India & World UpdatesBreaking NewsFeature Story

আর্ট অব লিভিংঃ চাপমুক্ত জীবন-যাপনের খোলা পথ, লিখেছেন শতাক্ষী ভট্টাচার্য
Art of Living: Path for leading a stress free life, writes Shatakshi Bhattacharjee

//শতাক্ষী ভট্টাচার্য//
যুক্তি-তর্কের টানাটানি কার জীবনে নেই বলুন? রোজ তো একইভাবে চলে না! কিছু সুখ, আবার দুঃখ-যন্ত্রণা। কখনও জটিল সমস্যা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবকিছু কিন্তু আমাদেরই সৃষ্টি। তবুও দোষারোপ, আফশোস, প্রশংসা, নিন্দা-বন্দনা এগুলো আমাদের নিত্যসঙ্গী। কঠিন পরিস্থিতি সামনে এলেই আমরা বিচলিত হয়ে যাই। কারও অনিষ্ট করতেও পিছ পা হই না। বুঝি না ভাল-মন্দের ফারাক। কিন্তু এমনও কেউ কেউ আছেন যাঁরা সবকিছুকে মানিয়ে চলতে পারেন। পরিস্থিতি তাঁদের কাছে হার মেনে যায়। শুধু যে তাঁরা পরিস্থিতিকে বশ করে নেন, তা কিন্তু নয়, এই টোটকা জনমানসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকেন সেসব মানুষ। না, কেবল মানুষ বললে  ভুল হবে। খোদ এক চেতনাপুঞ্জ তাঁরা।আর এমনই এক চেতনাপুঞ্জ হলেন আধ্যাত্মিক গুরু শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর। আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা।
এটা ঠিক, ভাবনা ও আদর্শ নিয়ে রবিশঙ্কর যেভাবে কোটি কোটি মানুষের মনের কোণে বিশেষ জায়গা জুড়ে আছেন, তেমনি দেশ-বিদেশে সরকারিভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক। ২০১৬ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। সম্মাননা তুলে দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তাছাড়া, বিভিন্ন সময়ে প্যারু, কলম্বিয়া, প্যারাগুয়ে, মঙ্গোলিয়া, কানাডা,রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ড, ইউএসএ, জার্মানি, ব্রাজিল সহ বহু দেশ তাঁকে সম্মান দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাম্মানিক ডক্টরেটও।
গুরুজি রবিশঙ্করের হাত ধরে ১৯৮১ সালে যখন এই ফাউন্ডেশন আত্মপ্রকাশ করেছিল, হয়তো তখন কেউ আঁচ করতে পারেননি তার ব্যাপ্তি নিয়ে। আমার-আপনার পরিচিত মহলে এরকম মুখও ছিলেন যারা ঠাট্টার সুরে বলেছেন ‘বাঁচার আর্ট আবার আলাদাভাবে বোঝানোর কী আছে?’ কিন্তু জ্ঞানের ভাষা তো অন্যের কথায় নাক গলানোর পরামর্শ  দেয় না। জ্ঞান ঠিক তাঁর আপন জায়গা খুঁজে নেয়। লক্ষ্যে থাকে অবিচল। আজকের  দিনে দাঁড়িয়ে চার দশক ছুঁইছুঁই আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশনের। দেশ ছড়িয়ে বিদেশের মাটিতে এই চেতনার কিরণ প্রতিফলিত। বিশ্বের ১৬৬ দেশে গুরুজি রবিশঙ্করের দেখানো আর্ট অব লিভিং সূত্র স্বমহিমায় সফল। এক প্রবল আগ্রহের জায়গা থেকেই  নিয়ত মানুষ ধাবমান বাঁচার কলা-কৌশল আর বাঁচার প্রক্রিয়াকে আত্মস্থ করতে। তাই তো আজ ৩৭০ মিলিয়নের বেশি ডিভোটি রয়েছেন এই ফাউন্ডেশন জুড়ে। কতশত প্রশিক্ষক কাজ করছেন। ফাউন্ডেশনের বেঙ্গালুরুর প্রধান আশ্রম এখন এক আনন্দধামে পরিণত।
কী সেই প্রক্রিয়া? কী সেই আর্ট? কেন দিন দিন মানুষের  আগ্রহ বাড়ছে এই ফাউন্ডেশনের দিকে?
না, এটি কোনও ম্যাজিক নয়। প্রাচীন ও আধুনিক যোগ, আয়ুর্বেদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের  এক মিলিত নির্যাস। তার মধ্যে রয়েছে শ্রীশ্রীরবিশঙ্কররের এক অদ্ভুত গবেষণা। যা সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। বৈদিক  ঐতিহ্যকে জাত-পাতের সীমানা ছাড়িয়ে এক নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন তিনি। যেখানে রয়েছে প্রাথমিক স্তরের বালক-বালিকা থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধের  স্বত:স্ফূর্ত ও সুস্থ থাকার উপকরণ। শারীরিক, মানসিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একটা আধ্যাত্ম চেতনা জাগিয়ে তোলার মাধ্যম।
একটি সাক্ষাৎকারে গুরুজি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকের ক্ষমতা আছে। জ্ঞানের সত্ত্বা আছে। কিন্তু সে নিজেকে বুঝতে পারছে না। জানতে পারছে না। পরিস্থিতির জটিলতা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। আর্ট অফ লিভিংয়ের কাজ  তাঁর চোখ খুলে দেওয়া। অন্তর্দৃষ্টি যত প্রসারিত হবে, মানুষ তত বেশি দেখতে পারবে, বুঝতে পারবে। দৃষ্টি যদি সীমিত হয় তা হলে বেশি দূর পর্যন্ত দেখতে পাবে না। অন্তর্দৃষ্টি প্রাপ্ত হলে তবেই দৃষ্টিকোণ বদলে আসবে। এই সীমিত দৃষ্টিকে বদলানোর জন্যই ধ্যান রয়েছে, জ্ঞান রয়েছে। এই দুটো প্রাপ্ত হলে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। জীবনের সব কিছুই তখন অন্য চোখে দেখার ক্ষমতা আসে, সব কিছুই ভাল লাগবে। মানিয়ে চলতে পারবে যে কেউ।  চাপমুক্ত লাগবে নিজেকে। আর্ট অফ লিভিং মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া, মত-বিনিময়, আসন, মুদ্রা, প্রাণায়াম সহ আরও কিছু ভিন্ন স্বাদের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে এভাবেই জীবনকে উপভোগ করানোর প্রয়াস করে। শারীরিক অসুস্থতা, ব্যথা, ভয়, হতাশা, নেশা স্ট্রেস সব কিছুই আর্ট অব লিভিং-এর মাধ্যমে জয় করা সম্ভব। সদা আনন্দে বাঁচতে শেখায় এই প্রক্রিয়া। ‘
আধ্যাত্মিক গুরুর এই কথাগুলো বাস্তবেও ঠিক প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। এক্ষত্রে আর্ট অব লিভিংয়ের ‘সুদর্শন ক্রিয়া’ বলা যায় অমোঘ। যে ক্রিয়ার অভ্যাস শরীর ও মনকে যে কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সবসময় প্রস্তুত রাখে।  জাগিয়ে তোলে স্বচ্ছ ভাবনা।   আরেকটা কথা, যখন আমরা অসুস্থ হই বা  হারিয়ে যায় আমাদের আত্মবিশ্বাস, মন থাকে দ্বিধাগ্রস্থ, তখনই চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। প্রয়োজন হয় ওষুধের।  আর্ট অব লিভিংয়ের বিভিন্ন কোর্স এর সমাধান সূত্র দিতে সক্ষম।  বাচ্চাদের  প্রজ্ঞা যোগ, মেধা যোগ, উৎকর্ষ যোগ মিলিয়ে  হ্যাপিনেস, ইয়েস প্লাস, ডিএসএন, সহজ সমাধি, সইয়ম, এডভান্স  মেডিটেশন, উপনয়ন, ইটারনিটি, ভিটিপি, বিজ্ঞান ভৈরব, টিটিসি  এসব কোর্সকে যোগ বিজ্ঞান, বৈদিক পরম্পরা ও বয়সের চাহিদার মিশেলে সাজানো হয়েছে। এর মাধ্যমে চাইলে নিজের যাপনশৈলীকে পরিবর্তন  করা সম্ভব।নিজেকে সুস্থ রাখা সম্ভব। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়াতেও আর্ট অব লিভিং প্রক্রিয়া যথার্থই উপযোগী।
এখন বেশিরভাগ সমস্যা শারীরিক, সামাজিক, মানসিক এই স্ট্রেসের কারণেই হচ্ছে। সম্পর্কের ক্ষতি হচ্ছে। আর মানুষ যাতে স্ট্রেসমুক্ত জীবন কাটাতে পারে আর্ট অফ লিভিং তার জন্যই অবিরাম কাজ করে চলেছে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, কর্পোরেট সেক্টর, জেল, প্রত্যন্ত এলাকা কোন ক্ষেত্র নিয়ে ভাবছেন না গুরুজি।  শ্রীশ্রী ইউনিভার্সিটি, আয়ুর্বেদিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, শ্রীশ্রী স্কুল অব  যোগা এগুলোর পাঠ্যক্রমের মধ্য দিয়ে আজকের প্রজন্মকে   বাঁচার সঠিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন গুরু রবিশঙ্কর। এমনকী জেলের কয়েদিদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে ফাউন্ডেশনের ‘প্রিজন স্মার্ট’ প্রজেক্ট দেশ-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। তাছাড়া, শান্তির বার্তা কায়েমের কথা যেখানেই উঠেছে, ডাক পেলে এই আধ্যাত্মিক গুরু ছুটে গেছেন। কখনও নিজেই শান্তি ও অহিংসার পথে চলার পরামর্শ দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে করোনা মহামারির সঙ্গে যুজছে গোটা বিশ্ব। আমাদের দেশেও ক্রমশ বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। লোকডাউন ও করোনা আতঙ্কে চাপের শিকার হচ্ছেন মানুষ। এই অবস্থায় পাশে রয়েছে ফাউন্ডেশন। করোনা সতর্কতার দরুন সরাসরি কোর্স আয়োজন না করতে পারলেও আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশন বসে নেই। গুরু রবিশঙ্করের পরামর্শে অনলাইনে চলছে কোর্স। চাপমুক্ত ও কর্মক্ষম থাকার রসদ পাচ্ছেন সব্বাই।
১৩ মে, ১৯৫৬। দক্ষিণ ভারতের বিশালাক্ষী রত্নম ও  আর এস ভেঙ্কট রত্নমের কোল আলো করে একটি শিশু জন্ম নিয়েছিল।  সাধারণ পাঠ্যক্রমের পর বৈদিক সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেই তাঁর বেড়ে ওঠা। পরবর্তী সময়ে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেই তাঁকে জানে গোটা বিশ্ব। তিনিই বিশ্ববরেণ্য শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর। আজ তাঁর ৬৪ তম জন্মদিন। প্রত্যেকেই যে যার মতো করে নিজেদের আত্মীয়-পরিজনদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানায় বা উপহার দেয়। এখানে রবিশঙ্করই বা ব্যতিক্রমী হবেন কেন? হ্যাঁ, আজকের এই  করোনা সঙ্কট ও  অনিশ্চয়তার আবহে আর্ট অব লিভিংয়ের সূত্রকে আঁকড়ে ধরে  যদি আমরা চলতে পারি, কাটাতে পারি সুস্থ ও স্বস্তির জীবন। মনে হয় এটাই হবে গুরুজির জন্মদিনের সঠিক উপহার। কারণ, একটি চাপমুক্ত ও দ্বেষহীন পৃথিবীই তো চাইছেন রবিশঙ্কর।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker