Barak UpdatesHappeningsCultureBreaking NewsFeature Story

ভাবীকালের নাটক, শান্তনু পাল ও তাঁর একক অভিনয়, লিখেছেন সায়ন বিশ্বাস

//সায়ন বিশ্বাস, নাট্যকর্মী//

চল্লিশটি বসন্ত তারা অতিক্রম করে এসেছে। শহর শিলচর সহ বরাক উপত্যকাকে উপহার দিয়েছে একের পর এক দুরন্ত নাটক। সেই ভাবীকাল থিয়েটার গ্রুপ গত মাস, অর্থাৎ জুনের ২৯ তারিখ শিলচর বঙ্গভবনে মঞ্চস্থ করল তাদের নাটক ‘মৃত্যুর সাথে অভিসার’। বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের ‘এ মাসের নাটক’ নামের ধারাবাহিক যজ্ঞে নিঃসন্দেহে ভাবীকালের এই প্রযোজনা আরও একটি পালক যোগ করেছে বঙ্গ-আয়োজনে। পালক বলা হল এই অর্থে, কারণ নাটকটি ঘিরে চর্চা-আলোচনার অনেক খোরাক পাওয়া গেল। পাওয়া গেল বেশ কয়েকটি মনোগ্রাহী পর্যালোচনা বা রিভিউ। যে রিভিউগুলিতে ভাল- মন্দ-তর্ক-বিতর্ক নতুন করে ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে। একজন নাট্যকর্মী হিসেবে মনে করি, এটাই প্রযোজনাটির সার্থকতা।

গত বছর যখন প্রথমবার এই নাটক দেখি, সেই রাতেই এর রিভিউ করেছিলাম নিজের ফেসবুক দেওয়ালে। এছাড়া এবার তো নাটকটির বেশ কিছু রিভিউ প্রকাশিতও হয়ে গেছে নানা মিডিয়ায়। তাই ভাবছি পর্যালোচনাটা লেখা যাক অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে।

শিলচরে শান্তনু পাল একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। যদি শহরের অভিনেতাদের কোনও ‘এ ক্যাটেগরি’, বা ‘প্রথম সারি’ তৈরি হয়, তবে তাতে নিঃসন্দেহে রাখা হবে শান্তনু পালকে। যেমনটা রাখা হবে সুব্রত রায় শম্ভুকেও। সুব্রত রায়ের কথাটা এখানে উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, বরাকের থিয়েটারে একক অভিনয়ের কথা উচ্চারণ করলে এই নামটাকে আনতেই হবে শীর্ষে। ‘আমি মদন বলছি’, ‘শেষ সংলাপ’, ‘লিগ্যাসি কোড’ এসব নাটকে সুব্রত রায়ের একক অভিনয় শিলচরের থিয়েটার-পাড়ায় হইচই ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। আর আমরা জানি সেই সুব্রত রায়ের সঙ্গে মনে মনে শান্তনু পালের একটা স্বাস্থ্যকর অঘোষিত প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমরা দর্শকরা, বা নাটকের মানুষেরাই কিন্তু অজান্তে এই দু’জনের অভিনয়ে, কে এগিয়ে সে তুলনামূলক বিশ্লেষণ ভালবাসি। সুব্রত-শান্তনু, এই দুই বন্ধুও কিন্তু অঘোষিত এই প্রতিযোগিতা ঘিরে মাঝেমধ্যেই আনন্দ লুফে নেন।

যা হোক, সেই সুব্রত রায় কিন্তু প্রকাশ্যে অনেকবারই বলেছেন, তাঁর একক অভিনয়ের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে থাকে আরও এক নাট্য ব্যক্তিত্বের অভিনয়-দক্ষতা, যার নাম শেখর দেবরায়।

