Barak UpdatesHappeningsAnalyticsBreaking NewsFeature Story

ভুবন পাহাড়ে কি রোপওয়ে চালু করা যেতে পারে না? লিখেছেন ড. হিমাদ্রি শেখর দাস

ড. হিমাদ্রি শেখর দাস

১ মার্চ : ভারতের অনেক মন্দির পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। যেমন – ১) সারদা মাতা মন্দির, মাইহার ২) মহাকালী মন্দির, প্রভাগড় ৩) মা বাম্বলেশ্বরীর মন্দির, দোঙ্গারগড় ৪) সালকানপুর দেবীর মন্দির, ভোপাল ৫) কর্ণি মাতার মন্দির, উদয়পুর ৬) মা নয়না দেবীর মন্দির, বিলাসপুর ৭) জীবদানি মাতার মন্দির, বিরার, মহারাষ্ট্র ৮) অম্বাজী মাতার মন্দির, গুজরাট ৯) বৈদ্যনাথ মন্দির, দেওঘর এবং ১০) মনসা মাতা/চণ্ডী মাতার মন্দির, হরিদ্বার। এই দশটি মন্দির পরিদর্শন করতে বছরের প্রায় প্রতিটি দিন প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে রোপওয়ে। সরকার আর মন্দির ট্রাস্টের যৌথ পরিচালনায় ভক্তদের বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থাও মন্দিরে করা হয়ে থাকে।

উত্তরপূর্ব ভারতে বিগত কয়েক বছরে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। প্রতি বছর আসামে অনেক পর্যটক এসে থাকেন। বরাক উপত্যকায় দর্শনীয় অনেক মন্দির আর ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। এর মধ্যে ভুবন বাবার মন্দির, কাঁচাকান্তি মাতার মন্দির, মাসিমপুর কালী মন্দির ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বরাক উপত্যকা তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভুবন পাহাড় এক সুপরিচিত ও সুপ্রসিদ্ধ নাম। ভুবন বাবার দর্শনে সাধারণত: পুণ্যার্থীরা শিবচতুর্দশী আর দোল পূর্ণিমাতে গিয়ে থাকেন। গবেষণায় জানা যায় যে একসময় রংমাই, লিয়াংমাই ও জেমি জনগোষ্ঠীভুক্ত হাজার হাজার হিন্দু নাগাদের তীর্থস্থান হচ্ছে এই পাহাড়। দলবদ্ধভাবে শিব বন্দনা করতেই নাকি এই জনগোষ্ঠীর হিন্দু নাগারা পুজো দিতে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে মন্দিরে আসতেন। এছাড়া চা-বাগানের জনগোষ্ঠী আর আশপাশের ভক্তদের এক বিশাল দল এই মন্দিরে আসেন পুজো দিতে।

উপকথা ঘেঁটে জানা যায় যে, বুদ্ধ ভিক্ষুরা ভগবান তথাগতের তপস্যা করতে বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে ভুবনের নির্জন গুহায় আসতেন। এছাড়া এই তীর্থের সঙ্গে কামাখ্যা মন্দিরের যোগসাজশ নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, ভুবনের সঙ্গে কামাখ্যা পাহাড়ের সুড়ঙ্গ পথে সংযোগ আছে। ভুবন পাহাড়ের অধিকাংশ মূর্তি সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর সময়সীমার। আর এর পেছনে কিছু স্থানীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতাও অস্বীকার করা যায় না। তীর্থযাত্রীরা পাহাড়ের নীচে অবস্থিত মতিনগর অঞ্চলে গিয়ে ছোট গাড়ি করে বা পায়ে হেঁটে পানিচৌকি পৌঁছান। এরপর শুরু হয় দুর্গম অঞ্চল দিয়ে সুদীর্ঘ সাত কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথের যাত্রা। হাতে লাঠি নিয়ে ভক্তরা “ভোলে-বম” ধ্বনি দিয়ে পাহাড় চড়তে শুরু করেন। সব পরিশ্রম লাঘব হয়ে যায় মন্দির চত্বরে পৌঁছানোর পর।

বছরের বাকিটা সময় মন্দিরে তেমন ভাবে পুজো দিতে কেউ যান না। এর পেছনে মূল কারণগুলো হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা, পানীয় জল তথা খাবারের অসুবিধে, বন্য জন্তু জানোয়ারের উপস্থিতি ইত্যাদি। একসময় উগ্রপন্থী আর সমাজবিরোধীদের মুক্তাঙ্গনও নাকি ছিল এই পাহাড়। এসব কারণে যথাযথ ভাবে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই পুরাতন মন্দির পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। রাজনৈতিক উদাসীনতাও কিছুটা দায়ী।

এই মন্দিরের সংস্কারে স্থানীয় ভক্তদের অবদানই বেশি। অবশ্য শিবরাত্রি এবং দোল পূর্ণিমার সময় প্রশাসনের তরফ থেকে কিছুটা উদ্যোগ দেখা যায়। আমাদের এই উপত্যকায় পর্যটন ব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে অতীতে তেমন উদ্যোগ সরকারি স্তরে দেখা যায়নি। সংস্কারের অভাবে নানা ঐতিহাসিক স্থানও আজ বিপর্যয়ের মুখে। এখন অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। রাজ্য সরকার ভুবনতীর্থের সংস্কার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে।

এই অবস্থায় সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে ভুবন বাবার মন্দিরে রোপওয়ের ব্যবস্থা যদি করা যায় তাহলে ভক্তদের সমাগম বাড়বে। পাশাপাশি মন্দিরের ট্রাস্টে জমা হবে বিপুল ধনরাশি যা মন্দিরের সংস্কার তথা কল্যাণমুলক কাজে ব্যবহার করা যাবে। এই রোপওয়ে তৈরি করতে গেলে প্রথমেই জায়গার জরিপ করে ক্যাবল বসানোর নির্দিষ্ট পথ তৈরি করতে হবে। অনেক বেসরকারি কোম্পানি আছে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। রাজ্য আর কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের নানা প্রজেক্ট রয়েছে।

এই রোপওয়ে প্রজেক্ট নিয়ে মন্ত্রকে তদ্বির স্থানীয় নেতা তথা মন্ত্রীদের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই রোপওয়ে চালু হলে ভুবন পাহাড় অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্রই বদলে যাবে। আশপাশের অনেক বেকার মানুষও এতে লাভবান হবেন। হোটেল, দোকান ইত্যাদি ব্যবসায় বৃদ্ধি পাবে। রোপওয়ে তৈরি হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে এই প্রাচীন মন্দির দেখতে ভারতের নানা অঞ্চল থেকে পর্যটক ছুটে আসবেন। এই পাহাড়ের জৈব বৈচিত্র্য নিয়ে তেমনভাবে অধ্যয়ন করা হয়নি। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হলে সামগ্রিক পরিস্থিতিই নতুন রূপ নেবে। একটি কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে, রোপওয়ে প্রজেক্টে লোকসানের সম্ভাবনা একেবারেই নেই। হাজার হাজার ভক্তদের সমাগমে ভুবন তীর্থ বছরের প্রতিটি দিন “ভোলে-বম” গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠবে, এমন স্বপ্ন তো দেখা যেতেই পারে! কী বলেন?

(লেখক ড. হিমাদ্রীশেখর দাস আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। )

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker