Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
জল নেই, কারেন্ট নেই, নেই কোনও যোগাযোগ, টিঁকে থাকাটা ছিল খুব কঠিন, লিখেছেন মানস ভট্টাচার্য
বন্যার্তের ডায়েরি (দুই)
আর কিছু সময় পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। দোতলায় একটু পরে অন্ধকার হয়। এখনও কিছুটা আলো আছে। আজকের সন্ধ্যা অন্য দিনের মতো নয়। জল আর জল। ঘরবাড়ি সব বন্দি। শুধু জলের দাপট। ক্রমশ জলের রঙ কালো হয়ে যাচ্ছে। মাটির কোনো চিহ্ন নেই। জলে কারেন্ট এতো বেশি যে, গলি দিয়ে বেরোনো আর সম্ভব নয়। গলিতে খুব জল, সামনের দিকে একটু কম।কোনও এমার্জেন্সিতে কী যে করব ভাবতে পারছি না। জল বাড়ছেই।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। তেমন ভাবে কাঁসর ঘন্টা বাজতে শোনা গেল না। প্রতিটি দোতলা, তিনতলা, এমনকি খোলা ছাদেও মানুষ। কোনও ভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু কী করে থাকা যায়? জল নেই, কারেন্ট নেই, নেই কোনও যোগাযোগ, টিঁকে থাকাটা খুব কঠিন। এই চরম বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারব তো ! সন্ধ্যা হতে না হতেই গাঢ় অন্ধকারে সব ঢেকে গেল। ভয়ঙ্কর দৃশ্য ! গলি দিয়ে অন্তহীন জলের স্রোত অথচ খাওয়ার জল বা অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় কাজের জলের কী ভীষণ অভাব! একি লীলা ভগবানের! জলের মধ্যে থেকে যখন বাঁচার আর্তি অথচ খাওয়ার জন্য একফোঁটা জলও নেই। কী কঠিন পরিস্থিতি ! চরম অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে নিরন্তর অপেক্ষা, আকুল প্রার্থনা, জল যেন স্টেডি হয়।
সন্ধ্যার একটু আগে প্রচন্ড শব্দে পুরো ঘর কেঁপে ওঠে, প্রবল বেগে রিসার্ভার-এ বন্যার জল ঢুকছে। নিদারুণ হতাশায় আমরা অবসন্ন হয়ে পড়ি। রিসার্ভার সিল্ করা ছিল না। ১৬০০০ ক্যাপাসিটির মধ্যে বেশি অর্ধেক জল ভর্তি ছিল। সব নষ্ট হয়ে গেল– কী করব, ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছি না।
একের পর এক ফোন আসছে, দূর দূর থেকে। সাধারণত যারা খুব কম ফোন করেন তারাও। প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজন অনেকে ইতিমধ্যেই আগ্রাসী জলের বিধ্বংসী রূপ ভিডিও-তে দেখে উৎকন্ঠায় ফোন করছেন। সব ফোন রিসিভ করতে পারছি না। প্রচুর ম্যাসেজও আসছে । একই জিজ্ঞাসা — আমরা সেফ্ আছি কি না ? জালালপুর বাগান থেকে বন্ধু রণজিত, শ্রীঅরবিন্দ সোসাইটির বেশ কয়েকজন– যোরহাটের এস এন ফুকন, গৌহাটির ইন্দ্রজিৎ গোস্বামী, ডি সাপকোটা, শিলচর কেন্দ্রের মহামায়াদি, শাশ্বতী ভট্টাচার্য এঁরাও। দিল্লি থেকে জেঠতুতো ভাই কুমকুম কয়েকবার ফোন করে। গুয়াহাটি থেকে ছোটো বোন মিত্রা, ভুবনেশ্বর থেকে মেজবৌদি এবং শিলচরের আমার বৈবাহিকা মহাশয়ারও ফোন আসে। কতো ফোন। অনেকে বারবার চেষ্টা করেও পাচ্ছেন না। আমার শ্বশুর বাড়ির দিকে থেকেও সম্মন্ধিরা সহ অনেকেই ফোনে জানতে চান– আমরা ঠিক আছি কি না। আরও অনেকের কথা মনে পড়ছে না। রাত বাড়ছে, জলও বাড়ছে। বাইরের আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার পাম্প ২০০৭-এ ফ্লাডের পর অনেক উঁচুতে উঠিয়েছিলাম, তবুও জল ডুবিয়ে দিল। এতোই জল, এবার বুঝি আর রক্ষে নেই।
আমরা কালেক্টিভলি ডিসিশন নিলাম, টিকে থাকতে তো হবে, তাই, প্রতি ড্রপ জল এখন অত্যন্ত মূল্যবান, এক ড্রপও নষ্ট করা যাবে না। ফ্লাস করা বন্ধ, বড় বাথরুম ব্যবহার, সবকটি টেপ টোটালি বন্ধ। মগের জলে সব কাজ হবে। বেশ গরম, তাই স্নান বা শরীর মোছা জরুরি, আড়াই মগ জল বরাদ্দ। লেট্রিনে ফ্লাডের জল, কমোড ইউস্ বন্ধ। সহধর্মিণী জল-ব্যবহারে আউটস্ট্যান্ডিংলি ক্যালকুলেটিভ। রান্না, স্নান, প্রতিদিনের কাপড়চোপড় ধোওয়া, ঠাকুর ঘরের কাজ ইত্যাদি সব কিছুই, জলের স্ট্রিক্ট রেশনিং মেনে যথারীতি চলে। আমাদের ইনভার্টার-এর ব্যাটারিও বেশ পুরোনো, তাই, সন্ধেবেলায় ঠাকুর ঘরে অল্প সময় একটি, আর রাতে খাওয়ার সময়ে একটি লাইট (এল,ই,ডি)। ঘর অন্ধকার। আমরা বেলকোনি না হয় ছাদে। জল দেখা ছাড়া আর অন্য কোনও কাজ নেই।
রাত বাড়তে থাকে নেট্ও চলে যায়। ফোনও ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না। Bharat fibre, Airtel net সব অকেজো হয়ে গেছে। শুধু ভোডাফোনে কথা বলা যাচ্ছে, তাও, দোতলার ছাদে। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, ছেলের সাথে কি করে যোগাযোগ রাখি। সে রাশিয়াতে। সাধারণত ভিডিও কলে প্রতি রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের কথা হয়। কিভাবে হয় জানিনা– নেটের মাধ্যমে তার ভিডিও কল আমাদের কাছে ফোন-কলে কনভার্ট হয়ে আসে। একমাত্র তিনতলা থেকেই তা সম্ভব। তার কাছ থেকে জল সম্পর্কে আমরা অনেক আ্যডভান্স্ ইনফরমেশন পাই।
রাত বেড়ে চলে। কাছে দূরে মাঝে মাঝেই চিৎকার, হৈ হল্লা। আবার সব নীরব। নিঝুম অন্ধকারে জল-স্রোত তীব্র দাপটে বয়ে চলছে। এর শেষ কোথায় ?
Also Read: বিধ্বংসী বন্যায় বিধ্বস্ত শিলচর, অসহায় আমরা, লিখেছেন মানস ভট্টাচার্য