মজার ব্যাপার হল, সুব্রত শম্ভু এবং শান্তনু পাল, এই দু’জনই কিন্তু শেখর দেবরায়ের চরম অনুরাগী। ওই এক গুরুর শিষ্য টাইপ ব্যাপার। দু’জনেই আজকের যুগের উচ্চারণে শেখর দেবরায়ের দীর্ঘদিনের ‘হার্ডকোর ফ্যান’। শুধু শান্তনু-শম্ভু কেন, ফ্যান তো আমরাও। কারণ, অভিনেতা হিসেবে কয়েক যুগ মঞ্চ মাতিয়েছেন শেখরবাবু। গ্রুপ থিয়েটার তো অবশ্যই, পথনাটক, রেডিও নাটকের পাশাপাশি শেখর দেবরায়ের ‘মনসা কথা’ ও ‘নানা রংয়ের দিন’-ও কিন্তু একক অভিনয়ে বরাকের মাইলস্টোন নাটক। খোদ রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত (যিনি নিজেও নান্দীকারে ‘নানা রংয়ের দিন’ করেছেন) ‘নানা রংয়ের দিন’-এ শেখরবাবুর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন।

সুব্রত রায় তো মজা করে অনেক বার প্রকাশ্যে বলেছেন- ‘শেখরদা তোমার মতো গানের গলা নেই। নইলে গুরু, তোমাকে হারিয়ে দিতাম।’ যাই হোক, শেখরবাবুর অনুরাগী শম্ভুর গানের গলা না থাকলেও অভিনয় দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তা তিনি নিজেই একক অভিনয়ে প্রমাণ করে চলেছেন বারবার। সেই বন্ধু সুব্রত রায়কেই যেন এবার একক অভিনয়ের নিরিখে তুল্যমূল্য বিচারে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন শান্তনু।

দেখার ছিল, সেই শেখর দেবরায়ের আরেক অনুরাগী শান্তনু পাল তাঁর প্রথম একক নাটকে কেমন ‘কামাল’ দেখান। দেখালেন, সত্যিই দেখালেন। মোচড়ে ভরা দেড় ঘণ্টার নাটকটিতে আটকে রেখে দিলেন আমাদের। সুব্রত রায়কে টেক্কা দিতে গিয়ে গানও গেয়ে নিলেন কয়েক লাইন (মজা করেই লিখলাম)। নাটকটি গত বছরও অভিনীত হয়েছিল শিলচরে। তবে কোনও এক কারণে সেদিন সেই অর্থে দর্শক সমাগম ঘটেনি। কিন্তু এবার ভিড়ে ঠাঁসা প্রেক্ষাঘর উপভোগ করল অন্য এক শান্তনুকে। এ যেন নতুনভাবে ধরা দিয়েছিলেন ‘হনুয়া-কা বেটা’।

বরাকের অভিনেতাদের বেশিরভাগই আমরা মান্য বাংলার সঠিক উচ্চারণ-দোষে দুষ্ট। শান্তনু পালও সেই বৃত্তে আটকা পড়েছিলেন অল্প-বিস্তর। যদিও এটা সত্যি যে, আধুনিক নাটকে উচ্চারণ বা ভাষা এখন আরও কোনও অন্তরায় নয়। ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়; নাটক নিজেই তো একটা ভাষা। উচ্চারণ তার এক ক্ষুদ্রতম অংশ মাত্র। আসল হল অভিনয়, অভিব্যক্তি এবং সঠিক বার্তা পৌঁছানো। যাক, সেটা অন্য তর্ক।

উচ্চারণ ছাড়া যে জিনিসটার জন্য শান্তনু পালের সেদিনকার অভিনয় থেকে এক-দু’মার্ক কেটে নেওয়া যেতে পারে, সেটা হল দৃশ্যান্তরে সংলাপের সূত্র ভুলে যাওয়া। এবং উইংসের পাশে গিয়ে কোনও এক সহায়ক থেকে সেই সূত্র-সংলাপ তুলে নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভাল, আমার একক নাটক করার অভিজ্ঞতা শূন্য। তবে একক অভিনয় যারাই করেন, তাদের থেকে এসব সমস্যার কথা শুনেছি। একক অভিনয়ে দৃশ্যান্তরে সংলাপ গুলিয়ে যাওয়া নাকি খুব একটা ‘অস্বাভাবিক’ নয়। কারণ, সবগুলি দৃশ্যই যেহেতু একা করতে হচ্ছে, তাই অভিনয়ে একটু বেশি ডুবে গেলেই কোনটার পর কোনটা, সেই খেই হারিয়ে যাওয়ার অবকাশ থাকে। ফলে এক্ষেত্রেও শান্তনু পালের খুব বেশি মার্ক কাটা যাবে না, যায় না।

কিন্তু যেভাবে শান্তনু পাল কণ্ঠস্বরের দুর্দান্ত ব্যবহার করেছেন গোটা নাটক জুড়ে; এছাড়া যেভাবে চোখের কাজ করেছেন; যেভাবে গোটা স্টেজ আপ-ডাউন, রাইট-লেফট মাতিয়েছেন; একটা কোণা বাকি রাখেননি; কয়েকটি জায়গায় অভিনয় তো চোখে লেগে আছে এখনো! হাঁটা-চলাকে কখনও গতি দিয়েছেন, কখনও শ্লথ করেছেন, সব দেখে বাহ্, বাহ্ বেরিয়েছে মুখ থেকে। যখন ফিসফিসিয়ে সংলাপ দিয়েছেন, এমন মনে হয়েছে, সত্যি বোধহয় কানে কানে এসে কথাগুলি বলে যাচ্ছিল শান্তনুর করা সেই ‘পরাণ’ চরিত্রটি। অথচ প্রেক্ষাঘরের শেষ সারি অবধি সেই শব্দ পৌঁছেছে স্পষ্টভাবে।

হ্যাঁ, সেদিন আবহ প্রেক্ষপণে সায়ন্তনী পাল মিঠি সংলাপের সঙ্গে আবহের ভারসাম্যটা রাখতে পারেনি। তবে এটা মিঠির ভুল নয়, ভুলটাকে ফেলতে হবে টেকনিক্যাল পর্যায়ে। কেন টেকনিক্যাল, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি। বঙ্গভবনে মঞ্চের ঠিক নিচে যেখানে বসে আলো-আবহ প্রক্ষেপণ করা হয়, সেখানে বসে আউটপুট (বাইরের সাউন্ড বক্সের শব্দ) ততটা কানে আসে না। ফলে মিঠির কানে আসছিল সংলাপ ও ভেতরে থাকা মনিটর (ইনপুট সাউন্ড)। যার মধ্যে ভারসাম্য ঠিকই ছিল। কিন্তু ওই আবহ আউটপুট চ্যানেলে একই ব্যালেন্সে থেকে গিয়েছিল। ফলে সংলাপ চাপা পড়ে যায় কিছু কিছু সময়। আউটপুটে মিউজিকটা কেটে দিলেই কিন্তু এই ঘটনা ঘটতো না। মিঠি কারিগরি কৌশলে নবীন, আশা করি, আগামীতে সে সেটা নিশ্চয়ই খেয়াল রাখবে। তবে তাকে প্রশংসা করতেই হবে তার নিখুঁত টাইমিংয়ের জন্য। একটা মিউজিক প্রক্ষেপণে সেকেন্ড দেরি হয়নি। যখন যে ধরনের আবহ প্রয়োজন, সেরকমই মানানসই আবহে বাঁধা ছিল নাটকটি। দারুণ।

আলো প্রক্ষেপণে ছিলেন সেজুঁতি বাগচি। তিনি একজন পেশাদার আলোক শিল্পী। তাঁর কাজে আমরা সত্যিই পেশাদারিত্ব পেলাম। পরাণের চরিত্র অনুযায়ী যে আলো-আঁধারি মঞ্চের প্রয়োজন ছিল, সেটা আগাগোড়া মেন্টেন করলেন সেজুঁতি। সাইক্লোর‍্যামাতে এলইডি-র রঙিন আলো পরিবর্তনের মাধ্যমে যেভাবে প্রতিটি দৃশ্যের মোড পরিবর্তন করালেন, সেটা বহুদিন মনে থাকবে। হ্যাঁ, এলইডি-র আলো তীব্র। তাই পেছনে এলইডি ফিডার উঠতেই সামনে পরাণের চরিত্র কিছুটা অন্ধকার হয়ে পড়ছিল। এতে অনেকের মনে হয়েছে, সাবজেক্ট থেকে ফোকাস সরে গিয়েছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত, নাটকের মুহূর্তগুলি কিন্তু সেটাই চাইছিল। কারণ, নাটকে পরিস্থিতি অনুযায়ী পাল্টাচ্ছিল পরাণের অভিব্যক্তি। অভিব্যক্তি পাল্টাচ্ছিল বলে পরিস্থিতি কিন্তু পাল্টায়নি। ফলে, আলো যথাযথই বলতে চাইব।

মঞ্চও যতটুকু দরকার, ততটুকু ছিল। মেদ ছিল না। মেদ ছিল না মেকআপেও। শেষের দিকে একটা দৃশ্যে দ্রোহদীপ ভট্টাচার্যের ছায়া অভিনয় দীর্ঘদিন মনে থাকবে। শক্তিশালী কণ্ঠে সংলাপ নিক্ষেপের পাশাপাশি হস্তমুদ্রার এমন দারুণ ব্যবহার, অসম্ভব ভাল। এই জায়গায় আলোর ব্যবহারে তো কামাল করেছেন সেজুঁতি। একটা গোটা সিন আমরা দেখলাম ছায়ার মধ্যে, দারুণ। এই নাটকে প্রোজেকশনের ব্যবহার ছিল, যা নিয়ে তর্ক আছে। থাকবেও। যেদিন থেকে থিয়েটারে ভিডিও প্রোজেকশন ঢুকেছে, তর্ক হয়েছে। সেটা হোক কলকাতার থিয়েটার, বা হোক শেখর দেবরায় কিংবা প্রয়াত বিশ্বজিৎ চৌধুরী বা দীপঙ্কর চন্দের নির্দেশনার নাটক। প্রোজেক্টার লাগিয়েছো মানেই, কেউ পক্ষে থাকবেন, কেউ বিপক্ষে। ফলে এ নিয়ে আলোচনার শেষ বিন্দুতে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই এটা বাদ দিই। তবে প্রোজেকশনে যে ভিডিও দেখানো হল, সেটাকে কাটছাঁট করা যেত। রিয়েকশন শট বেশি উঠে এসেছে, তা নাটকের যে স্বাভাবিক ছন্দ ছিল, তাকে কিছুটা আঘাত করল বলেই মনে করি।

তবে কোরাসের প্রবেশের পর পরাণ যেভাবে ‘ওথেলো’ হয়ে উঠল। এবং হঠাৎ করেই আমরা শেক্সপিয়ার ঘরানায় ঢুকে পড়লাম, সেই জায়গাটা কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার দারুণ লেগেছে। শান্তনু পাল বলেই সেটা সম্ভব। দেশ-বিদেশের নাটক নিয়মিত দেখার ফলে, তাঁর প্রয়োগের দিকটা ভীষণ ভীষণ শক্তিশালী। এর জন্য নির্দেশক ও অভিনেতা শান্তনুকে একটা কুর্নিশ জানাতেই হয়। সবমিলিয়ে ভাবীকালের এই প্রযোজনা নিঃসন্দেহে বরাকের থিয়েটারে নতুন কিছু দিয়ে গেল, সেটা বলতেই পারি।

সঙ্গে এটাও বলতে পারি (মজা করে), সুব্রত রায় কিন্তু এখন শেখর দেবরায়ের মতো শান্তনুকেও ঈর্ষা করতে পারেন, তাঁর একক অভিনয় ও সেই তাঁর গানের গলার জন্য। আসলে, গানটা কিন্তু শান্তনু সেদিন ভালই গেয়েছেন। শুধু গাওয়ার আগে একটা সংলাপ সংযোজন করেছেন (জানি না আদৌ নাটককার রতন দাস এই সংলাপটা তাঁর পাণ্ডুলিপিতে রেখেছিলেন কিনা) ‘আমি তো আর ভাল গাইতে পারি না’। আগামীতে তাই ‘মদন’ও যদি ‘আমি তো আর গাইতে পারি না’ বলে দু’কলি গেয়ে দেন, বেশ জমবে। শোনার অপেক্ষায় রইলাম ‘মদনের গান’। যেমন দেখার অপেক্ষায় রইলাম শান্তনুর আরো একক অভিনয়। তেমনি জানার অপেক্ষায় রইলাম, নিজের দুই অনুরাগীর মধ্যে; তাদের একক অভিনয়ের জন্য একশোর মধ্যে, কাকে কত মার্কস দিতে চাইবেন ‘গুরু’ শেখর দেবরায়!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker