Barak UpdatesHappeningsCultureBreaking News
ভাবীকালের নাট্য উৎসব ছিল গুণে মানে মনোহর
ওয়েটুবরাক, ৭ মার্চ : ‘ভাবীকাল থিয়েটার গ্রুপ’-এর আয়োজনে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত শিলচর গান্ধীভবনে সম্পন্ন হল নাটকের উৎসব। ‘সপ্তরাজ রঙ্গ উৎসব’ নামের এই নাট্য উৎসবটি গত বছর শুরু হয়েছিল। ভাবীকালের প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছর উদযাপন বলে এ বার একে ভিন্ন ভাবনায় সাজিয়ে তোলা হয়৷ শহর জুড়ে প্রচারসজ্জা, সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের ভিডিয়োবার্তা থেকে শুরু করে নাটকের জন্য পথচলা, প্রতিদিন পথনাটিকা, স্মরণিকা প্রকাশ সব মিলিয়ে প্রকৃতই এক নাটকপার্বণ হয়ে গেল শিলচরে৷
ভাবীকাল অবশ্য একে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে আমন্ত্রণ করেছিল বাংলাদেশের নাট্যদল ‘মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়’কেও। ৩ মার্চ হবার কথা ছিল ঢাকার দলের নাটক। কিন্তু তাদের বেশ কয়েকজন শিল্পীর ভিসা মঞ্জুর করেনি ভারত সরকার। ফলে ঢাকার দলের প্রযোজনাটি স্থগিত রেখেছেন আয়োজকেরা। তবু এই নাট্য উৎসব ছিল গুণে মানে মনোহর, সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় তিনদিনের টানটান।
২৯ ফেব্রুয়ারি আয়োজক সংস্থা ভাবীকালের চল্লিশ বছর পূর্তি উদযাপন করতে ‘নাটকের জন্য পথচলা’ নামের সাংস্কৃতিক শোভাযাত্রায় পা মিলিয়েছেন শিলচর সহ বরাক উপত্যকা এবং বাইরের নাট্য ব্যক্তিত্বরাও। চিত্রভানু ভৌমিক, শেখর দেবরায়, পঙ্কজ পুরকায়স্থ, শান্তনু সেনগুপ্ত প্রমুখ বর্ষীয়ান অভিনেতা-পরিচালকের সঙ্গে পথচলায় সামিল হয়েছেন অভিনব থিয়েটার গুয়াহাটির কর্ণধার দয়াল কৃষ্ণ নাথ, বদরপুরের বিশিষ্ট নাট্যকার রূপক রক্ষিত, হাইলাকান্দির প্রবীন নাট্যকর্মী সুদর্শন ভট্টাচার্য, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নাট্যপ্রেমী অধ্যাপক দেবাশিস ভট্টাচার্য ও অনিন্দ্য সেন, নিখিল পাল, ভাস্কর দাস, গোরা চক্রবর্তী, সায়ন বিশ্বাস, বর্ধমানের ‘অন্য ভাবনা’ নাট্যদলের শিল্পী সহ লোকমঞ্চ, দুধপাতিল শিল্পী সমাজ-এর কর্মী এবং শহরের তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ভাবীকালের নাট্য শিক্ষার্থী শিলচর উইমেন্স কলেজ এবং রাধামাধব কলেজের ছাত্রছাত্রীরা মিছিলের শুরুতে যেমন পথনাটক করেছে, তেমনি মঞ্চের বাইরে গান্ধী ভবনের প্রবেশদ্বারের পাশে সুসজ্জিত আঙিনায় তিনদিন ধরে পথনাটক করেছে।
তিনদিনে মোট ছয়টি নাটক উপস্থাপিত হয়। প্রথম সন্ধ্যায় উদ্বোধনী সভায় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন উৎসব সমিতির সভাপতি শান্তনু দাস, তৈমুর রাজা চৌধুরী, গুয়াহাটি অভিনব থিয়েটারের নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা দয়াল কৃষ্ণ নাথ, রূপক রক্ষিত, বর্ষীয়ান নাট্যকর্মী পঙ্কজ পুরকায়স্থ, নাট্য সংগঠক সুদর্শন ভট্টাচার্য, স্বর্ণালী চৌধুরী, রঞ্জন দাস, রাহুল দাশগুপ্ত, শান্তনু পাল প্রমুখ। ওই সন্ধ্যায় ভাবীকালের স্থাপক সদস্য প্রয়াত রত্নেশ্বর চক্রবর্তীর উদ্দেশে উৎসর্গিত মঞ্চে করিমগঞ্জ নৃত্যনীড়ের ব্যালে ‘দেশহারাদের আত্মকথা’, এবং অন্য ভাবনা বর্ধমানের নাটক ‘ভৌতিক’ ছিল যথেষ্ট উন্নত মানের। নৃত্যনীড়ের শিল্পীদের মনোরঞ্জন ঘোষ স্মৃতি স্মারক তুলে দেন লিপিকা ঘোষ ও মনীশ পোদ্দার। অন্য ভাবনা বর্ধমান-এর শিল্পীদের হাতে প্রয়াত নৃত্যশিল্পী রক্তিম দাস স্মৃতি স্মারক তুলে দেন শান্তনু দাস।
দ্বিতীয় সন্ধ্যায় নাট্যজন পাথারকান্দির লোক আঙ্গিকের প্রযোজনা ‘নুপূর মাঝির বৈঠা’ ছিল বেশ টানটান। রানিকুঠি জিয়নকাঠির ‘উজ্জয়িনীর অন্ধকারে’ নাটকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধের অভিনয়ে দর্শকেরা মুগ্ধ হন। ওই সন্ধ্যার মঞ্চটি উৎসর্গ করা হয় প্রয়াত ছবি চক্রবর্তীর স্মৃতিতে। স্মৃতি স্মারক তুলে দেন ছবি চক্রবর্তীর পরিবারের পক্ষে রাখি চক্রবর্তী। জিয়নকাঠির শিল্পীদের প্রদান করা হয় সুপ্রিয় মোহন দাস স্মৃতি স্মারক। উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিয় মোহন দাসের পুত্র প্রসেনজিৎ দাস এবং অনুজ রাহুল দাস ও রাতুল দাস।
ভাবীকালের ৪০ বছর পূর্তি এবং এই উৎসবকে কেন্দ্রে রেখে একটি স্মরণিকা ( Spotlight Serenade) উন্মোচন করেন ড. পরিতোষ দত্ত। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নির্মল কান্তি রায়, শান্তনু দাস, রঞ্জন কুমার দাস এবং স্মরণিকার সম্পাদক নিলোৎপল ভট্টাচার্য। সম্পাদক ভট্টাচার্য স্মরণিকাটির প্রচ্ছদ অংকনের জন্য নির্মল কান্তি রায়কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। স্মরণিকাটিতে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন বিশ্বখ্যাত পরিচালক-নাট্যকার রতন থিয়াম, এন .এস ডির প্রাক্তন ডাইরেক্টর প্রফেসর ডি.আর. অংকুর ও প্রফেসর (ডক্টর) ওমপ্রকাশ ভারতী প্রমুখ। শান্তনু পাল তাঁদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
ড. পরিতোষ দত্ত ও ড নির্মল কান্তি রায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে স্মরণিকাটির ভূয়সী প্রশংসা করেন।
২ মার্চ স্মৃতি রেখা পাল এবং নমিতা দে দাস স্মৃতি মঞ্চে উপস্থাপিত শিলচরের আজকের প্রজন্ম থিয়েটারের ‘তিন পুতুলের গল্প’ ছিল বেশ অভিনব প্রযোজনা। এদের তুলে দেওয়া হয় ভাবীকালের প্রয়াত নাট্যকর্মী শুচিস্মিতা দেব স্মৃতি স্মারক। আবেগঘন পরিবেশে স্মারক তুলে দেন শুচিস্মিতার বালক পুত্র আদিদেব দত্ত, স্বপ্না দেব (মা) এবং অনিন্দিতা দত্ত (শাশুড়ি)। ওই দিনের দ্বিতীয় নাটকটি ছিল বর্ণম থিয়েটার, বিশ্বনাথ চারিয়ালির “তিনিটা রঙ্গিন পখিলা”। ব্যক্তিগত অভিনয় নৈপুণ্যে তিনটি চরিত্রই দর্শকদের মন লুঠ করে নেয়। অসমিয়া নাটক হলেও ভাষার ব্যবধান যে থিয়েটারের শিল্পভাষার কাছে তুচ্ছ, তা প্রমাণ করে শেষ নাটকেও প্রেক্ষাগৃহ প্রায় পরিপূর্ণ ছিল। এই শিল্পীদের হাতে স্মারক তুলে দেন নমিতা দে দাসের কন্যা অন্তরিকা দাস ও স্মৃতিরেখা পালের পুত্র সৌরজিৎ পাল।
সব মিলিয়ে আয়োজন ছিল নিখুঁত। যে দল চার দশক ধরে নাটকের অঙ্গনে পদচারণা করছে, সেই দলের আয়োজনে এমন শৃঙ্খলা, আর উৎকর্ষ স্বভাবতই প্রত্যাশিত। তারা সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছে৷ বিশেষ করে গান্ধী ভবনের বাইরের অনুষ্ঠানগুলি ছিল অভিনব। সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী, উইমেন্স কলেজ ও রাধামাধব কলেজের প্রশিক্ষার্থীকে শংসাপত্র দেওয়া হয়েছে বাইরের উৎসব অঙ্গনে, ভাবীকালের প্রাক্তন সদস্য আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সম্মান জানানো হয়েছে বাইরের অঙ্গনেই। ভাবীকালের প্রাক্তনীদের আড্ডায়, প্রদর্শিত নাটকের আলোচনায়, আর নাট্যামোদী দর্শকের সমাগমে জমজমাট হয়ে উঠেছিল এই সপ্তরাজ রঙ্গ উৎসব। উৎসবের অন্তিম পর্বে সপ্তরাজ রঙ্গ উৎসব সমিতির সভাপতি, প্রাক্তন পুরপতি শান্তনু দাস দর্শকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ধন্যবাদ সূচক বক্তব্যে শান্তনু পাল আমন্ত্রিত সমস্ত নাট্য দল, মিডিয়া পার্টনার দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ, সমস্ত পৃষ্ঠপোষক এবং বিশেষ করে ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়কে তাদের আর্থিক সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সমস্ত প্রতিনিধি এবং তৈমুর রাজা চৌধুরীর অবদানের কথাও তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।
থিয়েটারের জন্য পথ চলা থেকে শুরু করে ‘থিয়েটারকে জনতার মাঝখানে পৌঁছে দেবার অঙ্গীকার ঘোষণা’ — সামগ্রিক এক দায়বদ্ধতার আখ্যান হয়ে উঠেছিল এই নাট্য উৎসব। একথা বলাই যায় যে, মাসখানেক আগের পৌষ পরব থেকে সপ্তরাজ রঙ্গ উৎসব, কদিন পরের সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতার আসর সব মিলিয়ে কবির শহর এবার হয়ে উঠছে নাটকেরও শহর।