Barak UpdatesHappeningsCultureBreaking NewsFeature Story
“ তুমি এসো ফসলের ডাকে বটের ঝুরির ফাঁকে, আর এসো স্বপ্নঘুমে ”, লিখেছেন মঞ্জরি ভট্টাচার্য
//মঞ্জরি ভট্টাচার্য//
আচ্ছা ধরুন তো, রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলাদেশে না জন্মে অন্য কোথাও জন্মাতেন, কিংবা কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, সুরকার, গীতিকার এসব না হয়ে অন্য কিছু হতেন তাহলে কি হতো ! হ্যাঁ, বাংলা সাহিত্য জগতের একটা বিশাল ক্ষতি হয়ে যেত ঠিকই ; বিশ্বসাহিত্যেরও ক্ষতি হতো চরম , কিন্তু তাহলেও আমরা হয়তো অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে পেতাম । সেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে একই রকম ভাবে দেখতে শিখতাম এই দেশ-কাল-সমাজ এবং ভৌগোলিক কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে আদি দিগন্ত বিস্তৃত বিশ্বচরাচরকে । দাদাভাই (কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ) সম্পর্কে দু-এক কথা লিখতে গিয়ে আমার প্রথমেই এই কথাগুলোই মনে হলো । না, আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দাদাভাইয়ের তুলনা করছি না, কিন্তু দাদাভাই-ই প্রথম যে রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কার করার পরিসর খুলে দিয়েছিল আমার সামনে । আর শুধু রবীন্দ্রনাথই বা বলি কেন , চৈতন্যদেব থেকে লালন ফকির , রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, হাছন রাজা, রাধারমণ, শাহ আব্দুল করিম – এদের প্রত্যেককেই নতুন করে চিনেছিলাম দাদাভাইয়ের চোখ দিয়ে । মঞ্চে কত সহজেই না শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পঙক্তি নৈশব্দে মিশে যাচ্ছে রাধারমণের পদাবলীতে এসে, জীবনানন্দ থেকে শাহ আব্দুল করিম – একটা সেতু যেন বাঁধা পরস্পরের মধ্যিখানে , এসব ভাবা যায় ! একারণেই বলছিলাম, দাদাভাইয়ের সঙ্গীতশিল্পী, লোকসঙ্গীত গবেষক, সংগ্রাহক এবং সর্বোপরি ‘সবার কালিকাপ্রসাদ’ হয়ে ওঠার পেছনে আমাদের পরিবারের পূর্বসূরীদের একটা মস্তো বড়ো অবদান রয়েছে ঠিকই, কিন্তু দাদাভাই যদি জীবিকার টানে অন্য কোনো পথ বেছে নিত, আমার দৃঢ় বিশ্বাস – তাহলেও দাদাভাই একইরকম ভাবে আমাদের দেখাতো কিভাবে ‘স্বপ্ন দুচোখ খুলে জেগে দেখা যায়’ । জন্মদিনের উৎসবে চলে যাওয়ার কথা আমরা ভুলে থাকতে চাই বৈকি ! কিন্তু চাইলেই কি ভোলা যায় ! সে গেছে বলেই না আজ এতো সমারোহ , এতো কিছুর আয়োজন, এতো বিপুল সমাবেশ । তাই অনিবার্যভাবে মৃত্যুর উপস্থিতি এসেই পড়ে ।
আসলে এই কথাগুলো আমি আমার বহু লেখায় বারবার বলেছি । সে লিখেছিল, “শাহবাগ মানে ফাগুনে পলাশে বসন্তে প্রতিরোধ / শাহবাগ মানে বাহান্ন আর একাত্তরের শোধ” – যতবার প্রেমের সঙ্গে অপ্রেমের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যতবার মুক্তধারাকে ছাপিয়ে অচলায়তনিক রুদ্ধতা প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে চেয়েছে, ততবার জয়সিংহের আত্মবিসর্জন অনিবার্য হয়ে উঠেছে । দাদাভাইয়ের মৃত্যু আমার কাছে অনেকটা সেই রকমের মৃত্যু, যে মৃত্যু সময়ের সাথে সাথে সময় থেকে ছিন্ন হয়ে নয়, সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তির চরিতার্থতা অর্জন করে । এই আত্মবিসর্জনে চির বিরহের ক্লান্তি নেই বলবো না, কিন্তু সর্বস্ব নিয়ে চোখের অদেখার ওপারে যে চলে গেছে, তাকে মনের মধ্যে নতুন করে ফিরে পাওয়ার কোনো আসন পাতা নেই সেকথাই বা বলি কি করে ! আমাদের বিশ্বকবি সেকারণেই কি লিখেছিলেন – “ শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা, / শুধু আলো-আধাঁরে কাঁদা-হাসা ” ! মনে আছে, আমাদের ছোটোপিসি ( আনন্দময়ী ভট্টাচার্য) একবার বলেছিলেন, আমাদের জীবনে প্রসাদ এসেছিল যেন পূর্বজন্মের কোনো অচেনা ফুলের সুগন্ধি হয়ে । তিনি আরো বলেছিলেন, সত্যিই সে কি পূর্বজন্মে আমাদের ছিল , আর এ জন্মে তাকে পেয়েছি ; নাকি সে ছিল আমাদের পূর্বজন্মের পাওয়া – এ জন্মের নয় । শুনেছি, আমাদের পরিবারে বটবৃক্ষের মতো অসংখ্য ঝুরি বিস্তার করে সবাইকে আগলে রাখা দাদুমণির মৃত্যুর পর প্রত্যেকের শূণ্য , নিস্তরঙ্গ জীবনে নতুন করে আবার ঢেউ খেলেছিল দাদাভাইয়ের আগমনে । সে এসেছিল আমাদের পরিবারে ভোরের নতুন আলো হয়ে । জীবনের শূণ্যস্থান সেদিন ভরাট হয়েছিল অচিরেই । সত্তরের দশকে সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে যখন উত্তাল পরিস্থিতি, মুক্তিযুদ্ধের আবর্তে একাত্ম হয়ে সংগ্রাম করছে দেশের মানুষ, দুধের শিশু তখন খাওয়া ভুলে অবাক বিস্ময়ে শুনতো বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা , সবাই চেয়ে দেখতো স্লোগানে স্লোগানে ছড়িয়ে পড়া তার চোখেমুখের উদ্দীপনা – আর দাদাভাই ? দাদাভাই তখন সগর্বে ঘোষণা করতো “ আমি মুক্তিযুদ্ধের সন্তান ” ।
তারপর, একদিন বরাক-কুশিয়ারা ছাড়িয়ে ‘হবিগঞ্জের জালালি কইতর’ দিগন্তে ডানা মেলেছে বহুদুর, চেনা-অচেনার গণ্ডী ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্য বিশ্বে , মঞ্চে তাঁর নেতৃত্বে দুই বাংলার হাজার হাজার মানুষ নিমেষে গলা মিলিয়েছে দোহারের লোকগানের সুরে । এখন মনে হয়, সে হয়তো সত্যি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সন্তান । একটা মানুষ তার অসহায় জন্মভূমির জন্য নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে, সময় থেকে অগ্রগামী হয়ে যে লিখতে পারে, “আজ একতারার ছিলা তোমার স্পর্শ চায়, যদি টংকার দাও তুমি” – তাকে আর কী বলা যায় ! এই পরিবারে আমরা সবাই বরাবর একটা গভীর বিশ্বাস নিয়ে বড়ো হয়েছি – শিল্পীদের কোনো জরা নেই, ক্লান্তি নেই, স্থবিরতা নেই, নেই কোনো মৃত্যু । যদি কিছু থাকে, তাহলে আছে শুধু জন্ম – এক একটা উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো জন্ম, যে ধ্রুবতারার আলো কখনো কখনো দিশেহারা জীবনের সন্ধ্যাতারা হয়ে ওঠে । সেই তারার আলোতেই প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের দীর্ঘ পথচলা, সময়ের প্রলেপে হয়তো বদলাবে অনেক কিছুই, নতুন নতুন সৃষ্টিরা অনেক নতুন বাঁক তৈরি করবে সেই পথে, তবু ক্লান্তি আর অবসন্নতার কোনো ঠাঁই হবে না সেখানে – ঠাঁই হবে না সেই অনন্ত মহাকালের কোষে ।
শুভ জন্মদিন দাদাভাই, আমরা ভালো আছি, ভালোই আছি – কারণ আমাদের সবটুকু ভালো থাকা নিয়েই যে তোমার ভালো থাকা, তোমার বেঁচে থাকা ।