Barak UpdatesHappeningsCultureBreaking NewsFeature Story
মহাজীবন : চ্যালেঞ্জ নিয়েই সফল ঝুমুরদার দশরূপক, লিখেছেন সুদীপ্তা সেনগুপ্ত
অর্কজ্যোতির চেহারা, গলার স্বর, আবেগ, সাবলীল অভিনয় সেই সময়টায় নিয়ে গেল দর্শকদের
তেইশে আগস্ট, স্বাধীনতা দিবসের এক সপ্তাহ পর মঞ্চস্থ হল নাটক, ‘মহাজীবন’। নাটকের নামে ও ‘দশরূপক’-এর কাছে ভালো কিছুর প্রত্যাশায় প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে উপস্থিত হয়েছিলাম জিসি কলেজের প্রেক্ষাগৃহে।
স্বাধীনতা দিবস পেরিয়ে গেলেও গোটা মাস জুড়েই যেন দেশপ্রেমের জোয়ার। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির উদযাপনে গোটা মাস জুড়েই আছে দেশ নিয়ে ভাবনা। কী পেলাম, কী দিলাম! পেরেছি কি সেই মহান সংগ্রামীদের স্বপ্ন সফল করতে? কোথায় তাঁদের স্বপ্নের ভারতবর্ষ?
যাক, স্বাগত ভাষণের পর বিভিন্ন চরিত্র ও অভিনেতাদের নাম ঘোষণা করে, শুরু হল নাটক ‘মহাজীবন’।
শুরুতেই জাতীয় পতাকা হাতে উল্লাসে দেশভক্তির গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচে ব্যস্ত যুব প্রজন্মকে দেখা গেল৷ তারা মানতেই চাইছিল না তাদের এই উদযাপন কোনও ভাবে অন্যের শান্তিপূর্ণ যাপনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে৷ আর যদি হয় তবুও এটা তাদের মতে ভাবার বিষয় নয়৷ কারণ তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক৷ এক-দুটি বছর নয়, পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে চলেছে দেশের স্বাধীনতা।
পিছনেই ছিল বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের মূর্তি৷ সেখান থেকে আমাদের বিবেকের মত বেরিয়ে এলেন সেই মহাপুরুষ৷ তারা কেউ তাঁকে চেনে না৷ এই শহরেরই এক বীরপুরুষ তিনি, সেই মহান বিপ্লবীর কথা তারা জানে না। তিনি বুঝতে পারলেন, এ তাদের দোষ নয়, দোষ তাদের শিক্ষার, তাদের অভিভাবকদের। খুবই প্রাসঙ্গিক এই কথা হৃদয় ছুঁয়ে গেল৷ এই বিষয়টি যে নিরন্তর আমাদের মনে চলছে, কী দিতে পারছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে!
তারপর তিনি তাদের গল্প শোনাতে বসলেন। ভারতবর্ষের উজ্জ্বল সেই সংগ্রামী দিনগুলোর কথা। নতুন দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো অনেক অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চরিত্র। আমাদের সেই গৌরবের অধ্যায় এত এত সংগ্রামীদের বীরত্বের গল্পগাথায় খচিত যে, দুই ঘন্টার পরিসরে তাকে তুলে ধরা সত্যি এক বিশাল কঠিন কাজ। এই কাজে নাট্যকার চিত্রভানু ভৌমিক (ঝুমুর) অনেকটাই সফল৷ তবু বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তকে ঘিরে আরও কিছু উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছিল, যা নাটকে তুলে ধরা হয়নি৷ যাক, এত চরিত্র নিয়ে এই নাটক মঞ্চস্থ করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল এবং এই কাজে তাঁরা নব্বই শতাংশ সফল৷ কিছু খামতি অবশ্যই আছে৷ সব ভালো কাজেই কিছু খুঁত থেকেই যায়৷ তাই সেদিকে না গিয়ে এই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন একটি বিষয় নিয়ে ভাবা ও কাজ করার জন্য ঝুমুরদা ও দশরূপককে কুর্নিশ জানাই।
এবার বলতেই হয় তরুণ উল্লাসকরের কথা৷ আমি প্রথম দেখলাম অর্কজ্যোতি ভট্টাচার্যের অভিনয়৷ অপূর্ব এক সৌম্যকান্তি চেহারার সঙ্গে গুরুগম্ভীর গলার স্বর, আবেগ, রাগ, তেজ ও সাবলীল অভিনয় ক্ষমতায় সে যেন দর্শকদের সেই সময়টায় নিয়ে গেল। এই নাটকের আরও এক অভিনবত্ব হচ্ছে, বর্ষীয়ান অভিজ্ঞ অভিনেতাদের পাশাপাশি প্রচুর তরুণ নাট্যকর্মীদের একসঙ্গে পাওয়া। প্রবীণদের মধ্যে বারীণ ঘোষ ও হেমচন্দ্র কানুনগো চরিত্রে শুভেন্দু চক্রবর্তী ও শান্তনু সেনগুপ্তের অভিনয় আলাদাভাবে মনে দাগ কেটেছে।
রূপসজ্জা বা মঞ্চসজ্জার খুব একটা প্রয়োজন হয়ত এই নাটকে ছিল না৷ তবুও কালাপানিতে অত্যাচারিত হবার দৃশ্যগুলিতে সেই সংগ্রামীদের চেহারায় বা পোশাকে আরও দৈন্যদশা ফুটিয়ে তোলা গেলে ভালো হতো। একইভাবে অত্যাচারী ব্রিটিশই হোক বা ভারতীয়, সেই চরিত্রগুলোর নির্মমতা সেভাবে দেখতে পাইনি৷ শুধু সাদা রঙের বিপরীতে লাল আর কালো দিয়েই কি হয়! তাদের চরিত্রের কালো অমানবিক দিকটা যদি আরও ভালোভাবে ফুটে উঠত, তাদের বিপরীতে মানবতাবাদী এই ‘মহাজীবন’দের চরিত্রের শুভ্রতা আরও বিকশিত হতো। এও ঠিক, আমাদের মনের ভেতরে লালায়িত সব ছবিই যে নাটকে দেখতে পাব, এমন প্রত্যাশা মোটেই উচিত নয়। আলো ও আবহ এই দুইটি দিক নাটকটিকে ধাপে ধাপে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে।
শুধু নেপথ্যে ভেসে আসা আবহ নয়, অভিনেতারা স্বকণ্ঠে যখন গান করলেন, তখন সেই খুব জনপ্রিয় বাংলা দেশাত্মবোধক গানগুলোতে দর্শকরাও গলা মিলিয়ে এক স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি করলেন। আমরা এই শহরবাসীরা যারা গত পনেরো আগস্ট বা তার কয়দিন আগে থেকেই বাংলা দেশাত্মবোধক গান না শোনায় ক্ষোভ নিয়ে বসেছিলাম, তাঁরা বড় শান্তি পেলাম ৷ পরিশেষে এই শহরেরই প্রসিদ্ধ গায়ক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের কণ্ঠে ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে…মাগো তোমায় ভালবেসে…” এক অদ্ভুত মায়াজাল বিছিয়ে দিলো যেন৷ ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেলাম বর্তমান ভারতের প্রকৃত চিত্র, সবাই মিলে একই সঙ্গে দেশমায়ের পায়ে শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রণাম জানালাম। অদৃশ্য অব্যক্ত এক সংগ্রামী সংকল্প যেন নিঃশব্দে একইসঙ্গে উচ্চারিত হল প্রেক্ষাগৃহের প্রতিটি কোণে।
নাটকের শেষে আবারও উল্লাসকর দত্তের কাছে বসে গল্প শোনা তরুণ-তরুণীদের দেখতে পাওয়া গেল৷ তারা খুশি নুতন তথ্য পেয়ে৷ উন্নত আদর্শে তারাও বলীয়ান হবে নিশ্চয়৷ দেশের দুর্দিনে হয়ত তাদেরই কেউ আরেক ক্ষুদিরাম হবে !
ক্ষুদিরামের কথায় মনে হলো, এই চরিত্রটি প্রথমে দেখে খুশি হয়েছিলাম৷ কারণ চরিত্রের সঙ্গে অভিনেতার সাদৃশ্য অনেকটাই ছিল৷ আগুনটুকু শুধু দেখতে পেলাম না অগ্নিশিশুর৷ তবে এই যে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী এত উৎসাহ নিয়ে কত শত প্রতিকূলতা নিয়েও এতদিন ধরে এই গরমে মহড়া দিয়ে আমাদের এমন সুন্দর নাটক উপহার দিল, এ অনেক বড় প্রাপ্তি। আমরা আশাবাদী, আরও অনেক জায়গায় মঞ্চস্থ হবে এই নাটক৷ আরও পূর্ণতা লাভ করুক, সাফল্যের নতুন সীমা ছুঁয়ে যাক, অফুরান শুভকামনা রইলো।অভিনন্দন জানাই ঝুমুরদা ও তাঁর দল ‘দশরূপক’কে৷ সেইসঙ্গে অন্য সংস্থাদেরও যারা নানাভাবে সাহায্য করেছেন এই মহৎ প্রয়াসকে সার্থক করে তুলতে৷ অনেক নতুনেরই রূপকার ‘দশরূপক’ সাংস্কৃতিক সংস্থা, এই ধারা অব্যাহত থাক, এটাই কাম্য।
(নাটক – মহাজীবন
পরিবেশনায় – দশরূপক সাংস্কৃতিক সংস্থা
ব্যবস্থাপনায় – গুরুচরণ কলেজ ও দশরূপক সাংস্কৃতিক সংস্থা)