Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story

প্রকৃতির সতর্কবার্তা না বুঝলে ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশই করতে হবে, লিখেছেন হিমাদ্রি শেখর দাস

বন্যার বিভীষিকা (চার)

হিমাদ্রি শেখর দাস

প্রকৃতি কি প্রতিশোধ নেয়? এই প্রশ্ন আমার মনে অনেকবার ঘুরপাক খেয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা গভীরভাবে তলিয়ে দেখার তাগিদ এর আগে অনুভব করিনি। প্রকৃতি-সৃষ্ট সংসারের উপর মানুষের অত্যাচারের সীমারেখা অতিক্রম করলেই প্রকৃতি রুদ্ররূপ ধারণ করেন, আর অতিমারি, বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, অনাবৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমেই তিনি সংহারের চিত্রনাট্য লিখেন। এটাই আমরা জানি। সারাটা দিন নানা কাজের পর সন্ধ্যায় বারান্দায় যখন এসে বসতাম তখন নানা চিন্তা মাথায় ভিড় করত। অজানা ভয়, দুশ্চিন্তা যেন মনকে গ্রাস করে ফেলত। রাতের আকাশে মেঘের আড়ালে চাঁদের লুকোচুরি খেলার অসাধারণ দৃশ্যও যেন তখন ফিকে লাগতো।

তবে বন্যার জলে চাঁদের আলো হঠাৎ পড়লে মন জানি কেমন করে দুলে উঠত। মনে হতো যেন ভাবনায় নতুন সুর লেগেছে। ‘প্রতিশোধ’ শব্দের প্রতিই কখন যে এক আপত্তির জন্ম হলো নিজেই বুঝতে পারিনি। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ না ‘প্রকৃতির সতর্কবার্তা’? দ্বিতীয়টাই আমার কাছে সঠিক বলে মনে হলো। বন্যার কারণ যদি আমরা গভীরভাবে অধ্যয়ন করি তাহলেই দেখতে পাবো যে এর জন্য আমরা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে দায়ী। তাহলে মিছে কেন প্রকৃতিকে দোষারোপ করা ! শিলচরের ভয়াবহ বন্যা প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, বরং এক সতর্কবার্তা! আগামীতে যদি আমরা সাবধান না হই তবে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না।

বলতে গেলে, ২১ জুনের সকাল থেকে আমাদের বাড়ির চারিদিকে মহল্লায় এক প্রশ্নই ঘোরপাক খেতে শুরু করলো, “মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?”  সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ নাটকের সংলাপ এই বন্যায় যে এভাবে ব্যবহৃত হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। রাস্তায় নৌকা চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকেই মাঝি বা কোনও পথিককে জল ঠেলে এগিয়ে যেতে দেখলেই এই প্রশ্ন ছোঁড়া হতো। পানীয় জলের সমস্যা যে ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে, তা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ প্রথম ২-৩ দিন বন্যার জল স্থিতাবস্থা থাকায় এই আশঙ্কা আরও দৃঢ় হচ্ছিল। আমাদের রিজার্ভারে বন্যার দূষিত জল ঢুকে পড়ায় তা আর ব্যবহারের যোগ্য রইল না। বাড়ির দ্বিতীয় তলে জলের ট্যাঙ্কে ১০০০ লিটার পানীয় জলের স্টক রয়েছে কিন্তু রান্নাবান্না আর জল পান করার পর দু’দিন কষ্ট করে আমরা চলতে পারব। আমি, মা, আমার স্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন বাড়ির মালিক।

চারজনের সংসারে এই ট্যাংকের জল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। জলের চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ২৩ জুন পর্যন্ত ম্যানেজ হলো। কিন্তু ২৪ জুনের সকালেই এক ভয় এসে গ্রাস করলো। কোথায় পাবো পানীয় জল?
২৪ জুন সকাল থেকেই শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। ‘মানুষ মানুষের জন্য’-এই গানখানির কথাই তখন মনে পড়লো যখন সুদীপ্তা নার্সিং হোমের এক কর্মী তথা সমাজসেবী দিলু দাস এক কার্টুন জল নিয়ে আমাদের গেটে এসে আমাকে ডাকতে শুরু করলেন। ফেসবুকের মাধ্যমেই পরিচয়। তিনি গলা জল ঠেলে আমার সিঁড়ির নিচে জলের কার্টুন রেখে গেলেন। নেতাজি ছাত্র যুব সংস্থার হয়েই নাকি তিনি এই রিলিফ শুরু করেছেন। দিলু দাসের মাধ্যমেই এই বন্যায় প্রথম সাহায্য আমাদের ঘরে এসে পৌঁছাল।

আজ কিছু মানুষের অবদানের কথা শেয়ার না করলে এই লেখার কোনও মানেই থাকবে না। এদের মধ্যে অনেকেই আমাকে বলে গিয়েছিলেন যে, সামাজিক মাধ্যম বা সংবাদপত্রে তাঁদের কথা যেন না লিখি। কিন্তু আমি সেই অনুরোধ রাখতে পারব না বলে জানিয়ে দিয়েছিলাম। ইতিবাচক কাজ সমাজের কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তো আমাদেরই। তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। তাঁদের ঋণ শোধ করা এই জীবনে সম্ভব নয়। এই পরোপকারী মানুষগুলোই এমন যে তাঁরা প্রচারের বৃত্তের বাইরে থাকতেই ভালোবাসেন।

সেদিন দুপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক শিলচর শাখার তরফ থেকে আমার ছাত্র ড. অবিনাশ শুক্লবৈদ্য জলের কার্টুন, আর কিছু অত্যাবশ্যক সামগ্রী আমার ঘরে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল। অবিনাশ আমার তত্বাবধানেই আসাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম ফিল এবং পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেছে। স্যারের এই দুঃসময়ে সে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি একজন শিক্ষকের জীবনে আর কী হতে পারে! হাইলাকান্দির সাংবাদিক শঙ্করী চৌধুরীকেও ধন্যবাদ জানাতে হয়। কারণ তিনিও কিছু পরিচিত লোককে বলেছিলেন যে আমার বাড়িতে যেন পানীয় জল পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। আরও কিছু নাম আমাকে উল্লেখ করতেই হবে৷

(লেখক ড. হিমাদ্রি শেখর দাস আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক )

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker