Barak UpdatesHappeningsBreaking News
ঘরে জল ঢুকতে শুরু করল, বাকিটা ইতিহাস.., লিখেছেন হিমাদ্রি শেখর দাস
বন্যার বিভীষিকা (দুই)
২০ জুন সকালে স্থানীয় একটি পত্রিকায় আমার এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ”বৃষ্টিলিপি’ শীর্ষক সেই প্রবন্ধে কিছু গবেষণার উল্লেখ করে লিখেছিলাম যে, আগামীতে উত্তর-পূর্বে অতিবৃষ্টি হবার সম্ভাবনা প্রবল। স্বল্প বৃষ্টিতে শিলচরে ঘন ঘন বন্যা কেন হয়, এর কারণ দর্শানোও ছিলো সেই প্রবন্ধে। কিন্তু বন্যার প্রবল আঘাত যে খুব শীগগিরই আমাদের জীবনকে ছারখার করতে চলেছে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি৷ সকালে নিউজহকার কলিং বেল বাজিয়ে পত্রিকাখানি দিয়ে যাবার প্রাক মুহূর্তে একটি দুঃসংবাদ দিয়ে গেলো যে, রাঙিরখাড়ি পয়েন্টে খুব দ্রুত গতিতে জল বাড়ছে। সম্ভবত বেতুকান্দির বাঁধ ভেঙেছে। সাধারণত ছেলেটি পত্রিকা গেটে গুঁজে রেখে চলে যায়, কিন্তু সেদিন ব্যতিক্রম ঘটল। ঘরে এসে আমাদের ঘুম থেকে তুলে সাবধান করে দিয়ে গেল।
সকাল সাড়ে সাতটায় এই খবর পাবার পর আমাদের মাথায় যেন বাজ পড়ল। ঘুমের আড়ষ্টতা কাটতে না কাটতেই দেখতে পেলাম, সকাল আটটায় বিদ্যাসাগর সরণীতে বন্যার জল খুব দ্রুত গতিতে ঢুকতে শুরু করেছে। চটজলদি আমার মারুতি ওয়াগন গাড়ি পাশের বাড়ির গ্যারেজ থেকে বের করে ঘরের সামনে উঁচু জায়গায় পার্ক করি। তারপর ঘরে এসে জিনিষ গোছানোর কাজ শুরু হয়। পত্রিকাখানি কোথায় রেখেছিলাম ভুলে গিয়েছি। সাড়ে আটটায় ঘরে জল ঢুকতে শুরু করল। বাকিটা ইতিহাস…। বৃহত্তর রাঙিরখাড়ি এলাকার প্রায় সবার এক কাহিনি। গ্রাউন্ড ফ্লোরে যারা ছিলেন তাঁরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।
শিলচরে হওয়া ভয়াবহ বন্যার টুকরো টুকরো চালচিত্র স্মার্টফোনের নোটপ্যাডে সেই ২৩ জুন লিখে রেখেছিলাম। সেটাই আজ এখানে তুলে ধরছি।
“এখনও বৃহত্তর রাঙিরখাড়ি অঞ্চলে জলস্তর তেমনভাবে কমেনি। গ্রাউন্ড ফ্লোরে ভাড়া থাকার সুবাদে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি আমরা। আমার নতুন গাড়ি এবং স্কুটার জলের নিচে ডুবে রয়েছে। ঘরের ভেতরে গলা অবধি জলের মধ্যে রয়েছে ফ্রিজ, ইনভার্টার, আলমারী, সোফাসেট সহ অন্যান্য আসবাবপত্র। জানি না এই বিপদ থেকে কখন বেরিয়ে আসতে পারবো।
চোখের সামনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলো লিখে রাখা খুব দরকার।
১) ‘বাবা, আমার জন্য এক প্যাকেট ম্যাগি আনতে ভুলবেনা কিন্তু’। শিলচরের বিদ্যাসাগর সরণী-তে (সুদীপ্তা নার্সিং হোমের গলি) অবস্থিত একটি ফ্ল্যাটের তিন তলার ব্যালকনি থেকে ছোট্ট মেয়ের আবদার। বাবা বুক জলে একটা বাঁশের সাহায্যে দাঁড়িয়ে মেয়েকে হাত দেখিয়ে আশ্বস্ত করলেন। বলতে গেলে ঘরে কিছুই নেই। চারদিন ধরে বন্যার জলস্তর স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। মেহেরপুরের দিকে যাচ্ছেন যদি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা যায়।
২) মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমার মেয়ে ঐশীর সঙ্গে গত তিনদিন ধরে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে বিবেকানন্দ রোডে দাদুর বাড়িতে রয়েছে সে। আমার শ্বশুর বাড়িতেও গ্রাউন্ড ফ্লোরে জল ঢুকেছে। কিন্তু খবর জানার কোনও উপায় নেই। বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও সাহায্য চাওয়ার উপায় নেই। কিছু বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। ছেলেমেয়েরা রয়েছে চাকরি সূত্রে বাইরে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে তাঁরা ব্যর্থ। ইচ্ছাকৃতভাবে নেটওয়ার্ক বিকল করে রাখা হয়েছে কিনা এর সদুত্তর জানা নেই। হয়তো সামাজিক মাধ্যমে জনসাধারণের অসুবিধার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে এই ভয়ে মোবাইল টাওয়ারগুলো অকেজো করে রাখা হয়েছে। নইলে জেনারেটর চালিয়েও টাওয়ার সতেজ রাখা যেতো বলেই ভুক্তভোগীরা বলছেন।
৩) বন্যার চতুর্থ দিন (২৩ জুন ২০২২)। মাথার উপরে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে অনেকেই হাত নাড়ছে, কেউ কেউ আবার লাল কাপড় ছোট্ট বাঁশে লাগিয়ে সিগনাল দেখাচ্ছেন। কয়েক চক্কর মেরে দু’টো বিল্ডিংয়ের ছাদে কিছু ত্রাণের প্যাকেট ফেলেই হেলিকপ্টার দলের দায়িত্ব শেষ। শোনা যাচ্ছে, আজ নাকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই অঞ্চল পরিদর্শনে আসবেন। সারাটা দিন হেলিকপ্টার এই অঞ্চল চষে বেড়ালো বিশেষ কোনও ত্রাণ না দিয়েই। বরং হেলিকপ্টারের বিকট শব্দ ভীষণ বিরক্তিকর লেগেছে অনেকের কাছে।
৪) বৃহত্তর রাঙিরখাড়ি এলাকার প্রায় সব গাড়ি, স্কুটার, বাইক জলের তলে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেবে কিনা এনিয়ে চলছে জোর চর্চা।
৫) চারিদিকে অথৈ জল, কিন্তু এক ফোটা জল মুখে দেবার উপায় নেই। বিশুদ্ধ পানীয় জলের হাহাকার সম্পূর্ণ অঞ্চলে। প্রশাসনের তরফ থেকে পানীয় জলের পাউচ বা বোতল বিতরণ করার কোনও উদ্যোগ সে দিনও নজরে এলো না।
৬) প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছেন প্রবীণ নাগরিক। অনেকেরই ঔষধ ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু কিনে নিয়ে আসাটাই মুশকিল। এছাড়া মৃত্যুশয্যায় রয়েছেন এক-দু’জন লোক। জরুরীকালীন পরিষেবার কোনও ব্যবস্থা নেই। পাশের বাড়িতে এক ভদ্রলোকের দিদি মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তিনি এই পৃথিবীতে আছেন কিনা তাও জানতে পারেননি আমার ওই প্রতিবেশী।
৭) চারিদিকে বাচ্চাদের আর্তনাদ। খাবার ফুরিয়ে গেছে। জল নেই। এ যেন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
৮) বাড়িতে পাঁচজন মানুষ। গ্রাউন্ড ফ্লোর জলের তলে। রয়েছে শুধু সিঁড়ি ঘর। সেখানেই তিনটি রাত কাটালেন সেই পরিবারের লোক। অনেক কষ্টে নৌকা জোগাড় করে তৃতীয় দিনে নিরাপদ আস্তানায় চলে গেলেন তাঁরা।
৯) আবর্জনার প্যাকেট জলে ভেসে যাচ্ছে। পাশের বাড়ি থেকেও এক ভদ্রমহিলা পুরানো এক প্যাকেট বহমান বন্যার জলে ছুঁড়ে মারলেন। জল নেমে গেলেই রাস্তার শোভা বর্ধন করবে মানবসৃষ্ট বর্জ্য পদার্থগুলো!
১০) এক লিটার প্যাকেজড পানীয় বোতলের দাম ১০০ টাকা! পাশের বাড়ির ভদ্রলোক এক দোকান থেকে কিনে নিয়ে এসেছেন। ভোটের সময় নানা দলের জনপ্রতিনিধিদের ভিড়ে আমাদের সুদীপ্তা নার্সিং হোমের গলি গমগম করতো, আজ তাঁরা আশ্চর্যজনকভাবে অদৃশ্য!
১১) জনপ্রতিনিধিরা রিলিফ ক্যাম্প গুলোতে ছুটছেন, কিন্তু ফ্ল্যাট বা দালানের ভেতর হাজার হাজার লোক আটকা পড়ে আছেন। সাহায্যের অপেক্ষায় রয়েছেন কত লোক, কিন্তু তাঁদের আর্তনাদ জনপ্রতিনিধিরা শুনতে পান না। এ দিন এনডিআরএফ টিমকে কিছুটা কাজ করতে দেখা গেছে।
১২) অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান…এই তিনটি মৌলিক চাহিদা চরম সংকটে। বিদ্যুৎ কেটে রাখা হয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এ যেন করোনা পরিস্থিতির থেকেও ভয়ংকর! চারিদিকে অথৈ জল। ইচ্ছে করলেও কেউ ঘর ত্যাগ করে যেতে পারছেন না। নৌকা বা ভেলা নেই।
১৩) সন্ধ্যা হতেই অন্ধকারে ডুবে রয়েছে সারাটা অঞ্চল। কারও ঘরেই ইনভার্টারের চার্জ নেই। মোমবাতিও বোধ হয় স্টকে নেই। কাঁশর ঘণ্টা কেউ কেউ বাজাচ্ছে।”
(লেখক হিমাদ্রি শেখর দাস আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক)