্গে, জানালে তুমি পরদিন সকালের ফ্লাইটে শিলচর আসছো, ড্রাইভারকে বলা হয়ে গিয়েছে, মালপত্র গুছিয়ে নিয়েছো, সেই তুমি রাত বারোটায় আবার জানালে, তোমার শরীর খারাপ লাগায় ড্রাইভার ও পড়শিরা তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন, আর তার পনেরো মিনিটের মধ্যে খবর এল, তুমি একেবারেই সব গুছিয়ে পাড়ি দিয়েছো শিলচরের উদ্দেশে নয়, কোনও এক অজানা পথের উদ্দেশে — এও কি সম্ভব?
তোমার টিকিটটিও পড়ে রইল টেবিলের ওপর সযত্নে৷ এ যেন তোমার পরপারের টিকিট রেখে গেলে আমাদের বোঝানোর জন্য৷ দরজার কাছে রয়ে গেল নিজের হাতে গোছানো তোমার স্যুটকেস৷ শিলচর আসার অপেক্ষায় এ যেন সবাইকে কাছে না পেয়েও বলা যাওয়া, আমি বিদায় নিচ্ছি৷ ছাপাখানায় রয়ে গেল প্রায় ছাপানো শেষ হয়ে যাওয়া তোমার অপ্রকাশিত বইটি৷ বইটিরও দুর্ভাগ্য, প্রকাশকালে বঞ্চিত হবে তোমার হাতের স্নেহের পরশ থেকে৷ থেমে গেল তোমার গুয়াহাটির কালীপুরে গুরুদেব সুন্দরনাথজির আশ্রম আর শিলচর বিলপারের ঐতিহ্যবাহী রাধামাধব আখড়ার যত কর্মপরিকল্পনা৷
তবে কেন জানি না মনে হচ্ছে, তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তোমার কর্মময় জীবন শেষের পথে, না হলে মাত্র ক-দিন আগে গুয়াহাটির তোমার প্রিয় সেই ছোট্ট আশ্রয়টুকুকে রং করিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিজের একটি ফোটোও বড় করে বাঁধিয়ে রেখে যেতে না৷ এমনকী চলে যাওয়ার আগের দিন গুয়াহাটির ভারতীয় শিশুকল্যাণ সংস্থার গুয়াহাটি শাখায় গিয়ে শিশুদের দুধের খরচ বাবদ তোমার নিয়মিত দেওয়া টাকাটাও দিয়ে এলে৷এ সবই যেন ছিল তোমার চলে যাওয়ার নীরব প্রস্তুতি৷
একদিন আমাদের সবাইকেই অজানা পথে পাড়ি দিতে হবে৷ কিন্তু তোমার চলে যাওয়া যে সত্যিকার অর্থেই মাথার ওপর থেকে ছাতা সরে যাওয়া, সেটা শুধু আমরা পরিবারের সবাই যে বুঝতে পারছি, তা নয়, বুঝতে পারছে তোমার গুরুদেবের আশ্রমের ভাইবোনেরা, বুঝতে পারছে রাধামাধব এস্টেটের সব প্রজা ও কর্মচারীরা৷ হয়তো কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে সেইসব বৃদ্ধাশ্রমের গুরুজনরা ও অনাথ আশ্রমের শিশুরা, যাদের একজন নিয়মিত পৃষ্ঠপোষক ছিলে তুমি৷
তোমার কিছু ভবিষ্যত পরিকল্পনা, যা তুমি পূর্ণ করে যেতে পারোনি, আশীর্বাদ করো যেন পরবর্তী প্রজন্ম তা পূর্ণ করতে পারে৷ নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তোমার কর্মময় জীবনের এই অকস্মাত ছন্দপতনে আমরা আজ সত্যিই দিশাহারা৷