NE UpdatesBarak UpdatesHappeningsCultureBreaking NewsFeature Story

প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী নীলপবন বরুয়ার সঙ্গে কিছুক্ষণ, লিখেছেন ড: রাজকুমার মজিন্দার

//ড: রাজকুমার মজিন্দার//

আসামের সমকালীন শিল্পকলার এক বিশিষ্ট পুরুষ ও সুপ্রসিদ্ধ নাম নীলপবন বরুয়া৷ ইংরেজি ১৯৩৬ সালে যোরহাটের টিয়ক শহরে তাঁর জন্ম। বাবা বিনন্দবরুয়া ‘ধ্বনি কবি’ রূপে পরিচিত ছিলেন এবং পেশায় শিক্ষক ছিলেন। প্রথমদিকে নীলপবন নাট্যজগতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, অভিনয় এবং সাহিত্যচর্চাও করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে কৃষি অর্থনীতি নিয়ে পড়তে যান। সেখানে অধ্যয়নরত শিল্পী মাধব বৈশ্যের সান্নিধ‌্যে তিনি চিত্রভাস্কর্যের দিকে আকর্ষিত হন এবং কলাভবনে ভর্তি হয়ে চিত্রভাস্কর্যের পৃথিবীতে প্রবেশ করেন৷ কালক্রমে যশস্বী শিল্পীরূপে খ্যাতি অর্জন করেন।

১৯৭৪ সালের ৭ মার্চ নীল পবন বরুয়া আসামের খ‌্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী দীপালি বরঠাকুরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ থেকে বোঝা যায়, চিত্রভাস্কর্য কলার অনুরূপ সংগীত তথা মানবিক দায়িত্বের প্রতি তাঁর কতটুকু অনুরাগ তথা সচেতনাবোধ ছিল। নীলপবন বরুয়ার জীবন নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। প্রকৃত অর্থে তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভা আর জীবন মূল‌্যবোধের এক অজেয় প্রতীক। তাঁর কাব্যিক প্রতিভাও অনন‌্য। তিনি নিজেই লিখেছেন

“যেখানে কথা শেষ হয়, সেখানে প্রয়োজন হয় রূপের………।”

২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর দিনের বেলায় গুয়াহাটির বেলতলা বাজারের কাছে সৌরভনগরের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম আমি এবং আর্ট ইকোর প্রকাশক তথা বরাক উপত‌্যকার অগ্রণী শিল্প প্রতিষ্ঠান শিল্পাঙ্গনের অধ্যক্ষ সন্দীপন দত্ত পুরকায়স্থ। হাসিভরা মুখ দিয়ে তিনি আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা নীলপবন বরুয়াকে আর্ট ইকো ম‌্যাগাজিন থেকে অভিবাদন জানালাম। এবং সেইসঙ্গে আমাদের আসার উদ্দেশ্যও ব্যক্ত করলাম।

রাজকুমার মজিদারঃ লোকশিল্পের উপাদানের সঙ্গে আধুনিক শিল্পকলার মিলন কি সম্ভব ? আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য হল, এই দুইয়ের সমন্বয়ই আপনার বাস্তবজীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। এ সম্বন্ধে আপনার মতামত কী?

নীলপবন বরুয়া: হ্যাঁ, আমি করেছি । ব্যাপারটা হল, যখন শান্তিনিকেতন থেকে গুয়াহাটি আসার কথা হল তখন একটু বিপদে পড়ে গেলাম৷ নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করব সেটা নিয়ে ভাবনায় ছিলাম। কিন্তু এই শহর আমাকে সহজ পথ দেখাল৷ সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর প্রয়াস করি। শুধু আমার নিজের কথা জানা নয়, জনসাধারণ কী বলছে এই আদান-প্রদানটা কীভাবে হবে, এর নিমিত্তে আমি মাজুলির ঐতিহ্যমণ্ডিত নতুন সামাগুড়ি সত্র থেকে কুশ গোস্বামী, হেমচন্দ্র গোস্বামী প্রমুখ একদল লোকশিল্পীকে গুয়াহাটিতে এনে মুখোশশিল্পের একটি কর্মশালা করি। আর সেই শিল্পীরা বাঁশের কাঠি দিয়ে অনেকগুলি মুখোশ তৈরি করেছিলেন। এতে অনেক লোকসমাগম হয়েছিল লোকজন উৎফুল্ল হয়েছিল এই ভেবে যে, কিছু একটা হতে চলছে। আমাদের অনেকে নানাভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, আর এইভাবে লোকশিল্পের প্রতি সচেতনতা গড়ে উঠেছিল। আমি যদি মাজুলির শিল্পীদের এনে কাজ না করাতাম তাহলে লোকজন হয়তো আমাকে সেইভাবে জানত না। শান্তিনিকেতনে আমি যা শিখেছিলাম, তার সঙ্গে আমি মাজুলি তথা আসামের লোকশিল্পের উপাদানকে মেলানোর চেষ্টা করলাম। এইক্ষেত্রে আমি এক দায়িত্ব নিয়ে মাজুলির শিল্পীদের শহরের লোকজনের কাছে নিয়ে গেলাম, সঙ্গে আমি নিজেও সমৃদ্ধ হলাম। প্রখ্যাত কবি ও পণ্ডিত নীলমণি ফুকন একদিন বলেছিলেন, ‘আপনার কাজে শিশুদের মানসিকতা আর লোকশিল্পের সহজীকরণ দুটোই দেখা যায় ”

রাজকুমার মজিন্দার : আসামের কলা সংগঠনের জন্ম আপনার হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালে আসাম ফাইন আর্টস  অ্যান্ড ক্রাফট সোসাইটিটি আপনার ও সোনারাম নাথের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। সাম্প্রতিককালে এই ধরণের অন্যান্য সংগঠনেরও যৌথ চিন্তাভাবনা হয়েছে, এই বিষয়ে আপনার মতামত?

নীলপবন বরুয়া: আমি অনুষ্ঠানবাদী, আমি শান্তিনিকেতনে ছিলাম৷ আমার ছোটবেলায় আমাদের অঞ্চলে কংগ্রেস অধিবেশন হয়েছিল। স্বাধীনতাসংগ্রামী জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা আমাদের গ্রামে এসে দেশভক্তিমূলক গান গেয়ে জনমানসকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, সেই সময়ে আমাদের গ্রামের টিয়ক সেবাশ্রমে ভারতবর্ষের অনেক বিখ্যাত, মহাত্মা গান্ধীর অনুগামী লোকজন এসেছিলেন। সেইগুলি মনে রেখে ১৯৭১ সালে আসাম ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট সোসাইটি শুরু করেছিলাম।

রাজকুমার মজিন্দার : আপনার শান্তিনিকেতনে পড়াকালে আসাম আর শান্তিনিকেতনের শিল্পকলার পরিবেশ ও শিল্পী সমাজের বিষয়ে সংক্ষেপে বলুন। যোরহাট থেকে শান্তিনিকেতন যাত্রা সম্বন্ধে আপনার বই “অন‌্য এক গতি”তে যদিও আগে লিখেছেন।

নীলপবন বরুয়া: আমি ছিলাম ভ্রমণপিপাসু। ঘুরে বেড়ানোর তাগিদে যোরহাটের গ্রাম থেকে কলকাতা গেলাম, সেখান থেকে শান্তিনিকেতনে৷ তার পর সময় এগিয়ে গেছে, আমি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেছি।

Art Echo কে দেওয়া তাঁর স্কেচ

রাজকুমার মজিন্দার : আপনি বেণু মিশ্র, সু​ষেন ঘোষ, মুকুন্দ দেবনাথ প্রমুখ আসামের স্বনামধন‌্য শিল্পীদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছিলেন, তাঁদের স্মৃতি মনে পড়ে কি? বরাক উপত্যকার স্বনামধন্য শিল্পী মুকুন্দ দেবনাথকে মনে আছে?

নীলপবন বরুয়া:  এই সব শিল্পীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ পরবর্তীকালেও যোগাযোগ রাখি। এক শহরের বাসিন্দা বেণু মিশ্র আমার কাছে অনেক বড়মাপের মানুষ। মিশ্রের শিল্পকর্মগুলি সমাজের উত্তরণ ঘটিয়েছে। বরাকের মুকুন্দ দেবনাথ, সুষেন ঘোষও অনেক গুণী শিল্পী৷ তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল।

আমি সবশেষে বললাম, আপনি আমাদের কাছে নবপ্রজন্মের বার্তাবাহক। আমরা সবাই আপনার পথ অনুসরণ করি। খুব সহজেই আপনাকে কাছে পাই৷ আপনার জীবন ও শিল্পকর্ম আমাদের প্রেরণার উৎস৷ এই ভাবে তাঁকে বিদায় জানিয়ে সেদিন আমরা ফিরে এসেছিলাম।

(ড. রাজকুমার মজিন্দার, সহকারী অধ‌্যাপক, দৃশ‌্যকলা বিভাগ, আসাম বিশ্ববিদ‌্যালয়।)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker