Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story

জ্ঞান-পাণ্ডিত্য ছেড়েই দিলাম, অর্ধাঙ্গিনীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের জন্যই তিনি অমর, লিখেছেন সমর্পিতা ভট্টাচার্য

//সমর্পিতা ভট্টাচার্য//

বিদগ্ধ শিক্ষাবিদ পণ্ডিতপ্রবর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সংস্কৃত অধ্যাপক অমরেন্দ্র ভট্টাচার্য গত ২৩ জুলাই রাত ১১ টা ৩৫ মিনিটে কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন। সম্পর্কে তিনি আমার জেঠু। তাঁকে নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, তিনি ছিলেন একজন আপাদমস্তক বিনয়ী, প্রকৃত শিক্ষিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি। আমার বাবা গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য এবং কাকা গৌতম ভট্টাচার্য দুজনই স্বর্গগত হন আমার বিয়ের কিছুদিন আগে। পিতৃহারা মেয়ের কন্যা সম্প্রদানের ভার কার হাতে অর্পণ করা যায়, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সবাই খুব চিন্তিত ছিলেন। সে বিষয়ে আমার এক জেঠতুতো দাদার সাথে কথা হলে সে নির্দ্বিধায় বলে, আমাদের মধ্যে অমর জেঠু যখন রয়েছেন সেখানে তো চিন্তার কিছুই নেই অর্থাৎ অমরেন্দ্র ভট্টাচার্য। সেখানে দ্বিমতের আর কোনও কিছু রইল না। আমাদের পরিবারের কাছে তিনি খুবই প্রণম্য ছিলেন। ছোট থেকেই দেখেছি, আমার বাবা-কাকা তাঁকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। তাঁরাই হয়তো বিচার করে দেখেছেন, তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের মেয়ের প্রতি এই দায়িত্ব-কর্তব্য সুচারুরূপে পালনের যোগ্য ব্যক্তি অমরেন্দ্র ভট্টাচার্য (অমর জেঠু)। সেই থেকেই আমাদের দুজনের মধ্যে বাবা-মেয়ের সম্পর্কের সূচনা। জেঠুকে ফোন করে আমার মা যখন তাঁর কাছে এই প্রস্তাব রাখেন, তখন তিনি কী পর্যায়ে যে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো শুরু করেন, তা এখানে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সত্যিকার অর্থে তারাই বড় মানুষ। তাঁর আবেগ মাখা পাণ্ডিত্যে ভরা বিনয়ী কথার স্রোতে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা ম্লান হয়ে যায়। জীবন সায়াহ্নে এসে নিঃসন্তান হয়েও কন্যা সম্প্রদানের মত মহতি কাজ আমাদের মাধ্যমে তাঁর হাতে যে ভগবান তুলে দিয়েছেন এই কথা ভেবেই বারংবার ধন্যবাদ জানাতে থাকেন। আর আশ্চর্যজনক ভাবে আমার বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই তিনি এই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলেন এবং চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন।

সাংগঠনিক ক্ষমতাও তাঁর যথেষ্ট ছিল। আমাদের সংস্থা আর্য সংস্কৃতি বোধনী সমিতি এই নামের স্রষ্টা ছিলেন তিনি। বলতেন, কোনও সংগঠনের সদস্যদের কার্যালয়ের বাইরে জুতো রাখার ধরন দেখেই বুঝতে পারা যায়, সবাই কতটুকু শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার এতটাই বিশাল ছিল যে, যখন কোনও বিষয়ে কিছু বলতেন, তার যেন শেষ নেই, সীমা নেই। অনর্গল কথার ফাঁকে বলে যেতেন সংস্কৃত শ্লোক। স্মৃতিশক্তিও ছিল অত্যন্ত প্রখর। কিন্তু তাঁর কথাগুলোর সাথে একাত্ম হওয়ার জন্যও এক অন্য মাত্রায় মেধা থাকা প্রয়োজন। যা আমাদের অনেকেরই ছিল না। এটা আমাদের অক্ষমতা। এরপরও বলতেন, তিনি নাকি মা সরস্বতীর হেন্ডিক্যাপড সন্তান।
গানের গলাও তাঁর বেশ ছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত খুব পছন্দ করতেন, গাইতেনও। এবারের হোলির দিন আমি ও আমার বর তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম পায়ে আবির মাখাবো বলে।
যাবার পর বললেন, তাঁর প্রয়াত স্ত্রী রত্নার ছবিতে প্রথমে আবির দিতে । এতে বোঝা যায়, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা তাঁর কতটুকু প্রগাঢ় ছিল। নারী জাতিকে তিনি দেবী রূপে দেখতেন। তিনিই প্রথম যিনি বৈদিক শাস্ত্র মেনে বরাক উপত্যকায় মেয়েদের উপনয়ন দিয়েছিলেন। এটা তাঁর জীবনের এক বিশেষ দিক।
মারা যাবার কিছুদিন আগে জেঠু হঠাৎ ফোন করে আমায় বলেন, তিনি খুব অসুস্থ। আমার বাড়িতে এসে তাঁর আর খাওয়া হবে না । একদিন যেন গিয়ে দেখে আসি। কিছুদিনের মধ্যেই আমি রান্না করা খাবার নিয়ে গিয়ে দেখি, খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাও ঠাকুর ঘরে নারায়নকে সেবা দিচ্ছেন। পুজো সেরে খুব দুঃখের সাথে বললেন, “আমার আর বেঁচে থেকে কী লাভ এ গলায় যখন আর কোনও দিন সুর উঠবে না, গান গাইতে পারবো না”। তাঁকে আর কীই বা সান্ত্বনা দিতে পারি। তারপর যখন খেতে দিতে বলেন, শুনে অবাক হই, তিনি প্রতিদিনই যা কিছুই খান, স্ত্রী রত্নার কাছে নিবেদন করে তবেই খান। সেদিনও যথারীতি থালি সাজিয়ে রত্নার সামনে কিছুক্ষণ রেখে তবেই খেলেন। দুটো মিষ্টি নিয়েছিলাম, তার থেকে একটি “রত্না খাইলাও” এই বলে রেখে দেন। এই ছিল তাঁর স্ত্রীর প্রতি সম্মান নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। স্ত্রী রত্নাও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। হঠাৎই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু একদিনের জন্যেও অমর জেঠু কোনও বিরক্তি প্রকাশ করেননি। তাঁর মুখে গালে নখের আঁচড় দেখা যেত শুনেছি বাবাদের কাছে। হেসে বলতেন, “ওতো জেনে বুঝে কিছু করছে না৷ এটা ওর অসুস্থতা৷ আমাকে তো একটু মানিয়ে নিতেই হবে৷ ও যে আমার অর্ধাঙ্গিনী”। আমার স্বল্প দেখায় এই ছিলেন অমরেন্দ্র ভট্টাচার্য।
শিক্ষা, অগাধ জ্ঞান, পাণ্ডিত্য এসবের পাশাপাশি নারী জাতির প্রতি যে তাঁর সম্মান সমাজের কাছে তা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অমর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker