India & World UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
সশ্রদ্ধ প্রণতি তোমায় কবি শঙ্খ ঘোষ, লিখেছেন পরিতোষ দত্ত
২১ এপ্রিল: সমস্ত সৃষ্টিকে পেছনে রেখে ৮৯ বছর বয়সে চলে গেলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। সারা পৃথিবী জুড়ে চলতে থাকা মারণব্যাধি কোভিড কবিকেও ছাড়েনি৷ মাত্র একটি সপ্তাহের মধ্যেই জীবনদীপ নিভে গেল তাঁর৷ চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল৷ বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ বাংলার এক বিশেষ সাহিত্যশৈলির স্রষ্টা, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপক পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন৷
আজ বারবার মনে পড়ছে কয়েক মূহূর্তের সেই আনন্দ সন্ধিক্ষণের কথা৷ বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা সমিতির সহসভাপতি অনুজপ্রতিম দীপক সেনগুপ্তকে সঙ্গী করে নিজস্ব কাজের তাগিদে ২০১৭-র ডিসেম্বরে কলকাতায় যেতে হয়েছিল৷ বিভিন্ন কাজের ফাঁকে এক সকালে একনিষ্ঠ সমাজকর্মী, ভাষা ও চেতনা সমিতির স্রষ্টা অধ্যাপক ইমানুল হক লস্করের কলকাতাস্থিত বাড়িতে পৌঁছে গেলাম৷ সেখানে গিয়ে নানা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা করব৷ ইমানুলের বাড়িতে চা-পর্ব শেষ করে তিনজন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম৷
যেহেতু আমি কবি নই, সাহিত্যিকও নই, যেতে যেতে মনের ভেতরে নানারকম আন্দোলন চলছিল৷ আবার এক অজানা আনন্দেও মনটা ভরে উঠছিল৷ এই আনন্দের মাঝেই মনে কী যেন নাড়া দিল৷ পথে গাড়ি থেকে নেমে একটি ফুলের তোড়া নিয়ে নিলাম৷
অধ্যাপক ইমানুল যে তাঁর খুব প্রিয়, সেটা শঙ্খ ঘোষের ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারলাম৷ তিনি কবির সঙ্গে আমাদের দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ সেদিন তাঁর বাড়িতে কবি-সাহিত্যিকদের আসর চলছিল৷ ফলে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল৷ তার আগেই অবশ্য দীপক ও আমি দুজনে মিলে ফুলের তোড়া দিয়ে কবিকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই৷ তিনিও দুহাত ভরে আশীর্বাদ করলেন৷ পরিবেশের সঙ্গে অনেকটাই সহজ হয়ে গেলাম৷ সাহিত্য আলোচনা শুনতে ভালই লাগছিল৷
তবে উপস্থিত সাহিত্যিকদের পাশাপাশি শঙ্খ ঘোষও আমাদের কথা শুনতে আগ্রহী হওয়ায় সাহিত্য আলোচনা বন্ধ রাখতে হল৷ অবশ্য এই পরিবেশ তৈরির জন্য ইমানুলেরও এক সদর্থক ভূমিকা ছিল৷ এর জন্য ইমানুলকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাই৷ স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতর্ষের এক অঙ্গরাজ্যের বাঙালি হিসেবে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকেই কীভাবে অত্যাচারিত হয়ে চলেছি, সেগুলোই অতি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করলাম৷ আমাদের রাজ্য সরকারের কাছে বাঙালির অবস্থান কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেই কথাগুলো কবির পাশাপাশি অন্যান্যরাও মন দিয়ে শুনলেন৷ উপস্থিত সবাই বললেন, অনেক অজানা তথ্য জানার সুযোগ হল৷ সেদিন সাহিত্য আলোচনাকে গুটিয়ে রেখে সবার সঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষও বরাকের বাঙালি সহ আসামের বাঙালির অবস্থান নিয়ে বেশ আলোচনা করলেন৷ যাই হোক, আসামের বাঙালির দুরবস্থা নিয়ে কিছু বলার জন্য, কিছু লেখার জন্য অনুরোধ রাখলাম৷ সেদিন তৃতীয় ভুবনের বাঙালিদের অবস্থান নিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে চলা আলোচনা কবির উপস্থিতিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল৷ সাহিত্য আলোচনার পাশাপাশি সুন্দরভাবে সাজানো চায়ের আসরও আমাকে মুগ্ধ করেছিল৷
যাই হোক, আমাদের কথাগুলো শুনে তিনি সমব্যথী হয়ে সুস্পষ্ট ভাষায় কথা দিয়েছিলেন যে, এবিষয়ে তিনি কথা বলবেন এবং তিনি কথা রেখেছিলেন৷ ‘এবিপি আনন্দ’ আয়োজিত এক আলোচনায় তিনি এই উপত্যকার বাঙালি সহ রাজ্যের ভাষিক সংখ্যালঘুর সমস্যাগুলো সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন৷ সে সব সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি আবেদনও রেখেছিলেন৷ এ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সহ বিভিন্ন আলোচনায় এই অঞ্চলের সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরেছেন৷ আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিনি রেখেছিলেন, কৃতজ্ঞচিত্তে আজও তা স্মরণ করছি৷
আজ সকালে তাঁর প্রয়াণের খবরটা শোনার পর থেকেই মুখোমুখি বসে সেদিনের জীবন্ত আলোচনার দৃশ্যটা চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে৷ সেদিন আলোচনা শেষে ‘পদ্মভূষণ’ আমাদের বিদায় জানাতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলেন৷ আশীর্বাদ জানানোর পাশাপাশি আবার যাবার জন্য অনুরোধ রেখে আমাদের বলেছিলেন, “আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে৷”
কিন্তু আর দেখা হলো না৷ জাগতিক নিয়ম মেনেই এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি৷ বাংলা কবিতার জগতে প্রকৃতই নক্ষত্রের পতন হল৷ বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল৷ সমসাময়িক কালের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ৷
এটা সত্য কথা যে, কবিতার ও কবির কোনও মৃত্যু নেই৷ এক দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ হিসেবে সর্বজনবিদিত পদ্মভূষণ সহ বিভিন্ন সম্মানে সম্মানিত এই বিরল ব্যক্তিত্বকে নতজানু হয়ে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
এই বিষাদসময়ে নিজের সৃষ্টির মাধ্যমেই কবি শঙ্খ ঘোষ আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন৷
“মুখের কথা একলা হয়ে
রইলো পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে”।
(লেখক ড. পরিতোষ দত্ত হাইলাকান্দি এসএস কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কর্মকর্তা৷)