Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story

নেই মামার নৈরাজ্যে ছোট ছোট পাওয়াগুলো…

//শান্তশ্রী সোম//

২৪ আগস্ট: গেলো শীতে ছেলেটার বিয়ে হয়েছে। মেডিকেল কলেজের পি জি কোর্সের ছাত্র।বয়স আটাশ-উনত্রিশ। টগবগে যুবক। ফিটনেস অসাধারণ। ট্র্যাকিং, ফটোগ্রাফি, কোডিং সবেতেই দারুণ ঝোঁক। জীবনের স্থায়িত্ব আসার আগেই মারী এসে হাজির ওর বউ-এর পিছু পিছু। জানুয়ারিতে তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা সেরে রেখেছিল দুজনে। কারণ কোর্স শেষ হলেই তো আবার এক বছরের জন্য শহরের বাইরে কোথাও দুজনকেই থাকতে হবে। তাই কাজটা সেরে রাখা আরকি! এদিকে লকডাউন ও তৎপরবর্তী পরিস্থিতি পরীক্ষা পিছিয়ে পগারপার করে দিলো। এতোটা বছরের অক্লান্ত সাধনার শেষে ফাইনাল পরীক্ষা গেলো ঝুলে। তিনমাসের টানা টানাপোড়ন। হবে কি হবে না!

এই টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়ে স্টাডি লিভ না পেয়ে ওর কপালে জুটলো কোভিদ ডিউটি। ডিউটি চললো এক সপ্তাহ। দিনে এক শিফ্ট। রাত বারোটা থেকে পরদিন সকাল আটটা। ধরাচূড়ো লাগিয়ে তৈরি হয়ে যেতে হয় মোটামুটি রাত এগারোটা নাগাদ। শিফ্ট বদলের সময় ডিউটি হ্যাণ্ডওভার করার একটা ব্যাপার থাকে। তাই সময়ের অল্প আগেই হাজিরা নিশ্চিত করতে হয়। এই ধরাচূড়ো মানে পিপিই বস্তুটি করোনাকে বাগে আনতে পারে কি না বলা না গেলেও তার ধারককে অর্থাৎ কি না যিনি সেটি ধারণ করলেন, তাকে যে বেশ খানিকটা কাবু করে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে, তা বলাই বাহুল্য।

বিষয়টা হচ্ছে অনেকটা এরকম। পিপিই কিট যা দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে কোবিদ যোদ্ধাদের কাজ করতে হয় টানা মিনিমাম আট ঘণ্টা, তার মূল কাঁচামাল হচ্ছে পলিপ্রোপিলিন, পলিয়েস্টার, নায়লন ইত্যাদি। অর্থাৎ কিনা প্রধানতঃ থার্মোপ্লাস্টিক পলিমার সহ সেই প্রজাতির আরো কিছু মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি এই কিটটি পড়ে নিদেনপক্ষে আটঘণ্টা কাজ করে যেতে হবে। আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এই কাজে কিন্তু ফিজিক্যাল ফিটনেস, ধৈর্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আরো আরো বহু কিছু লাগে ডাক্তারি জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে। এসব কিছু একসাথে করতে হলে শরীর এবং মগজ দুটো অস্ত্রই সবল সতেজ রাখতে হয়। সবচেয়ে মনে রাখার ব্যাপার হচ্ছে — এই কাল করোনা কাল। রোগীরাও ভীষণ ভীষণ সেন্সিটিভ। এই অবস্থায় সর্বক্ষণ অ্যালার্ট থাকতেই হবে।

পিপিই কিট পরে 8 ঘন্টা ডিউটি করার পর

তো যা বলছিলাম। এই পিপিই টানা এতোক্ষণ পড়ে থাকলে শরীর থেকে ঘাম বেরোতে থাকবে ক্রমাগত। জল বা অন্য কোনো পানীয় নেওয়া যাবে না ডিউটি আওয়ারে। করা যাবে না শরীরের বর্জ্য তরল নিষ্কাশনও। অর্থার নো ইনটেক নো ডিসচার্জ। এ তো গেলো শরীরের ধকল যা মেটাবলিজমকে যে কোনো সময় ডিসব্যালেন্স করে দিতে পারে।

ডিউটি আওয়ারের পরও কিন্তু এরা সাধারণ জীবন যাপন করতে পারবে না। কারণ সেই মারী ও মড়কের ভয়। কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ করা স্থানে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে খাওয়া, পড়া, চলাফেরা করতে হবে। সেই লক্ষণের বেঁধে দেওয়া গণ্ডিতে। এই কোবিদ ডিউটির এক ডাক্তারের হাত ঘুরে হালে একখানা লিস্টি হাতে এলো। ডিউটিতে যাওয়ার আগে কী কী সামগ্রী নিয়ে গেলে হ্যাপা কিছুটা কম হবে। একটা কথাও বাড়িয়ে বলছি না। লিস্টি দেখে আমারই পগারপার হবার যোগাড়। কি নেই এতে ! নিজের দৈনন্দিন সামগ্রীর সঙ্গে দেশলাই, মশার কয়েল, ধূপকাঠি, ছোট ফ্যান, ইলেকট্রিক কেটলি, শুকনো খাবার, এন-৯৫ মাস্ক, ছাতা। মায় ওষুধ, তুলো, গ্লাভস, তালাচাবি আরো কত কি। এমনকি প্রথম দিনের খাবার জলটুকুও।

এসব দেখে বুঝতে পারলাম না এরা কোবিদ যুদ্ধে যাচ্ছে না সীমান্ত যুদ্ধে! ছেলেমেয়েগুলোর কি কোনো ‘মাই-বাপ’ নেই! এমনকি এসময়ের ইম্যুনিটি বুস্টারটাও নিজেদেরই দেখে নিতে হচ্ছে। লিস্টে কাঁচা হলুদ, ধনিয়া, ক্লোবটাসল সব স–ব রয়েছে। তবে হ্যাঁ। এই তালিকা কিন্তু সরকারের দেওয়া নয়। এর আগে যারা ডিউটি পালন করেছে, ঐসব কচিকাঁচা নতুন ভোরের আলোরা ঠেকে শিখে এই লিস্ট তৈরি করেছে পরবর্তীদের সুবিধে করে দিতে। নিজেদের কাজ করছে মনপ্রাণ দিয়ে। একইসাথে সমব্যথী হচ্ছে।

ভাবছেন চর্বিত চর্বণ করছি। না ভায়া। ভাবছি এই অজানা অধ্যায়গুলিতে আলোকপাত করলে যদি আমার মতো মারী মারণে মৃতপ্রায় মানুষেরা কিছুটা আলোর আভাস পান! মনে জাগে চরৈবেতির ইচ্ছে। ডিসটোপিয়ার রমরমায় যদি এনে দিতে পারি একপশলা ইউটোপিয়া। এই আর কি! আরো আছে। আমাদের স্বপ্ন দেখার রসদ। সবটাই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রাপ্তদের থেকে পাওয়া নির্ভেজাল খাঁটি বাস্তব। কোবিদ ডিউটি করে নিজে আক্রান্ত হওয়া সদ্য চাকরিতে ঢোকা ডাক্তারটি তার ওয়ার্ডে গাইছে জীবনের গান। শুধু শরীর নয়। এ যে মনেরও ব্যামো। সে চাইছে করোনা রোগীদের ট্রমা দূর করতে। নিজের ঝকঝকে মনের উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে দিয়ে ঝরঝরে করে তুলেছে বিষাদ ভরা ওয়ার্ডের পরিবেশ।

কলেজ টিচার করোনা রোগীকে নিজের মনের দু-কথা বললেন হাফলঙে পরিবার রেখে আসা এক তরুণ ডাক্তার। লাস্ট ঘরে গেছিলেন গত নভেম্বর মাসে। জানুয়ারিতে পেয়েছিলেন সুখবরটা। প্রথমবার বাবা হচ্ছেন। আনন্দটা একসঙ্গে ভাগ করে নিতে মার্চে বাড়ি যাবেন কথা দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। তারপরই এলো সেই বিশেষ নির্দেশ। সব ছুটি ক্যান্সেল। প্রকৃতির নিয়মে সন্তান দর্শনের সময় সন্নিকটে। সময়, সহায়, সঙ্গ দিতে হয় আসন্নপ্রসবা সঙ্গিনীকে। তা তো হবার নয়। তাই মনপ্রাণ দিয়ে সেবা করে চলেছেন সবার। বিশেষ করে কমবয়সী করোনা রোগীদের। যাদের মুখে হাসি ফুটলে তার আসন্ন সন্তানের আগমনও হবে নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে। সময়টা যে বড্ড বেয়াড়া।

এছাড়াও পেলাম আরো একঝাঁক টাটকা হাওয়া। কোবিদ আক্রান্ত সমাজের নিম্নবর্গের লোকেদের অনেকেই কিন্তু বেশ আনন্দে আছে কোবিদ ওয়ার্ডে। লকডাউন শুরু হওয়া ইস্তক পেট পুরে দুমুঠো খাবার এরা চোখে দেখেননি। এখানে এসে খাবারটা মিলছে ঠিকঠাক। সঙ্গে কিছু ভিটামিন ওষুধ। যা বাপের জন্মে এদের ভাগে জোটে না। ফাউ রয়েছে কম্বল। কোবিদ রোগীর ছোঁয়া কম্বল আর তো রাখা যায় না। তাই জুটে যায় তাদের বরাতে। অনেকে প্রথমবার পাওয়া কম্বলটা জলে ভিজিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে দাবি করে আরো একখানা কম্বল বাগিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। কি আর করা। ঘরে যে সবই বাড়ন্ত। আশা করা যায়, আসছে শীতে এদের অনেকেরই হাড় হিম হবেনা। করোনা হয়তো ছড়িয়ে গেলো এদের জীবনে এক পশলা উষ্ণতা।

এই এক গুচ্ছ ইতিউতি দেখা দেওয়া আপাত সাবলীল ঘটনা চারপাশের মারণ পরিবেশ, অমানবিক মূল্যহীন কাজকর্ম, দায়িত্বহীনতার নির্মম উপনিবেশের মধ্যে যেন ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে একরাশ হিমেল হাওয়া। নেই মামার নৈরাজ্যে এই ছোট ছোট পাওয়াগুলোকে ‘নজরআন্দাজ’ করলে বাঁচার রসদ পাওয়া যে দুষ্কর হবে! এক অতিমানবিক দানবীয় সন্ত্রাস, সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে থাকার বীজমন্ত্র, পারস্পরিক সন্দেহের বাতাবরণ, শুচিবাইগ্রস্ততা সব মিলিয়ে এখন এক ব্রহ্মাণ্ড বহির্ভূত জগতে আমাদের বিচরণ। তাই পরশ পাথরের খোঁজে ঠোকাঠুকি অবিরাম।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker