Barak UpdatesHappeningsAnalyticsBreaking News

২০২০ বিদায়, ২১ বরণঃ কী বলেন বরাক উপত্যকার মানুষ

//ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্য//

২০২০-র শেষলগ্নে একটা কথাই বলি, এই ধরনের বিপর্যয় যেন আর আমাদের সামনে না আসে। তবে করোনা একটা শিক্ষাও আমাদের দিয়েছে। আমরা যতই আমাদের বুদ্ধি বা মেধার বড়াই করি না কেন, আমাদের জ্ঞানটা এখনও একটা জায়গায় আটকে আছে। কারণ প্রায় এক বছর সময় লাগল প্রতিষেধক বের করতে। এ থেকে এই শিক্ষা নিতে হয় যে, মানুষের জ্ঞান এখনও সীমিত। তাই ২০২১-র মুখে বলব, এমন করুণ অভিজ্ঞতা যেন আর আমাদের না হয়। নতুন বছরে সব মানুষ সুখে থাকুক।

আর একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বলছি। নর্মাল স্কুলের প্রজেক্টটা ২০২১-র মধ্যে যেন শেষ হয়। এই প্রজেক্টকে আমার এত  গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হল, বরাক উপত্যকার মধ্যযুগের সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং ইতিহাসের অজস্র উপকরণ নর্মাল স্কুলে লুকিয়ে রয়েছে।

//ঋষিকেশ চক্রবর্তী//

২০২০ বছরটা আমাদের কাছে একটা অভাবনীয় আতঙ্ক নিয়ে এসেছিল। বিশ্ব জুড়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে, আমরা সবাই এর শিকার হয়েছি। আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক– সমস্ত দিক থেকে প্রতিটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আগামী বছর ২০২১-এ আশা করি, এই অন্ধকার কাটিয়ে আমরা আবার আলোর দিকে যাত্রা করতে পারব। নতুন বছর নতুন প্রত্যাশা নিয়ে আসুক।

এই অতিমারির সময়ে আমাদের পেশাদার শিল্পীরা প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কারণ দীর্ঘদিন কোনও অনুষ্ঠান নেই। কণ্ঠসঙ্গীত বলুন আর যন্ত্রসঙ্গীত, যাঁরা এই পেশাতে থেকে জীবিকা অর্জন করেন, তাঁরা বলতে গেলে, কয়েকমাস উপার্জনহীন কাটিয়েছেন। সবচেয়ে দুঃখের কথা, অন্যান্য জায়গায় শিল্পীদের সামান্য হলেও আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়েছে। বরাক উপত্যকায় কোনও শিল্পী কোনও সরকারি সাহায্য বা অনুদান পাননি। অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা এই পেশা থেকে সরে  অন্যান্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছেন। এটা বরাক উপত্যকার জন্য, সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতির জন্যই লজ্জাজনক উদাহরণ। কেউ সবজি বিক্রি করছেন, কেউ ঠেলা চালাচ্ছেন। এখনও বলতে গেলে অনুষ্ঠান শুরু হয়নি, ফলে শিল্পীদের আর্থিক সুরাহা এই সময়ে হয়নি।

//কমল চক্রবর্তী//

২০২০ সালের বেশির ভাগটাই আমাকে ডি ভোটার আর ডিটেনশন ক্যাম্পের ব্যাপার নিয়ে থাকতে হয়েছে। ২০২১-এও ওইসব লেগেই থাকবে। যদিও সংখ্যাটা অনেক কমে গিয়েছে। কিন্তু আমি ভাবছি ২০২১ নিয়ে। ভয়ঙ্কর দিন। অর্থনৈতিক দিক থেকে মানুষ খুব খারাপ অবস্থায়। সরকার এখনই যদি মানুষকে আর্থিক স্বনির্ভর করার কথা না ভাবে, তাহলে কী যে হবে! ছোট ছোট শিল্প কারখানা করা দরকার। নইলে সামনের বিপদ সামাল দেওয়া মুশকিল। ভোটের কথা বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক দিকে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

//বিনোদলাল চক্রবর্তী//

২০২০ বহু উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে আসে। সামাজিক বন্ধন শিথিল করে দিয়েছিল। আমরা আশা করছিলাম, একটা সময়ের পরে সময়ের ধারাবাহিকতা ফিরে আসবে। সে জন্য একে ‘স্পোর্টিংলি’ নিয়েছিলাম। কারণ জীবনে এর আগেও কম ধাক্কা সামলাতে হয়নি। কিন্তু এখন করোনার যে নতুন চেহারা বেরিয়ে আসছে, তা চিন্তার। করোনার পাশাপাশি কৃষক আন্দোলনও দেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা দেবে।

//দুলাল মিত্র//

২০২০ আমার ব্যক্তিগতভাবে জীবনে এ রকম একটা সঙ্কটময় ছিল, কী যে বলি! প্রথমে লকডাউন। পরে দাদার মৃত্যু। কোভিডে মারা গিয়েছেন বলে দাদার মুখটা কেউ দেখতে পারল না। মুখাগ্নি হল না। এটা আমাদের পরিবারের কাছে বড় একটা আক্ষেপ। বড় ছেলের মুখ শেষবারের মত দেখতে পাননি বলে ৯২ বছর বয়সে মা আজও কেঁদে ভাসান। আর্থিক দিকেও  আমার বিশাল ক্ষতি হয়েছে। করোনা আমার কম্প্যুটার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এনআইআইটি-তেও লালবাতি জ্বালিয়ে ছেড়েছে। পুরো বছর ছাত্রভর্তি নেই। ঘরভাড়া, প্রশিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন মিলবে কোথা থেকে! তাই কিছুদিন আগে বন্ধই করে দিই। এর পরও এনআইআইটি নিয়ে সমস্যা মেটেনি।

এ তো আমার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক। সামগ্রিকভাবেই মানুষ আর্থিক দিক থেকে বড় সমস্যায়। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, খুব বাজে অবস্থায়। রাজনৈতিক দিক থেকেও ২০২০ ভাল যায়নি। প্রশাসনের দিক থেকে বিরোধী দলগুলি চরম বৈষম্যের শিকার। আমরা মিছিল, মিটিং করতে পারছি না। প্রশাসন আমাদের অনুমতি দেয় না। মাইক কেড়ে নেয়। অথচ কিছু দল-সংগঠন নিয়মিত সভা-সমিতি করছে।

//দিলু দাস//

শিলচরের এক বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করি। করোনার প্রভাবে রোজগার প্রায় বন্ধ। আমার মাসিক বেতন সামান্যই। এন্ডোস্কোপি-পিছু যা মেলে, সেটাই মূল উপার্জন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেই করোনার প্রভাবে এন্ডোস্কোপি বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে স্ত্রী, পুত্র করোনায় আক্রান্ত হন। একই রোগে দাদা-শ্বশুর রণেন্দ্র দেব প্রাণ হারান। রোগীর খোঁজ নিতে গেলে বহু ঝামেলার পর তাঁর ছেলেরা জানতে পারেন, তিনদিন আগেই তিনি মারা গিয়েছেন। তবে ২০২০ বলুন, আর করোনা বলুন, আমাদের কিছু শিখিয়েছেও। করোনা শিখিয়েছে মানুষকে সাহায্য করতে। আমি নেতাজি ছাত্র যুব সংস্থার সম্পাদক। সংস্থার হয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, মানুষ এগিয়ে রয়েছে সাহায্য করার জন্য। ফেসবুকের এক আবেদনে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা উঠে যায়। সুপ্তা সেন নামে এক সহৃদয় মহিলা অ্যাম্বুল্যান্স কিনে দিলেন আমাদের। আবার উল্টো দৃশ্যও দেখেছি। অনেকে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেননি। করোনা রোগীকে আনতে গিয়েছি, পাশের ফ্ল্যাটের মানুষ আমাদের বাধা দিয়েছেন। রোগীকে অসুস্থ শরীরে উৎকণ্ঠার মধ্যেই একা হেঁটে হেঁটে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠতে হয়েছে। ফোন করলেও আত্মীয়রা নানা কথায় এড়িয়ে গিয়েছেন। ২০২১-এ একটা ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল ইউনিট করতে চাইছি। রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে শহরের মানুষ বড় অসহায় বোধ করেন। কোথাও ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা মেলে না। আমরা তাঁদের জরুরি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করব।

//ড. সুমিতা ভট্টাচার্য//

আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা বললে, ২০২০ সালে আনন্দ-বিষাদ দুইই পেয়েছি। এই বছরে আমি পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছি। এর জন্য অনেকদিন অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু করোনা সে আনন্দের প্রায় সবটাই কেড়ে নিয়েছে৷ এ নিয়ে শুরু থেকে ভয় ছিল। সতর্কও ছিলাম। এর পরও করোনা ঘরেই ঢুকে গেল। ভাবিনি, এমনটা হবে। সামগ্রিকভাবে বললে, বছরের প্রথম থেকেই গোটা পৃথিবী অশান্ত হয়ে পড়ল। নানা ধরনের সংকট। কত মানুষের রোজগার গিয়েছে। ২০২১-এ যখন ভ্যাকসিনের অপেক্ষা করছি, তখন করোনার নতুন চেহারায় আসাটা ভয় বাড়াচ্ছে। ফলে ২০২১টা ২০২০-র মত যায় কিনা, সেটা-ই চিন্তার।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker