NE UpdatesBarak UpdatesTourismBreaking NewsFeature Story
ঊনকোটির পাহাড়ে, লিখেছেন কৃষ্ণজ্যোতি দেব
||কৃষ্ণজ্যোতি দেব||
আমার অজান্তেই টিচার্স কমন রুমে সবাই প্লান করে ফেলল, ঊনকোটি ঘুরতে যাওয়ার। আমি জানলাম একদিন পর। আমাকে জানানোটা কেউ দরকার মনে করেনি। সবাই ধরে নিল, আমরা সবাই যখন যাচ্ছি, তাহলে কৃষ্ণজ্যোতিতো যাবেই। যাইহোক ঘোরার ব্যাপারে আমি সব সময়ই রাজি থাকি। যাওয়ার দিন ঠিক হতেই ট্রেনের টিকিট কেটে ফেললাম। শুরুতে অনেকে রাজি হলেও, পরে ‘আমি চেষ্টা করবো’, ‘আমি কিছুতেই পারছি না’ এমন করতে করতে আমরা মোট আটজনের যাওয়া পাকা হয়েছিল। টিকিট নিলাম সাত জনের। একজন অর্থাৎ দীপাবলি ওখান থেকেই আমাদের সঙ্গে জয়েন করবে। দীপাবলির বাবার বাড়ি ধর্মনগরে। চাকরিসূত্রে ও বিবাহসূত্রে সে এখন শিলচরবাসী।
শনিবারের সকাল, ট্রেন ছাড়ার অনেক আগেই পৌছে গেলাম স্টেশনে। একে একে উর্মিলা, প্রসূন, রিম্পম, ইন্দ্রাণী চলে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসেন দুই দিদি অর্পিতাদি ও সুদীপ্তাদি। সবার সিট এক কামরাতেই। ট্রেন ছাড়ল ঠিক আটটায়, তারাপুরের শিলচর স্টেশন তথা আমাদের আবেগের ভাষাশহিদ স্টেশন থেকে। শুরুতেই গল্প জমে গেল। কখন যে অরুণাচল, কাটাখাল, পাঁচগ্রামের স্টেশনগুলো ছেড়ে চলে যাই, লক্ষ্যই করিনি।
বদরপুরে ট্রেনটা বেশ কিছুক্ষণের জন্য থামলো। যে যার খুশি মতো ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। তারপর আবার চলা৷ আবার গল্প৷ ব্রেকফাস্ট-এর লুচি ঠিকমতো হজম হওয়ার আগেই আবার খাওয়া-দাওয়া শুরু। কত কী যে ! বাদাম, ঝালমুড়ি, শশা, সেদ্ধ ডিম, ছোলা …। চা তো আছেই।
কখনও ব্ল্যাক টি, কখনও হোয়াইট টি আবার কখনও লেমন টি। ট্রেন ততক্ষণে ভাঙ্গায় পৌছে গেছে। পরের স্টেশন গুলোর সবক’টাই চেনাজানা, চরগোলা, করিমগঞ্জ, নিলাম বাজার। ততো সময়ে গল্প আরও জমে উঠেছে। পাথারকান্দি এসে আবার এক এক কাপ চা হয়ে গেল। পরের স্টেশন দু’টোর নাম বেশ মজাদার, কলকলিঘাট ও চান্দখিরা। পরের স্টেশনটি হচ্ছে তিলভূম। আমি তিলভূম কোনদিনও যাইনি। কিন্তু একটা স্মৃতি আছে ওই জায়গার। গতবছর একটা গল্প লেখার সময় ট্রেনলাইনের পাশের এক অখ্যাত গ্রামকে তুলে ধরার জন্য আমি তিলভূমকেই বেছে নিয়েছিলাম। গল্পটা করিমগঞ্জের এক পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ার পর বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। আজ দেখা হল আমার গল্পের স্টেশনটা। তারই মধ্যে দু-চারটে ফোন এসে গেছে দীপাবলির। শেষ ফোনটা যখন চলে, তখন আমরা চুড়াইবাড়ি অতিক্রম করে নদীয়াপুরের কাছে। মানে এর পরের স্টেশই ধর্মনগর।
স্টেশনে দীপাবলি নিজেই এসেছে আমাদের নিতে। সেখান থেকে টোটো চড়ে সোজা হোটেল। নামটা ভারি মজার, হোটেল রাত-দিন। একনাগাড়ে পাঁচ ঘন্টা ট্রেন চড়ে সবাই রীতিমতো টায়ার্ড। এবার চাঁন সেরে খাওয়ার পালা। হোটেলের দুতলায় রেস্টুরেন্টটা আকারে বেশ বড়। খাওয়াও বেশ ভাল। তারপর আর কী! বাঙালির ভাতঘুম।
সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। সবাই রেডি, বাইরে বেরোবে। কেবল আমি প্রসূন আর রিম্পম তখনও গভীর ঘুমে। বেল বাজিয়ে নিরস্ত হয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে অর্পিতাদি আমাদের জাগালো। বললাম, “তোমরা বের হও, আমরা এখনই আসছি”। তাড়াহুুুুড়ো করে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালাম। আমাদের হোটেলটা ছিল কালীবাড়ি রোডে। বড় পুকুরটার ঠিক পূর্বপাড়ে। কালীবাড়িতে সে সন্ধ্যায় প্রচুর ভিড়। নতুন সাজে চার-পাঁচ জোড়া বর-কন্যা বসে আছে। শুরু হবে তাদের বিয়ের পর্ব। দিদিরা ততক্ষণে রামকৃষ্ণ মিশনে চলে গেছেন। প্রসূন আর রিম্পম তখনও হোটেলের রুমে। আমার তখন কালীবাড়িতে বিয়ের ভিড় দেখা ছাড়া অন্য কিছু করার ছিল না। পরে প্রসূন তার স্বভাবমতো ২০ মিনিট দেরি করে রিম্পমকে নিয়ে বেরোলো।
কালীবাড়ি রোড ছেড়ে তিনজন সেন্ট্রাল রোড ধরলাম। রামকৃষ্ণ মিশন তখনও অনেক দূরে। যখন পৌঁছালাম, মাত্র সন্ধ্যারতি শেষ করে ঠাকুরের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। অতএব অপেক্ষা৷ আবার দরজা খোলা হলে ঠাকুরকে প্রণাম করে বেরোলাম। এবারতো এক কাপ চা খেতেই হয়। শহরটা আমাদের ভাল করে জানা নেই বটে কিন্তু দীপাবলি এই শহরের প্রতিটি গলি, প্রতিটি মোড় চেনে। এখানেই তার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং পুরো স্কুলজীবন। পায়ে হেঁটেই আমরা আসলাম মোটরস্ট্যাণ্ডের পুলিশ পয়েন্টের কাছে। দারুণ এক কাপ চা খেয়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম।
তারপর সবাই পৌছালাম রায় মিউজিক্যাল হলে৷ বাদ্যযন্ত্রের দোকানটির কর্ণধার মনতোষ রায় দীপাবলির পিতা। অল্প আলাপেই বুঝতে বাকি থাকলো না, উনি সঙ্গীতের বড় অনুরাগী। এখনও সঙ্গীত সাধনা করেন। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের পরম ভক্ত এবং ব্যক্তিগত ভাবেও তাঁকে চিনতেন। এমন সঙ্গীত অনুরাগীর সঙ্গে আড্ডা হবে না, তা কখনও হয়! যদিও সঙ্গীতজগৎ নিয়ে আলোচনার সামর্থ আমার নেই৷ তাতে অবশ্য অসুবিধা হয়নি৷ সুদীপ্তাদি যে আমাদের সঙ্গে আছে ! সুদীপ্তা ভট্টাচার্য আমাদের উপত্যকার নামী সঙ্গীতশিল্পী। কলকাতার টিভি চ্যানেলগুলোতেও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ পেয়ে ওপার বাংলায়ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে এলেন।
মার্চ মাস সবে শুরু হ’লেও গরমটা বেশ। বড় পুকুরটার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম বিবেকানন্দ সার্ধশতবর্ষ হল প্রাঙ্গণে। কী সুন্দর পুরো ক্যাম্পাস! সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত প্রায় সাড়ে সাতটা। হল এই সময় বন্ধ, তবুও মৃদু আলোয় উঠোনের একটা বেঞ্চে বসে আমাদের সময়টা ভালই কাটলো। ফুলগাছে ভরা বাগানটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিবেকানন্দও আমাদের সঙ্গী ছিলেন সে সময়। আমাদের পাশের বেঞ্চটায় আরও দু’জনের সঙ্গে গল্প করছিলেন সাদামাটা এক ভদ্রলোক। দীপাবলি জানালো, উনিই ধর্মনগরের বর্তমান বিধায়ক বিশ্ববন্ধু সেন। হোটেলে ফিরলাম আরও প্রায় একঘন্টা পরে। ডিসেম্বর থেকেই কলেজে ক্লাস নেই। তাই এই ক’দিন কমনরুমে আড্ডার কোনও সুযোগ হয়নি। সে রাত সেটা পূরণ করে নিলাম। হোটেলে আমাদের আড্ডা চলে রাত প্রায় একটা পর্যন্ত।
আজ একটু সকাল সকালই উঠলাম। কথা ছিল আটটার সময় বের হওয়ার। নিজের হোম-টাউন বলে দীপাবলি আমাদের খুব খাতির করে যাচ্ছে, সঙ্গে দীপাবলির মা’ও। ভোর সকালেই মাসিমণি আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট-এর বিশাল আয়োজন করলেন, পাঠিয়ে দিলেন হোটেলে। মাসিমণির আদরে দিনের শুরুটা আমাদের ভালই হলো। এরই মধ্যে ড্রাইভারের ফোন, তারা এসে হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছে।
আমরা এবার বেরোলাম৷ উদ্দেশ্য ঊনকোটি। দু’টো গাড়িতে মোট আটজন। মোটামুটি ন’টার কাছাকাছি রওয়ানা দিলাম পৌরাণিক সেই বিখ্যাত পুণ্যভূমির উদ্দেশ্যে। ধর্মনগরের শহর ছেড়ে গাড়ি সোজা চলল কৈলাশহরের দিকে। ২০ কিমি দূরে ঊনকোটি পৌছাতে আমাদের এক ঘন্টার কাছাকাছি সময় লাগলো।
ঊনকোটি শব্দের অর্থ এককোটি থেকে এক কম। এটি ত্রিপুরার একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ও শৈবতীর্থ। হিন্দু পুরাণে কথিত আছে, কালু কামার নামে একজন স্থাপত্যকার ছিলেন৷ তিনি দেবী পার্বতীর ভক্ত ছিলেন। একবার দেবী মহাদেবের সাথে কৈলাসে যাচ্ছিলেন তখন কালু কামার বায়না ধরলেন, তিনিও সঙ্গে যাবেন। তখন মহাদেব শর্ত আরোপ করে বলেন, তিনি যেতে পারেন, তবে তার জন্য তাকে এক রাতের মধ্যে এককোটি দেবদেবীর মূর্তি তৈরী করে দিতে হবে। কিন্তু কালু কামার এককোটি থেকে একটি কম মানে ঊনকোটি-টি মূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হন।
ঊনকোটির
মূর্তি নিয়ে আরও বহু কাহিনী প্রচলিত রয়েছে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি কাহিনি হল, দেবাদিদেব শিব একবার দেবতাদের নিয়ে ত্রিপুরার উপর দিয়ে বারাণসী যাচ্ছিলেন। মহাদেবকে নিয়ে দেবতাদের সংখ্যা ছিল এক কোটি। সন্ধে নামার পর রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয় এই রঘুনন্দন পাহাড়ে। পথপরিশ্রমে ক্লান্ত দেবতারা গভীর নিদ্রায় অচেতন হলেন। পরেরদিন সূর্যোদয় হওয়ার আগে সবার বারাণসীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা৷ কিন্তু মহাদেব ছাড়া অন্য কোনও দেবতার নিদ্রাভঙ্গ হল না। মহাদেব বিরক্ত হয়ে একাই বারাণসীর উদ্দেশে রওনা দিলেন। গভীর নিদ্রায় সমাধিস্থ দেবতাদের কালনিদ্রা আর ভাঙল না এবং তারা অনন্তকালের জন্য পাথর হয়ে রইলেন। এই দেবতাদের সংখ্যা ছিল এক কম কোটি৷ তাই ঊনকোটি। সেই থেকেই এই রঘুনন্দন পাহাড় হয়ে গেল শৈবতীর্থ ঊনকোটি।
প্রধান গেটটা পার করে নীচে নেমে যাওয়ার সিঁড়ির কাছে পৌছেই সবাই বিস্মিত। চোখের সামনে বিশাল আকারের এক জটাধারী শিব ও তার পাশেই প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু কালভৈরব। আমরা প্রথমে বাঁদিকের সিড়িটা ধরলাম। এটা নেমে গেছে গণেশ কুণ্ডের দিকে। একটা কুণ্ড ও তার পাশে পাথরের দেওয়ালে দক্ষ হাতে খোদাই করা আছে তিনটে বিশালাকার গণেশ মূর্তি। আর তার ডান দিকে এক চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি। তবে গণেশ কুণ্ডে নামার রাস্তাটা তখন বন্ধ করে রাখা ছিল। সেখান থেকে উল্টোদিকের টিলায় যাওয়ার জন্য আমরা বাঁদিকের সিড়িটা ধরলাম। বেশ খাঁড়া সিঁড়ি। উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়। ছোট্ট একটা এলাকা জুড়ে এতো বিস্ময় ! যা দেখছি বিস্মিত হচ্ছি। তাই হয়তো আমাদের ফটোগ্রাফি একটু বেশিই চলছে। এদিকের টিলাটা আরও উঁচু। উঠে সবাই রীতিমতো পরিশ্রান্ত। এখানে মোট চারটে জায়গায় পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। দুটো হচ্ছে দুই বটগাছের মূলে, একটা পাথরের শিবমূর্তি আর একজায়গায় মাটিতে স্থাপিত শিবলিঙ্গ। একটা গ্রিল দিয়ে বন্ধ ঘরে কয়েকটা মূর্তির স্থাপত্যও রয়েছে। অনেকক্ষণ বসলাম সেখানে।
এবার নেমে এলাম উপরে ওঠার চেয়েও খাঁড়া অন্য আরেকটা সিঁড়ি দিয়ে। এখানেই মূল দর্শনীয় স্থান। সবাই ভক্তিভরে পুজো দিচ্ছে শিবের। পাশেই ছোট্ট একটা কুণ্ড। জল নিয়ে সেখান থেকে সবাই মাথায় ছিটা দিচ্ছে। আমরাও সবাই মন ভরে মহাদেবকে প্রণাম করলাম। শিলচর থেকে প্রায় দেড়শ কিমি দূরে এসে শিবের এই অবিশ্বাস্য রূপ দর্শন করাই তো আমাদের এই যাত্রার সার্থকতা। তাই সেদিন মহাদেবের কাছে কিছু চাইনি, শুধু প্রণাম করে বলেছি তোমার এই সুন্দর রূপ দেখতে আমি আবার আসবো, বারবার আসবো। এতেই আমার আনন্দ।
এবার ফেরার পালা। দীপাবলি আমাদের স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মনটা খারাপ করে মা-বাবার কাছে চলে গেল। আমাদেরও আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। আরও দু’টোদিন এভাবে কাটিয়ে দিতে পারলে কত ভাল হতো! কিন্তু সবকিছুই যে সময়ের বাঁধনে !
(Krishnajyoti Deb teaches Chemistry in Ramanuj Gupta College. He could be reached at debkrishnajyoti@gmail.com)