Barak UpdatesHappeningsAnalyticsBreaking NewsFeature Story
দুজনকেই কাছে থেকে দেখেছি, সর্বানন্দ-হিমন্ত যেন রাম আর ভরত, লিখেছেন ডা. রাজদীপ রায়
'রাজনৈতিক বিরোধিতার সময়েও কর্মনিষ্ঠার জন্য হিমন্তদাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতাম'
বাবার মৃত্যুর কয়েকদিন পর আমি আমাদের নারী শিক্ষাশ্রমের কিছু কাজ নিয়ে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কাছে গিয়েছিলাম। তখন তিনি আসামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তরুণ গগৈ মুখ্যমন্ত্রী। সে সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াটা খুব কঠিন ছিল। একেকদিন তাঁকে দুই-আড়াইশো মানুষের কথা শুনতে হতো।
তাই আমি গুয়াহাটি গিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি রঞ্জিত দত্তের সঙ্গে দেখা করি। তিনিই আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আমি প্রথমবারের মত হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মুখোমুখি হই। তিনি যখন জানলেন, আমাকে রঞ্জিত দত্ত পাঠিয়েছেন, আর আমি প্রয়াত বিমলাংশু রায়ের ছেলে, একজন ডাক্তারও, গিয়েছি নারী শিক্ষাশ্রমের কাজে, তিনি মাথা না তুলেই ওএসডি-কে ডেকে পাঠালেন। ঘরে ২০-৩০জন মানুষ বসা৷ একেকজনের একেকরকম সমস্যা৷ আমার সমস্যা অবশ্য সেখানে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন পড়েনি৷ আমি কিছু বলার আগেই তিনি ওএসডি-কে বলতে লাগলেন, “ডা. রাজদীপ যে হাসপাতালের সমস্যা নিয়ে এসেছেন, সেখানে আমি একটা দালানবাড়ির উদ্বোধন করে এসেছি। তিনি ওই হাসপাতালের কী সমস্যা নিয়ে এসেছেন, আপনি এর সমাধান করে দিন। তিনি কিন্তু এখানে থাকবেন না। শিলচর থেকে এসেছেন। দুদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে হবে।”
আমি তখন স্বাস্থ্য বিভাগের ওএসডির সঙ্গে কথা বলি। সমস্যাটা ভাল করে বোঝাই। আমি শিলচরে আসার দুদিন পরেই কাছাড়ের তখনকার ডেপুটি কমিশনার ফোন করে জানালেন, আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। আপনি একবার মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কথা বলবেন।
পরবর্তীকালে নারী শিক্ষাশ্রমের অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কয়েক দফা কথা হয়। বিশেষ করে, নার্সিং স্কুল খোলার সময় তাঁর বেশ প্রয়োজন পড়ে। ২০১১ সালে তিনি শিলচরে আসেন সুস্মিতা দেবের পক্ষে প্রচারের জন্য। আমি সে বার সুস্মিতার বিরুদ্ধে প্রার্থী। তিনি আমার বিরুদ্ধে বেশ প্রচার করে গেলেন। তাঁর সার্থক রণনীতির জন্য আমি সে বার পরাস্ত হই। পরে আমি ২০১৩ সালের পুরসভা নির্বাচনে তাঁর কেন্দ্রে গিয়ে সভা-সমিতি করি। মালিগাঁওয়ের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে পার্টি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জানতেন, আমি তাঁর এলাকায় প্রচারে গিয়েছি। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার। তাঁর কর্মপদ্ধতি সেই শুরু থেকে আমার কাছে সমীহের জায়গা তৈরি করে নেয়। কংগ্রেস আমলের মন্ত্রী হিসেবেও তাঁকে দেখেছি, তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে খুব ভালবাসেন। একজন সার্জন হিসেবে আমাকেও দ্রুত এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেখান থেকে আমি দেখেছি, তাঁর সঙ্গে আমার কর্মপদ্ধতির কোথায় যেন একটা মিল রয়েছে। কোনও কাজ তিনি ফেলে রাখেন না। ব্যস্ত থাকলেও দ্রুত কাজ সেরে নেন।
তিনি আসলে সার্জনদের মতই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে ভালবাসেন। সার্জন হিসেবে এ ব্যাপারে আমাদের আগেই প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। কিন্তু হিমন্তদা নিজে থেকেই প্রশিক্ষিত। অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারেন। ওই পরিশ্রমের জন্যই গত ২০ বছর ধরে যে মন্ত্রকে গিয়েছেন, আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে যেমন কংগ্রেস আমলে, তেমনি বিজেপি আমলে তিনি সফল হয়েছেন। বেশি দূর না গিয়ে আমরা যদি গত দুই বছরের করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে তাঁর ভূমিকাটা খেয়াল করি, তাহলে কেউ বিস্মিত না হয়ে পারেন না। আসামের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তিনি যেভাবে যুদ্ধ করে চলেছেন, তাঁর নাম আসামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ৫০ বছর পরও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে কথা উঠলেই তাঁর কথা বলতে হবে। তাঁর আমলেই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে।
আরও একটা বলতেই হয়, সর্বানন্দ সোনোয়ালের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে বহু কথা বাজারে চাউর রয়েছে। কিন্তু দুইজনকেই আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। এ তো রাম-ভরতের সম্পর্ক। দুজনের সম্পর্কের রসায়নটা একেবারে অন্যরকম। গত পাঁচ বছর সর্বানন্দ সোনোয়াল মন্ত্রিসভার নয়টা গুরুত্বপূর্ণ দফতর চালান হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। হিমন্ত সর্বানন্দ সোনোয়ালকে সব সময় বড় ভাইয়ের মত দেখেন। হিমন্ত যা-ই ভাবতেন না কেন, শেষ কথাটা কিন্তু সর্বানন্দ সোনোয়ালই বলতেন। সে জায়গায় সর্বানন্দও হিমন্তকে ছোট ভাইয়ের মত প্রযোজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। দুইজনের ভাব-ভালবাসার প্রচুর মুহুর্তের সাক্ষী আমি। দুজনকে একসঙ্গে প্রাণ খুলে হাসতে আমি বহু বার দেখেছি। দুজনে আড্ডা মেরেছেন বহুদিন।
হিমন্ত আজ নিজের কর্মদক্ষতার ফলে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। সর্বানন্দ সোনোয়ালও সর্ব-ত্যাগ করে দেখিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয় জনতা পার্টিতে পরে এলেও তিনি গোড়ার বিজেপি নেতাদের চেয়ে কোনও অংশে কম নন। প্রবীণ বিজেপি নেতারা সব সময়েই বলেন, দেশ আগে, পার্টি পরে। এটা ত্যাগের উদাহরণ। আজ সর্বানন্দ সোনোয়াল দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি কবেই বিজেপির মূলধারায় ঢুকে গিয়েছেন। আমি আশা করি, আগামী পাঁচ বছর হিমন্ত বিশ্ব শর্মা যে সরকার চালাবে, তাতে সর্বানন্দ সোনোয়ালের ছাপ আমরা টের পাব। সবকা সাথ সবকা বিকাশ এবং বরাক ব্রহ্মপুত্র পাহাড় ভৈয়ামের যে কাজ চলছে একে আরও গতিসম্পন্ন করে তোলা হবে।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে এবং বরাকবাসীর পক্ষে তাঁকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আশা করছি, বরাক তাঁর স্নেহমাখা দৃষ্টিতে সবসময় থাকবে।
আমার আজ বেশ মনে পড়ছে ২০১৯ সালের দুর্গাপূজার কথা। আমি একদিন তাঁকে শিলচরের পূজো দেখতে বলেছিলাম। তিনি পূজার দুইদিন আগে আমায় ফোন করলেন। বললেন, একদিন শিলচরে দুর্গাপূজা দেখবেন। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আধাদিন না পুরো দিন। তিনি জানালেন, পুরো দিন। দিন রাত্রি। সকাল-বিকেলে মিলিয়ে আমরা ৭০টি পুজো মণ্ডপে যাই। দুজনে একসঙ্গে হেঁটে পুজো দেখি। সে এক বিশাল উপলব্ধি!
আরও একদিনের কথা আমাকে উল্লেখ করতেই হয়। সিএএ নিয়ে সংসদে যেদিন বিতর্ক হয়েছিল, সেদিন তিনি দিল্লিতে গিয়েছিলেন। সকালেই আসামের সব বিজেপি সাংসদদের বের করে আনেন। বিলটি নিয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে যেদিন রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বক্তৃতা করেছিলেন,আমরা সেদিন একসঙ্গে গ্যালারিতে বসে বক্তৃতা শুনেছি। আমি, হিমন্তবিশ্ব শর্মা ও দিলীপ শইকিয়া। সে রাতে আমরা আসামের সাত-আটজন এমপি হিমন্তদার সঙ্গে সময় কাটাই। সারা রাত আসাম হাউসে ছিলাম। আমরা সেখান থেকে জানতে পারছিলাম, বিলের বিরুদ্ধে স্থানে স্থানে আগুন জ্বলছে। সারা রাত তিনি আমাদের সঙ্গে বসে সমস্ত জায়গার খবর নিলেন। পরে ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে গেলেন বিমানবন্দরের উদ্দেশে। গুয়াহাটি পৌঁছে সর্বানন্দ সোনোয়ালকে সঙ্গে নিয়ে এর সমাধানের উপায় বের করলেন।
আমি হিমন্তদার সঙ্গে হেলিকপ্টার চড়েছি অসংখ্যবার। তিনি এত কাজের মধ্যেও কীভাবে যেন চাপমুক্ত থাকেন! রাজনীতির মধ্যে মধ্যে ব্যক্তিগত খবরাখবরও নেন। আমার জীবনজ্যোতি হাসপাতাল ও শিবসুন্দরী নারী শিক্ষাশ্রমের কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন। বরাক উপত্যকার উন্নয়ন নিয়ে তিনি তাঁর ভাবনা অনেকবার আমার সঙ্গে ভাগ করেছেন। আমিও আমার ভাবনার কথা জানিয়েছি। দুজনের ভাবনার সাযুজ্য রয়েছে। সে জন্যই আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভাল।
আর সত্যি কথা বললে, তাঁর রাজনৈতিক পরিপক্কতা, কর্মক্ষমতা ও নিষ্ঠা যে আমাকে সারাক্ষণ আকৃষ্ট করে!
(লেখক ডা. রাজদীপ রায় অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ, প্রদেশ বিজেপির সাধারণ সম্পাদক এবং শিলচরের সাংসদ)