Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ : আইজ্যাক নিউটন ছিলেন একগুয়ে অহংকারী, কিন্তু অক্ষয় তাঁর উদ্ভাবন, লিখেছেন ড. সব্যসাচী রায়
ক্যালকুলাসের জনক কে এই নিয়ে সতেরো শতকের সেই নিউটন-লিবনিজ বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক অনেকেরই জানা। নিউটন থেকে চার বছরের ছোটো গটফ্রাইড উইলহেম লিবনিজ যখন ১৬৮৪ সালে ক্যালকুলাসের গাণিতিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন সঙ্গেসঙ্গেই নিউটন দাবি করেন যে তিনি এই তত্ত্ব (মেথড অব ফ্লাক্জিওন্স) দু’দশক আগেই তৈরি করেছেন, কিন্তু গবেষণাপত্র হিসেবে প্রকাশ করেননি। বলা প্রয়োজন, ক্যালকুলাসের নতুন ধারণা নিয়ে নিউটনের প্রথম গবেষণাপত্রটি আঠারোশতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে প্রকাশিত হয় (১৭১১ সাল)। কে আগে, কে পরে…কার তত্ত্বটি মৌলিক, এই বিতর্ক তাই দীর্ঘ চার দশক ধরে চলতে থাকে। পরিশেষে, ১৭১৩ সালে রয়্যাল সোসাইটি ক্যালকুলাসের আবিষ্কর্তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য একটি সমিতি গঠন করে। সেই সমিতির প্রতিবেদনে নিউটনের পাল্লা ভারি থাকে। যদিও, এর পেছনে নিউটনের প্রভাব ছিল বলে অনেকের ধারনা। লিবনিজ এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে, ১৭১৬ সালে লিবনিজের মৃত্যুতেই এই বিতর্ক স্তিমিত হয়। যদিও আজকের দিনে আমরা ক্যালকুলাসের যে প্রতীকগুচ্ছ ব্যবহার করি সেগুলো কিন্তু লিবনিজের উদ্ভাবন। এবং, আজকের দিনে এটাই মেনে নেওয়া হয়েছে যে নিউটন এবং লিবনিজ দু’জনেই স্বাধীনভাবে নিজেদের ক্যালকুলাসতত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন।
স্যার আইজ্যাক নিউটন, মানব ইতিহাসে এক কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা রহস্যের উন্মোচনের লক্ষ্যে নিউটন যেসকল মৌলিক ভাবনা উপস্থাপন করেছিলেন, সেগুলো পরবর্তীতে কালজয়ী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু, কেমন ছিল নিউটনের ব্যক্তিসত্তা বা তাঁর বিজ্ঞানীসত্তা? এই ব্যাপারটি বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যেই উপরের আখ্যানটির উপস্থাপন।
কিছুটা খামখেয়ালী, কিছুটা অহংকারী এবং রহস্যে আবৃত এক দার্শনিক, যিনি সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। যখন রবার্ট হুক নিউটনের আলোকতত্ত্ব এবং গ্রহের গতিপথ সম্পর্কিত তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, তখন হুককে আজীবন শত্রু হিসেবে বানিয়ে ফেলেছিলেন নিউটন। এবং, হুক-এর চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে, নিউটন প্রায় দু’বছরের পরিশ্রমে সেই বিখ্যাত প্রিন্সিপিয়া (ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা) গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটি ছিল তাঁর বিশ বছরেরও বেশি সময়ের চিন্তার চূড়ান্ত ফসল যেটিতে তাঁর উদ্ভাবিত ক্যালকুলাসতত্ত্ব, তিনটি গতিসূত্র এবং সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণতত্ত্বের প্রথম বিস্তৃত বিবরণ ছিল। সেইসঙ্গে, মহাবিশ্বের এক নতুন বৈপ্লবিক গাণিতিক বর্ণনাও ছিল তাতে। এই গ্রন্থটি, প্রকৃতপক্ষে, তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল সেইসময়, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাশালীদের মধ্যে তাঁকে প্রথম সারিতে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছিল। এই কথা মানতে হবে যে নিউটনের মতো অন্য কোনও বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমগ্র বিশ্বে এত গুরুত্বপূর্ণ, বিস্তৃত এবং স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেননি। তাই, আজ, আধুনিক বিজ্ঞানের তিনজন জনকের অন্যতম হিসেবে নিউটন অবশ্যই বিবেচিত হন (বাকি দু’জন গ্যালিলিও এবং আইনস্টাইন)।
ব্যক্তি হিসেবে নিউটন ছিলেন একগুয়ে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, যখনই তাঁর কোনও মতবাদের বিরুদ্ধে কেউ মন্তব্য করতেন, তিনি বাক্যবিনিময়ে বিতর্কে জড়িয়ে পরতেন। নিউটনের ব্যক্তিসত্তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অস্ট্রীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্লোরিয়ান ফ্রেস্টেটার নিউটনকে নিয়ে তাঁর লিখিত গ্রন্থে এমনটাই বলেছেন। প্রাকৃতিক দর্শনের বাইরে ধর্মতত্ত্ব এবং অ্যালকেমির (মধ্যযুগীয় রসায়ন) প্রতি তার এক আশ্চর্য মোহ ছিল। চিন্তাচর্চার এক বিরাট সময় তিনি এই ব্যাপারগুলোতে নিয়োজিত করতেন। প্রকৃতপক্ষে, নিউটন অ্যালকেমি নিয়ে প্রায় সাড়ে-ছ’লক্ষ শব্দ রচনা করেছেন। তাই, তাঁর এই আগ্রহকে এক নিছক শখ হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না। নিউটনের ব্যক্তিসত্তার এই দিকটি রব ইলিফ ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ ‘প্রিস্ট অফ নেচার: দ্য রিলিজিয়াস ওয়ার্ল্ডস অফ আইজ্যাক নিউটন’-এ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
নিউটনের বিজ্ঞানীসত্তার বিশ্লেষণ করতে গেলে বলতে হয় যে আজকের দিনের সহযোগিতামূলক সঙ্ঘবদ্ধ গবেষণার ধারার সঙ্গে এক অ-স্বাভাবিক একক চিন্তনের পথে হাঁটার নিউটনের মানসিকতার পুরোপুরি অমিল ধরা পরে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে হয় যে বিজ্ঞানে বিরোধ এক স্বাভাবিক ব্যাপার। বিরোধের মঞ্চ থেকেই বিজ্ঞানের নতুন ধারণার জন্ম হয়। যে অর্থে আমরা সামাজিক-রাজনৈতিক খণ্ডে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত, সেই অর্থে বিজ্ঞান অবশ্যই গণতান্ত্রিক নয়। বিজ্ঞানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অবকাশ নেই। কারণ, সত্য অণ্বেষণে বিজ্ঞান যে পথে এগিয়ে যায় সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অপ্রাসঙ্গিক।
অনেকে বলেন, নিউটন না থাকলে আইনস্টাইন, আইনস্টাইনের সমসাময়িক এবং আইনস্টাইন-পরবর্তী বিজ্ঞানীরা তাঁদের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতেন না, আজকের দিনের আধুনিক বিজ্ঞান এতটুকু শক্ত ভিতে স্থিতিশীল হতে পারত না। নিউটন সত্যিকার অর্থে প্রাকৃতিক দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের এক বলিষ্ঠ গাণিতিক ভিত গঠন করে দিতে পেরেছিলেন। নিউটনের ৮৪ বছরের বর্ণময় জীবনের মূল্যায়ন আলবার্ট আইনস্টাইন একটি মন্তব্য থেকে ধরা পড়ে, “প্রকৃতি ছিল নিউটনের কাছে একটি খোলা বইয়ের মতোই, যার পাতাগুলো নিউটন অবলীলায় পড়তে পারতেন।” তিনি আসলে সকল বিশেষণের উর্ধ্বে সত্যিকার অর্থে একজন ‘আলোর মানুষ’। জন্মদিনে তাঁর চির-অমলিন অবদানের গাথাগুলো স্মরণ করে এই দার্শনিকের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।
(ড. সব্যসাচী রায় করিমগঞ্জ কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান৷)